যে কারণে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অনুজ্জ্বল টাইগাররা

যে কারণে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অনুজ্জ্বল টাইগাররা

ক্রীড়া প্রতিবেদক : মনে হচ্ছে, শেষ চার-পাঁচ ওভারেই হেরে গেছে। খালি চোখে তাই মনে হবে। কারণ শেষ ৫ ওভারে আফগানরা তুলেছে ৭১ রান, আর ঠিক ঐ জায়গায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা করেছেন মোটে ১৯ রান। তাও আবার পাঁচজন আউট হয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হচ্ছে পার্থক্যটা সেখানেই গড়ে উঠেছে।

ক্রিকেট যেহেতু পরিসংখ্যানকেন্দ্রিক খেলা, তাই অমন ব্যাখ্যার যৌক্তিকতাও আছে যথেষ্ট। কালকের ম্যাচের চালচিত্র অবশ্য সে সাক্ষীই দেবে। কারণ, পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে শেষ ৫ ওভারের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ এগিয়ে ছিল।

১৫ ওভার শেষে আফগানিস্তানের রান ছিল ৪ উইকেটে ৯৬ আর বাংলাদেশের ছিল ৫ উইকেটে ১০৩। তার মানে ‘ডেড ওভার’ শুরুর আগে পর্যন্ত বর সাকিব বাহিনীই ছিল ৯ রানে এগিয়ে। কাজেই খেলা শেষে ঐ ‘ডেড ওভারের’ ঘটনাই বেশি করে উচ্চারিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

মোদ্দা কথা, রোববারের ম্যাচে শেষ দিকে বাংলাদেশের বোলার ব্যবহার ঠিক হয়নি। পেসাররা আলগা বোলিং করে বেশি রান দিয়ে ফেলেছেন। আর টাইগাররাও শেষ পাঁচ ওভার চরম বাজে ব্যাটিং করেছেন। তাই ৪৫ রানের বড় হার।

এটা হচ্ছে কালকের ম্যাচের সংক্ষিপ্ত ব্যবচ্ছেদ। তাই বলে শুধু শেষ পাঁচ ওভারে বেশি রান দিয়ে ফেলা আর নিজেরা শেষ পাঁচ ওভারে কিছুই করতে না পারায়ই বাংলাদেশ হেরেছে, এমন ভেবে হিসেব শেষ করারও কোনো কারণ নেই। টাইগারদের না পারার আরও কারণ আছে। আসল পার্থক্য হলো শক্তি ও সামর্থ্য।ে যেখানে আফগানরা এগিয়ে।

একটু গোলমেলে ঠেকছে, তাই না? ভাবছেন, এ কি কথা ? বাংলাদেশ পুরোদস্তুর টেস্ট খেলিয়ে দেশ। ১৮ বছর ধরে টেস্ট খেলছে। সেই ১৯ বছর আগে বিশ্বকাপ অভিষেক। পাঁচ-পাঁচটি বিশ্বকাপও খেলেছে। সেখানে আফগানিস্তান নবীন শক্তি। এখনো টেস্ট অভিষেক হয়নি। এই তো কদিন পর ১৪ জুন ব্যাঙ্গালুরুতে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট যাত্রা শুরু হবে আফগানদের। গত বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের কাছে পাত্তাই পায়নি। তাহলে আফগানিস্তান শক্তি, সামর্থ্যে এগিয়ে থাকে কি করে?

যারা এমনটা ভাবছেন, তাদের জন্য বলা, এখানে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের কথাই বলা হচ্ছে। ওয়ানডে নয়। অতি বড় বাংলাদেশ সমর্থকও নিশ্চয় মানবেন, বাংলাদেশ ৫০ ওভারের ক্রিকেট যত ভালো দল, অন্য কোন ফরম্যাটে বিশেষ করে টি-টোয়েন্টিতে মোটেই তত ভালো দল নয়।

টাইগাররা ৫০ ওভারের খেলাটা বোঝে বেশ। কখন কি করতে হবে, তা ভালোই জানা। একদিনের খেলায় সাফল্যর পূর্ব ও অত্যাবশ্যকীয় শর্তসমূহ কি, কি কি করলে ওয়ানডেতে সাফল্যর নাগাল পাওয়া যায়- মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির, মোস্তাফিজ ও রুবেলদের তা মোটামুুটি নখোদর্পনে। তারা ওসব মোটামুটি ভালো জানেন। কিন্তু নির্জলা ও কঠিন সত্য হলো, সেই তারাই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তত ভালো খেলেন না। বোঝেনও কম। কিংবা বুঝলেও সময়মত জানা, বোঝা ও পারা বিষয়গুলোর বাস্তব রূপ দিতে পারেন না। হয়তো প্রয়োগ ক্ষমতাও কম।

সে কারণেই ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে বাংলাদেশের সাফল্য তুলনামূলক কম। ব্যর্থতাই বেশি। খুব স্বাভাবিকভাবে সামর্থ্যওে ঘাটতি আছে। ইতিহাস পরিসংখ্যানই সে সাক্ষী দিচ্ছে। গত তিন বছরে ৫০ ওভারের যে দুটি বিশ্ব আসর হয়েছে, সেই বিশ্বকাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দুটিতেই বাংলাদেশ সেরা আটে ছিল। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হওয়া বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসরে ভারতের সাথে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে আর একই দলের বিপক্ষে গত বছর এই জুন মাসে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে টাইগাররা।

বাংলাদেশ ৫০ ওভারের ক্রিকেটে দল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ওয়ানডে ব্যাটিং ও বোলিং সাফল্যের কিছু নির্দিষ্ট ছক ও অত্যাবশ্যকীয় ফর্মুলা আছে। যা বাংলাদেশের পারফরমাররা মোটামুটি ভালোই রপ্ত করেছেন। তারা জানেন, ব্যাটিং ও বোলিংয়ে কখন কি করতে হবে, শুরুটা কেমন হওয়া দরকার, মাঝে কেমন খেলতে হবে আর শেষ দিকে কি করণীয়। একইভাবে বোলিং ডিপার্টমেন্টেও শুরুতে অ্যাপ্রোচ কেমন হবে, মাঝামাঝি অংশে কোন লাইন ও লেন্থে বল করতে হবে আর ডেড ওভারের বোলিংয়ের ধরণটাই বা কেমন হবে; এগুলো মোটামুটি জানা হয়ে গেছে টাইগারদের।

কিন্তু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তা হয়নি। তাই এ ফরম্যাটে অমন বড় সাফল্যও নেই। র‌্যাঙ্কিংয়ে আফগানিস্তানের (আট) দুই ধাপ পিছনে বাংলাদেশ (১০ নম্বর)।

খালি চোখে টি-টোয়েন্টি শুধুই মার-মার কাট-কাট বা চার ছক্কার খেলা। সাথে পিঞ্চ ও পাওয়ার হিটিংয়েরও খেলা। খেলার দৈর্ঘ্য যেহেতু কম, মাত্র ১২০ বলের। তাই সনাতন ধারার ব্যাটিং মানে ক্রিকেটের ব্যাকরণ মেনে খেলার সুযোগও কম। বলের মেধা ও গুন বিচার করে খেললে রান করাই কঠিন হয়ে পড়বে। তাই প্রায় সবার চেষ্টা থাকে হাত খুলে আর আক্রমনাত্মক মেজাজে ব্যাট চালনা।

পাশাপাশি শরীরের শক্তিকে পুঁজি করে পাওয়ার হিটিংটাও এ ফরম্যাটে ব্যাটিং সাফল্যের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ভাবা হয়। তাই তো ক্রিস গেইল, শেন ওয়াটসন, এভিন লুইস ও আন্দ্রে রাসেল, ডেভিড ওয়ার্নার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল আর কাইরন পোলার্ডরা টি-টোয়েনিটতে ভয়ঙ্কর উইলোবাজ। অন্য সব ক্রিকেটারদের চেয়ে যাদের শারীরিক গঠন তুলনামূলক সুদৃঢ়। শক্তি-সামর্থ্যও বেশি। শারীরিক সক্ষমতা তথা শরীরের শক্তি কাজে লাগিয়ে তারা অনেক ভালো ও সমীহ জাগানো বলকেও অনায়াসে সীমানার ওপারে পাঠান।

তাদের দিনে এ সব ভয়ঙ্কর আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানদের আটকে রাখা খুব কঠিন। তারা সেট হয়ে গেলে আর ভালো-খারাপ বল নেই। সব বলকেই যেখান দিয়ে খুশি সেখান দিয়েই সীমানার ওপারে পাঠাতে পারেন। অনেক বাঘা বাঘা বোলারও তখন হালে পানি পান না। লো ফুলটস, ফুল লেন্থ ডেলিভারি-কোনো কিছু দিয়েই তাদের আটকে রাখা কঠিন। তারা ঐ সব বলেও অনায়াসে চার- ছক্কা হাঁকিয়ে বসেন। এমনকি তাদের মিস হিট গুলোও দেখা যায় বাতাসে ভেসে সীমানার ওপারে গিয়ে আছড়ে পড়ে।

যে রশিদ খান এখন বিশ্বের সব নামি-দামি ব্যাটসম্যানের মাথা ব্যথার কারণ, যার লেগস্পিন আর গুগলি বুঝতে অনেকেই বেসামাল- সেই লেগস্পিনারও আইপিএল ফাইনালে ওয়াটসন ঝড়ে উড়ে গেছেন। সাকিব আল হাসানের অবস্থাও ছিল তথৈবচ।

এবারের আইপিএল ফাইনালে শেন ওয়াটসন একাই ব্যবধান গড়ে দিয়েছেন। তার অতি মানবীয় ব্যাটিং তান্ডবের মুখে খড় কুটোর মত উড়ে গেছে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের শিরোপা জেতার স্বপ্ন। চেন্নাই সুপার কিংস হলো এবারের আইপিএলের নতুন চ্যাম্পিয়ন।

পাওয়ার হিটিং তথা অবলীলায় গুড লেন্থ ও থ্রি-কোয়ার্টার লেন্থের বলকে বাতাসে ভাসিয়ে ছক্কা ও চার হাঁকানোর বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে আরও কজন ব্যাটসম্যানের। সেই তালিকায় সবার আগে আসবে দক্ষিণ আফ্রিকার সদ্য বিদায়ী এবি ডি ভিলিয়ার্সের নাম। ঐ দলে নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, বর্তমান অধিনায়ক উইলিয়ামসন ও ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিও আছেন। তারাও পাওয়ার হিটার। অনেক জোরে মারতে পারেন। তাতের কাছেও ভালো আর খারাপ ডেলিভারির বাছ বিচার কম। তবে তারা পাওয়ার হিটিংয়ের পাশাপাশি ইম্প্রোভাইজ করে বোলারের মাথা খারাপ করে দেন।

দেখা গেল অন সাইডে ফিল্ডার বেশি নিয়ে অফ-মিডলে বল করেছেন বোলার, তারা আগেই অনসাইডে সরে ইনসাইড আউট করে অবলীলায় কভার-এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে চার-ছক্কা হাঁকিয়ে বসেন। আবার কখনো অফ সাইডে বেশি ফিল্ডার থাকা বলকে অফে সরে স্কুপ শটে ফাইন লেগ-স্কোয়ার লেগ দিয়ে সীমানার ওপারে পাঠানোর কাজটিও তারা খুব ভালো পারেন।

সে কারণেই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ব্যাটিং টেকনিক খানিক ভিন্ন। যাতে নানা কিছুর মিশেল আছে। হিসেব-নিকেষটা বেশি। সব বলে চার ও ছক্কা হাঁকানোও আবার শেষ কথা না। বুদ্ধি খাটিয়ে বোলারের লাইন-লেন্থ আর ফিল্ডারের পজিশন বুঝে ইম্প্রোভাইজটাও খুব জরুরী। খেলাও জরুরী। শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য কম থাকলে মানে পাওয়ার হিটিং এবিলিটি কম থাকাও একরকম ঘাটতি। সে ঘাটতি পোষানো আসলে কঠিন। তারপরও হিসেব কষে, বুদ্ধি খাটিয়ে এবং ইম্প্রোইভাইজের মিশ্রনে পারফরম করতে পারলে এ ফরম্যাটে সাফল্য পাওয়া সম্ভব।

কঠিন সত্য হলো, এখানেই পিছিয়ে বাংলাদেশ। শারীরিক দিক থেকে অমন শক্ত সামর্থ্যর কেউ নেই বাংলাদেশে। যাদের কথা বলা হলো, তারা সবাই এক পজিসনের ব্যাটসম্যান নন। গেইল, লুইস, ম্যাককালাম আর ওয়াটসন টপ অর্ডার। ডি ভিলিয়ার্স, ওয়ার্নার, ম্যাক্সওয়েল, ধোনি, আন্দ্রে রাসেল ও পোলার্ডরা মূলতঃ মিডল অর্ডার। তবে তারা আবার গ্রেট ফিনিশারও।

এরকম মানের অলীক কল্পনা। তার ধারে কাছেও একজন পারফরমার নেই বাংলাদেশের। আর তাই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কার্যকরিতা তথা সাফল্য বেশ কম। এই ফরম্যাটে যে দলগুলো ভালো, তাদের প্রায় সবার এক থেকে তিন নম্বরে অন্তত এক বা দুজন হার্ডহিটার আছেন। যারা শুরুর পর প্রথম ছয় ওভারের পাওয়ার প্লে ‘র সময় যখন নয়জন ফিল্ডার তিরিশ গজের ভিতরে থাকে, তার ওপর দিয়ে মেরে খেলার সামর্থ্য রাখেন।

সেই সব টপ অর্ডাররা ক্লিন ও বিগ হিটার। তাদের পিঞ্চ হিটিং করার সামর্থ্যও আছে। এতে করে একটা উড়ন্ত সূচনা হয়। দেখা যায়, প্রথম ছয় ওভারে গড়পড়তা ৯/১০ রান করে ওঠায় স্কোর চলে যায় পঞ্চাশ পেড়িয়ে ষাটের ঘরে। বাংলাদেশের টপ অর্ডারের সে সামর্থ্য কম। তামিম ওয়ানডের জন্য যতটা কার্যকর, টি-টোয়েন্টিতে ততটা নন। বিগ হিট নেবার ক্ষমতা আছে। কিন্তু দিনকে দিন তার তেজ কমে যাচ্ছে।

এছাড়া বাঁহাতি হিসেবে প্রতিপক্ষ দল অফস্পিন দিয়ে তামিমকে প্রায়ই ঘায়েল করছেন। অফস্পিনের বিপক্ষে তামিম বার বার আউট হচ্ছেন। প্রথম ম্যাচেও আফগানিস্তানের বহুমুখি ও বৈচিত্রে ভরা অফস্পিনার মুজিবুর রহমান তামিমকে রাউন্ড দ্যা উইকেটে গিয়ে লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে ফেলেছেন।

তার চেয়ে বরং এখন টি-টোয়েন্টিতে লিটন দাস আর সৌম্য সরকারের বিগ হিটিং এবিলিটি বেশি। তারা ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে শুরুতে মানে পাওয়ার প্লে‘তে ফিল্ডারদের মাথার ওপর ও নাগালের বাইরে দিয়ে আক্রমনাত্মক শটস খেলার সামর্থ্যও রাখেন। কিন্তু সে সামর্থ্যর বাস্তব প্রয়োগ ঘটে কালেভদ্রে। সেটাও এক বড় সমস্যা। ঘাটতি। দূর্বলতা।

ওপেনারদের পর মিডল অর্ডারও তত মজবুত আর সাজানো গোছানো নয়। টি-টোয়েন্টিতে মিডল অর্ডারদের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাজটি দুই রকম। সাধারণতঃ চার, পাঁচ ও ছয় নম্বরে নামা ব্যাটসম্যানরা ৭ থেকে ১৫ ওভার সিঙ্গেলস-ডাবলস আর আলগা বলগুলো থেকে যত বেশি সম্ভব চার-ছক্কা আদায় করে গড়পড়তা ওভার পিছু সাত-আট রান তুলে রান চাকা সচল রাখেন।

তারপর শেষ দিকে থাকা হার্ড হিটাররা শেষ ২৫-৩০ বলে দেড়শো থেকে ২০০ কখনো তার চেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেটে ব্যাট চালিয়ে ইনিংস বা ম্যাচ শেষ করে দেন। এখানেও পিছিয়ে বাংলাদেশ। সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির ও মোসাদ্দেকরা অত হিসেব কষে খেলেন না। কখন উইকেটে থাকতে হবে, কোন সময় সিঙ্গেলস-ডাবল আর আলগা বল মেরে রান চাকা সচল রাখতে হবে আর কখন তেড়ে ফুড়ে বোলারের ওপর চড়াও হতে হবে, সেই বোধ-উপলব্ধিটা এখনো পরিষ্কার নয়। তাই দেখা যায়, তারা দুম করে যাকে তাকে যখন তখন আক্রমনাত্মক শটস খেলতে গিয়ে অকাতরে উইকেট দিয়ে চলে আসছেন।

অথচ পুরো দলের মিডল ও লেট অর্ডার তাদের ওপরই নির্ভর করে। কিন্তু চিন্তা-ভাবনা করে না খেলার কারণে দেখা যায় বেশির ভাগ ম্যাচে ডেড ওভার শুরুর আগেই তারা সাজঘরে। আরও একটা সমস্যা ভোগায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। যেহেতু তাদের পাওয়ার কম, তাই তারা কেউ কেউ আবার নিজের সাজানো গোছানো ব্যাটিং শৈলির চেয়ে ইম্প্রোভাইজ করে খেলতে চান বেশি। ভাবেন, সোজা ব্যাটে ফিল্ডারের নাগালের বাইরে গ্যাপে বল ঠেলে রান নেয়ার চেয়ে আমি স্কুপ- সুইপ খেলবো, তাহলে নিজের নামের পাশে রান জমা পড়বে বেশি। দলের স্কোরও বাড়বে। এ চিন্তাটাও বুমেরাং হচ্ছে।

এই ভুল পথের সবচেয়ে বড় যাত্রী হলেন মুশফিকুর রহিম। তার ব্যাটিং টেকনিক পরিপাটি। শটস খেলার সামর্থ্যও আছে। ড্রাইভ, কাট, পুল, ফ্লিক বেশ ভালো খেলেন। এসব ক্রিকেটীয় শটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে, খেলতেও পারেন ভালো। তাই টেস্ট এবং ওয়ানডেতে মুশফিকই বাংলাদেশের সেরা ও সফল ব্যাটসম্যান। ঐ দুই ফরম্যাটে তার ব্যাটে রান আসে নিয়মিত। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে সেই মুশফিকের অযথা স্কুপ-সুইপ করার প্রবণতা। এবার আফগানিস্তানের সাথে প্র্যাকটিস ম্যাচ আর কাল প্রথম ম্যাচেও সুইপ খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন মুশফিক।

আগেই বলা হলো, পাওয়ার হিটার কম। মাঝে সাইফউদ্দীনকে দিয়ে চেষ্টা করানো হয়েছে। তিনি ব্যর্থ। আর কেউ নেই যে শেষ দিকে হাত খুলে খেলতে পারেন। সবেধন নীলমনি মাশরাফি ছিলেন। তার তাও কম বেশি মারার ক্ষমতা আছে। তিনিও টি-টোয়েন্টি দলে নেই। সাব্বিরের বিগ হিট নেবার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তার ধারাবাহিকতা নেই। আর সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার, সেই বিগ ইনিংস খেলার দৃঢ় সংকল্প আর সদিচ্ছায় কমতি প্রচুর। যে কারণে সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ফিনিশার হিসেবে সাব্বির এখনো নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।

এত গেল ব্যাটিং প্রসঙ্গ। বোলিংয়ের অবস্থা আরও খারাপ। বাড়তি গতি আর বিষাক্ত সুইং করাতে পারেন, এমন একজন ফাস্ট বোলারও নেই। তাসকিনের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তারও তেজ কমে গেছে। রুবেল মাঝে মধ্যে এক বা দুই ওভার ভাল বল করে পরক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলছেন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সাফল্যর জন্য যে সব অত্যাবশ্যকীয় গুণ ও উপদান দরকার, আর কারো মাঝেই তা নেই। সাদা বল নতুন অবস্থায় এমনিতেই সুইং করে। অথচ সেই সুইং করানোর বোলারের অভাব। আর ডেড ওভারে ইয়র্কার, লো ফুলটস এবং ওয়াইড ইয়র্কার ছোড়ার ক্ষমতা খুব কম।

একই অবস্থা স্পিনারদেরও। রশিদ খান আর মুজিবুর রহমানের মত টার্ন করাতে পারেন, এমন একজন স্পিনারও নেই। বিশ্বের সব দল টি-টোয়েন্টে ফরম্যাটে লেগস্পিনার দলে নিয়ে সফল হচ্ছে। আর সেখানে বাংলাদেশ এখনো সেই পুরোনো ছকে দুজন করে বাঁহাতি স্পিনার ফর্মুলায় চলছে। এক সময় তার কার্যকরিতা ছিল। কিন্তু এখন নেই। সাকিবের বলের ধারও গেছে কমে। বেশি খেলার কারনে তার সম্পর্কে প্রায় সবার জানা হয়ে গেছে। সাকিবের বোলিং কারিশমা তাই আগের মত আর চোখে পড়ে না। দলে আর একজন আন্তর্জাতিক মানের স্পিনার নেই। সীমিত বোলিং সামর্থ্য নিয়ে মিরাজ ও নাজমুল অপুরা তেমন প্রভাব ফেলতে পারছেন না।

তাই ব্যাটিংয়ের তুলনায় বোলিংয়ে দৈন্যদশা। আর সে কারণেই শুধু র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকাই নয়; মাঠেও আসঘর স্ট্যানিকজাই, মোহাম্মদ শাহজাদ, মোহাম্মদ নবী, নাজিবউল্লাহ জাদরান, সামিউল্লাহ শেনওয়ারি, রশিদ খান, শাপুর জাদরান আর মুজিবুর রহমানদের সামনে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির, রুবেল, অপুদের অনুজ্জ্বল মনে হচ্ছে।

আফগানদের আগ্রাসী-আক্রমণাত্মক অ্যাপ্রোচ ও ব্যাটিং- বোলিংয়ে কজন টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট এবং ভালোমানের পারফরমার থাকায় টাইগারদের পেরে উঠতেও কষ্ট হচ্ছে।

_________

patheo24/105

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *