রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রভুবন্দনা

রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রভুবন্দনা

  •  তামীম আব্দুল্লাহ 

আধুনিক বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রতিভাবান শিল্পী এবং বাংলা কাব্যের অনিন্দ্য ও নান্দনিক ছন্দের রূপকার বাংলা ভাষা শব্দের অমর কৃর্তিমান মহাপুরুষ, বাংলা কবিতার মহান বরপুত্র; বাংলা বাঙালির অতিব একান্তে বিশ্বাসে বোধে চেতনার আত্মার আত্মীয় এবং বাংলার বিশ্বাল বৈচিত্র্যময় সাহিত্যাকাশে দীপ্তমান নক্ষত্রের নাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মানুষের কবি জীবনের কবি রবীন্দ্রনাথ বাংলাসাহিত্যে বাংলা কাব্যে একজন প্রকৃতার্থে অতীব যোগ্য পথিকৃত। আর এই জন্য আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ প্রাণের কবি, প্রেমের কবি, মানবতার কবি, প্রকৃতির কবি, গানের কবি, নদীর কবি, পাখির কবি এবং সর্বোপরী মানুষের ভালোবাসার প্রাণপুরুষ। কবি ও মানুষ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যপ্রিয় প্রকৃতিপ্রিয় সব মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।

আমরা তার রচনাসমূহের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাব যে, সেখানে তিনি মানুষ ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তার রচনাতে মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন, মানবতার ভিত্তি স্থাপন করেছেন এবং সব শ্রেণির মানুষকে বিশেষ করে সাধারণ মানুষের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। তিনি মানুষকে বিভিন্নভাবে দেখেছেন এবং বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছেন। এক কথায় মানুষকে উপেক্ষা করে তিনি কোনো সাহিত্য রচনা করেননি। তার বৈচিত্র্যময় রচনার প্রধান কেন্দ্রই হলো মানুষকে নিয়ে। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ তিনি তার অঢেল রচনার মাধ্যমে মানুষের পাশাপাশি বাংলা ভাষা বাংলাসাহিত্য বাংলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন। মূলত তিনি সাহিত্যচর্চা করেননি, করেছেন মনে-প্রাণে সাহিত্য সাধনা। সাধারণ মানুষকে করেছেন লেখার প্রধান বিষয়। রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ পাঠ করলে সাধারণ মানুষের কথায় আমাদের সামনে দিবালোকের মতো ষ্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তাই এই সুন্দর পৃথিবীতে যতদিন রবে সূর্য চন্দ্র তারা আর পাখি গাইবে গান নদী বইবে ধারা ততদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ অতি উজ্জ্বল আলো হয়ে সাহিত্য ও মানুষের মাঝে জ্ঞানের ছন্দের রূপ ও রসের গন্ধের আলো ছড়াবে।

কবিগুরুর সাহিত্য-সঙ্গীতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয় এবং যথার্থই বলা হয় যে, তিনি একজন গীতি কবি, মরমী কবি, প্রকৃতি প্রেমিক কবি, আধ্যাত্মিক কবি এবং সার্বজনীন কবি। কবিগুরু রবি ঠাকুর ও বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্রবসুর ১২০ তম বন্ধুত্ববার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৮ সালে একটি অনুষ্ঠানে তার ব্যাপারে বিশ্লেষণী পাঠ করা হয় কিছু বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্র চিন্তাধারার। সেখানে আলোচনায় একটা লক্ষ করা যায় যে তার উচ্চমার্গীয় চেতনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্ক হলেও আদতে তিনি ছিলেন ইশ্বরপন্থী। হিন্দু ধর্মের আজ্ঞা পালনকারী। ইশ্বরের প্রতি তার অগাধ ভক্তি ও পরম আরাধনা ও নিমগ্ন চিত্তে তাকে অনুবাধনের যে মননশক্তি জোগারের প্রয়োজন তা তিনি করতেন। সেই শক্তির প্রতিফলনও হয়েছে তার সমস্ত গীতি-কবিতায়।

যেমন— 
স্রষ্টার প্রতি তার প্রার্থনা— আরো আলো, আরো আলো/ এই নয়নে, প্রভু, ঢালো । বিজ্ঞানের সংশ্লেষ নেই যদিও, তবু প্রসঙ্গক্রমে বলি, এই গানেরই এক পর্যায়ে তিনি বলছেন— আরো বেদনা, আরো বেদনা/ প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা । অর্থাৎ বেদনার ভারে ও চাপে তিনি নুয়ে পড়েন নি, হতোদ্যম হয়ে যেতে চান নি, বরং এই বেদনার মধ্য দিয়েই আরো গভীরতর চেতনা লাভ করার বাসনা জানিয়েছেন স্রষ্টার কাছে।

যা-ই হোক, এরপর যে গানটির কথা বলছি, সেখানে রবীন্দ্রনাথ যেন অবতীর্ণ হয়েছেন দ্রষ্টার ভূমিকায়। যে মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল (Big Bang), তার জীবদ্দশায় এ তত্ত্ব প্রমাণিতই হয় নি। বিগ ব্যাং থিয়োরি অনুসারে, প্রায় ১৫০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সব পদার্থ ও শক্তি ঘনীভূত ছিল একটিমাত্র বিন্দুতে, যা থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সূচনা ঘটে এই বিপুল সৃষ্টিজগতের। মহাবিস্ফোরণের পর পরই শুরু হয় বিকিরণ। ভর ও শক্তির সমতূল্যতার সূত্র অনুসারে সেই বিকিরণ রূপান্তরিত হয় পদার্থে। বিস্ফোরণের ১০-৪৩ সেকেন্ড পর অর্থাৎ একের (১) পিঠে ৪৩টা শূন্য বসিয়ে যে সংখ্যা হয়, এক সেকেন্ডকে তা দিয়ে ভাগ করলে যে সময়টা পাওয়া যায় (যা অকল্পনীয় এবং যাকে বলা হয় Planck’s Time), তার আগের কোনো ঘটনাই বিজ্ঞানীদের পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি। ফলে মহাবিস্ফোরণের মূল কারণ বিজ্ঞানীদের কাছে আজও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। তবে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন, তারা বলেন, এ-কাজ কেবল স্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব। আর রবীন্দ্রনাথের একটি গানে এ বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটেছে। গানের কথাগুলো হচ্ছে:

প্রথম আদি তব শক্তি—আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে গগনে গগনে॥ তোমার আদি বাণী বহিছে তব আনন্দ, জাগিছে নব নব রসে হৃদয়ে মনে॥তোমার চিদাকাশে ভাতে সূরয চন্দ্র তারা,প্রাণতরঙ্গ উঠে পবনে। তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে,মন্ত্র তোমার মন্দ্রিত সব ভুবনে॥

এ গানে কবি তার বিশ্বাসেরই স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, সৃষ্টির প্রথম শক্তি বিধাতারই, গগনে গগনে পরমোজ্জ্বল জ্যোতি একমাত্র তাঁরই। বিশ্বসৃষ্টি এক মহাকাব্য এবং স্রষ্টাই এর রচয়িতা। তিনিই এর আদি কবি এবং মহাগুরু। কবি তার কল্পনা দিয়ে এখানে যেভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা বলেছেন, তা তার অনন্য সৃজনশীলতারই নিদর্শন।

রবীন্দ্রনাথের ধ্যান ও প্রভুবন্দনা 

যে ধ্যানে রবীন্দ্রনাথ জীবনব্যাপী মগ্ন ছিলেন, প্রকৃতি ও স্রষ্টাপ্রেমই তার মূল উপজীব্য। প্রকৃতির কথা তো জানে জনে জনে। তবে তার প্রভুবন্দনা জীবনের কথা ক’জনেই জানে, ক’জনেই বা বলে!

স্রষ্টাপ্রেমের পরিচয়ও মেলে তার কবিতায় ও গানে। গীতাঞ্জলি তার প্রভুবন্দনার এক অসাধারণ রূপ। এ অনবদ্য সাহিত্যকর্মের জন্যেই তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

প্রকৃতিকে নিয়ে যে কবিগুরুর আরাধনা, উদ্ভিদ নিয়ে যে গীত তিনি রচনা করেছেন তার জুড়ি নেই। এক জাগায় তিনি বলছেন, ‘ঐ গাছগুলো বিশ্ববাউলের একতারা, ওদের মজ্জায় মজ্জায় সরল সুরের কাঁপন, ওদের ডালে ডালে পাতায় পাতায় একতালা ছন্দের নাচন। যদি নিস্তব্ধ হয়ে প্রাণ দিয়ে শুনি তা হলে অন্তরের মধ্যে মুক্তির বাণী এসে লাগে।’

এ যে শুধু ভাবের কথা তা নয়। এর মাঝেই ধরা পড়েছে বৃক্ষমালার নীরব লীলা বোঝার প্রয়াস, যা আরো মূর্ত হয়ে ওঠে তার বনবাণী কাব্যগ্রন্থের বৃক্ষবন্দনা কবিতায়—

অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-’পরে; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।

আলো সাত রংয়ের বর্ণালি। এর প্রতিটি রংয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা। বৃক্ষের ওপর যখন সৌরশক্তি এসে পড়ে তখন সালোক-সংশ্লেষণের জন্যে সে আলোর সবগুলো তরঙ্গ ব্যবহার করে না, কিছু বাদ দিয়ে করে। অর্থাৎ আলোর মধ্যে কী লুকিয়ে আছে বৃক্ষ তার খবর রাখে। এর কতটুকু তাকে নিতে হবে, তা-ও সে জানে, যদিও বৃক্ষের এই আলোকতরঙ্গ বাছাইয়ের খবর বিজ্ঞানীকে বুঝতে হয়েছে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু গাছকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন :

সুন্দরের প্রাণমূর্তিখানি
মৃত্তিকার মর্তপটে দিলে তুমি প্রথম বাখানি
টানিয়া আপন প্রাণে রূপশক্তি সূর্যালোক হতে,
আলোকের গুপ্তধন বর্ণে বর্ণে বর্ণিলে আলোতে।

রবীন্দ্রনাথ বৃক্ষের এই গোপন কথা জেনেছিলেন বোধ করি তার গভীর ‘ধ্যানবল’-এর মাধ্যমে। একই কবিতায় তাই তিনি বলছেন :

ধ্যানবলে তোমার মাঝার
গেছি আমি, জেনেছি, সূর্যের বক্ষে জ্বলে বহ্নিরূপে
সৃষ্টি যজ্ঞে যেই হোম, তোমার সত্তায় চুপে চুপে
ধরে তাই শ্যামস্নিগ্ধরূপ, ওগো সূর্যরশ্মিপায়ী,
শত শত শতাব্দীর দিনধেনু দুহিয়া সদাই
যে তেজে ভরিলে মজ্জা, মানবেরে তাই করি দান
করেছ জগৎজয়ী; দিলে তারে পরম সম্মান;

এই চরণ ক’টিতে কবি তার ভাষায় প্রকাশ করেছেন বৃক্ষ কী করে সূর্যশক্তিকে আটকে রেখেছে তার দেহের স্তরে স্তরে। প্রায় শতাব্দীকাল আগে রবীন্দ্রনাথ সূর্যরশ্মিপায়ী বৃক্ষমজ্জাতে যে তেজের কথা লিখেছিলেন, তা আজকের জ্বালানি-সংকট কবলিত বিশ্ব কিন্তু নতুন করে সেই তেজের কথাই বলতে শুরু করেছে!

বৃক্ষের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ‘ধ্যানবল’-এর কথা লিখেছেন, সুফিদের ভাষায় তাকেই বলা যেতে পারে ‘কাশ্ফ’, যার মাধ্যমে সুফি কবিরা কিছু সত্য উপলব্ধিতে পৌঁছান। বিজ্ঞানীরা একই সত্যে উপনীত হন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে।

সুফিদের কথায় এটাও আলোচনায় মুখ্য হয়ে দাড়ায় যে কবিগুরুদের বাড়িতে একসময় পর্যন্ত সুফীদের আনাগোনা ও জমকালো আসরের ব্যবস্থাপনা হতো। এমনকি সুফী মনোভাবের প্রস্ফুটিত হাওয়া কবিগুরুর সাহিত্যে মিশ্রিত।

এখানে উল্লেখ্য, কবি শেখ সাদীও বোধ করি ‘ধ্যানবল’-এর মাধ্যমে বৃক্ষের গোপন কথা জেনেছিলেন : বার্গে দরখতখানে সব্জ/ দার নাজায়ে হোঁশিয়ার/ হার ওরাকে দাফতারিস্ত/ মারাফাতে কারদেগার ..। যার বাংলা মর্মার্থ দাঁড়ায় হুশিয়ার অর্থাৎ সচেতন ব্যক্তির দৃষ্টি যদি সবুজ বৃক্ষের ওপর পড়ে তবে সে এর প্রতিটি পাতায় দেখতে পাবে একটি দফতর, যার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে কারিগরের সুপ্তজ্ঞান। সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া আসলেই স্রষ্টার সংবৃত জ্ঞানের এক উদাহরণ। যা বিজ্ঞানীরা আজও পুরোপুরি জেনে উঠতে পারি নি।

প্রভুকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের প্রেমময় ধ্যানের কথা আছে সে বড় বিস্ময়তুল্য। এ ধ্যানের কোনো তুলনা নেই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বুঝতে চেষ্টা করেছেন স্রষ্টার মাহাত্ম্য। আর এ নিয়ে যা তিনি উপলব্ধি করেছেন, তা প্রকাশ করেছেন তার বহু কবিতায়, গানে। তেমনি একটি লেখার কথা হলো:

সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে।
তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুখজালা সেই পাশরে
সব দুখজ্বালা সেই পাশরে॥
তোমার জ্ঞানে তোমার ধ্যানে তব নামে কত মাধুরী
যেই ভকত সেই জানে,
তুমি জানাও যারে সেই জানে।
ওহে, তুমি জানাও যারে সেই জানে।

প্রভুর ধ্যানে যে মাধুরী। তাই প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গানে ও গীতাঞ্জলিতে স্রষ্টাবন্দনায়। এখানে পরম স্রষ্টাকে পাওয়ার আকুতি থেকে একদিকে তিনি নিজের ঘর আবিষ্কার করার কথা বলেছেন, অন্যদিকে তার সকল অহংকার বিনাশের কথা বলেছেন। নিজের ঘরের কথাটাই প্রথমে বলি। তিনি গাইছেন : যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে/ এই নিরালায় রব আপন কোণে/ ..আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে/ আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে..।

এই ঘর ধোয়া-মোছাটাই কিন্তু ধ্যানের একটি বড় কাজ। মেডিটেশনে আমাদের যে মনের বাড়িতে প্রবেশ করতে বলা হয়, সেটা আত্ম উপলব্ধির ঘর। নিজেকে চেনার, জানার ও ফিরে পাওয়ার ঘর। এমন ঘর তৈরি করে সারাজীবন কবি অপেক্ষায় ছিলেন পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের।

সেইসাথে নিজের সকল অহংকারকে দূর করার সাধনা করেছেন তিনি প্রতিনিয়ত। স্রষ্টার কাছে তিনি মিনতি করেছেন এই বলে— আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।/ সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥/ নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান/ আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া/ ঘুরে মরি পলে পলে।

গীতাঞ্জলির আরেকটি গীতে কবি গাইছেন : নামাও নামাও আমায় তোমার/ চরণতলে,/ গলাও হে মন, ভাসাও জীবন/ নয়নজলে।/ একা আমি অহংকারের/ উচ্চ অচলে,/ পাষাণ-আসন ধুলায় লুটাও,/ ভাঙ্গো সবলে।/ নামাও নামাও আমায় তোমার/ চরনতলে।/ কী লয়ে বা গর্ব করি/ ব্যর্থ জীবনে।/ ভরা গৃহে শূন্য আমি/ তোমা বিহনে।/ দিনের কর্ম ডুবেছে মোর/ আপন অতলে/ সন্ধ্যাবেলার পূজা যেন/ যায় না বিফলে।/ নামাও নামাও আমায় তোমার/ চরনতলে।

গর্ব করার মতো কতকিছুই না কবির ছিল, তা আমরা জানি। তাই কবি যে কথাগুলো বলেছেন তা কেবল তার বিনয়ের কথা। কারণ, বিনয় ছাড়া বন্দনা হতে পারে না। আমরা যখন মনের ঘরে ঢুকতে যাই তখন এই বিনয় অর্থাৎ নিরহংকারের সাথেই ঢুুকতে হবে। তাহলেই আমরা প্রকৃত অর্থে ধ্যানমগ্ন হওয়া সম্ভবপর।

স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুণ্য। সৃষ্টিজগতে বিরাজমান অনবদ্য ঐকতান ও সিম্ফনি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা উপলব্ধি করেছেন, তা তিনি বিপুল সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। নানা সুরে ও বিনম্র্র ভঙ্গিতে।

১৯১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের (Song Offerings) দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন বিশ শতকের প্রখ্যাত আইরিশ কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েটস। ওখানে তিনি বলেন,

‘এখানে পথিক গেরুয়া বসন পরিধান করে গায়ে ধুলো লাগলে বোঝা যাবে না বলে, যুবতী তার শয্যায় তার প্রেমিক রাজপুত্রের মালা থেকে খসে পড়া পাপড়ি খোঁজে, ভৃত্য বা বধূশূন্য গৃহে প্রভুর প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা করে, এসবই প্রভুর দিকে ধাবমান হৃদয়ের প্রতীক। ফুল আর নদী, শঙ্খধ্বনি, ভারতীয় ঘন বর্ষা অথবা তপ্ত নিদাঘ, এগুলোও মিলন বা বিরহের বিভিন্ন মেজাজের প্রতিচ্ছবি; আর নৌকোর ওপর বসে যে ব্যক্তিটি বাঁশি বাজান রহস্যময়, অর্থব্যঞ্জক চীনা চিত্রপটের মতো, তিনি স্বয়ং প্রভু।’

এভাবেই হৃদয়-নিঃসৃত নন্দিত সাহিত্যবাণী দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্রষ্টার দিকে চিরধাবমান, যার অনন্য সাহিত্যরূপ এই গীতাঞ্জলি। ইসলামিক পরিভাষায় প্রভুবন্দনাকে অভিহিত করা হয় ‘হামদ’ নামে। গীতাঞ্জলির এই ‘হামদ’-ই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্ববাসীর মন কেড়েছে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে। কবি এতে যা রচনা করেছেন, তা হলো ইশ্বরের প্রতি এক সমর্পিত বান্দার হৃদয়ের নৈবেদ্য।

তাই রবীন্দ্রনাথকে আমরা যেন দেখি সামগ্রিকরূপে, খণ্ডিতরূপে নয়। এভাবেই তার বিজ্ঞান চেতনা, সার্বজনীন প্রেম এবং তার ধ্যান, সুফীসাধনা ও প্রভুবন্দনা থেকে জীবন-জগৎ সম্বন্ধে একটি পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা সম্ভব। আজকের এই শশব্যস্ত কোলাহলময় জীবনে প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্যে হলেও যদি বিনয় ও দীনতার সাথে ধ্যানমগ্ন হয়ে আমরা এই সমগ্র সৃষ্টির অপা করুণাময় প্রভুর করুণাকে অনুভব করতে পারি, সকল প্রাপ্তির জন্যে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর বন্দনা হৃদয় থেকে করতে পারি, তাঁকে ধ্যানে ধ্যানে জপতে পারি তবেই খোদাকে আমরা পাব আমাদের সকল ভালো কাজের সঙ্গী ও দিশারী হিসেবে এবং সেটাই আমাদের জীবনের সর্বোত্তম পাওয়া।

 

লেখক,সাংবাদিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *