‘রায়হান, জামাল ভাই মারা গেছেন’

‘রায়হান, জামাল ভাই মারা গেছেন’

  • আশরাফ উদ্দীন রায়হান

১০ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত ৫টা ১০ মিনিট। ঢাকার মিরপুর-১৪ নম্বরে বড়বোনের বাসায় ঘুমিয়েছিলাম। পাশেই বিখ্যাত জামেউল উলূম মাদরাসা। সেই মাদরাসা-মসজিদে ফজরের জামাত ৬টা ৫ মিনিটে। ঘুমের আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠার আগ মুহূর্তে আচমকা ফোনটা বেজে ওঠলো! শেষ রাতের এই মুহূর্তে এর আগে কখনো ফোন পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বুকটা ধক্ করে ওঠলো! ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি বড়ভাই কল দিয়েছেন। দুরুদুরু ভয়ার্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভাইয়ের শুকনো কণ্ঠে ভেসে এলো—‘রায়হান, জামাল ভাই মারা গেছেন।’

কথাটা শোনামাত্রই সারাটা দেহ অবশের মতো হয়ে গেল। আমি কী বলব না বলব অথবা আমার কী বলা উচিৎ—কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। কিছুক্ষণের জন্য আমার সম্বিৎ লোপ পেয়ে গিয়েছিল। ভাবতেই পারছি না, আমাদের সবার প্রিয় (বিশেষত, আমার খুব একান্তজন) জামাল ভাই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে ফেলেছেন!

এমন এক সময়ে জানাযা ঠিক হয়েছিল যে, ঢাকা থেকে জানাযায় শরিক হতে পারা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। নিরুপায় হয়ে ভাইয়ের রূহে ইসালে সওয়াব পেশ করলাম। তারপর দুআয় রব্বে কারীমের দরবারে ভাইয়ের জন্য কাতরকণ্ঠে অনেককিছুই বলেছিলাম। আমার দু চোখ বেয়ে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলো! ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’—এ কথা মনে করে নিজেকে সংবরণ করার বৃথা চেষ্টা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

আমার চোখে ভাইকে নিয়ে তখন কত শত ঘটনা আর স্মৃৃতি ভেসে ওঠছিল। ভাই ছিলেন আমাদের সবচেয়ে নিকটের প্রতিবেশী। আমরা উভয় পরিবারই সবসময় সদ্ভাব বজায় রেখে চলাফেরার চেষ্টা করেছি। আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় এধার-ওধার হলেও ভাইয়ের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো কুতাহি আমার নজরে পড়েনি কখনো। এক কথায় ‘ভালো মানুষ’ যাকে বলে ভাইকে তেমনটিই দেখেছি।

আমাদের বেলংকা মুন্সীবাড়ি মসজিদের দীর্ঘ দিনের ইমাম ও খতীব ছিলেন তিনি। তাঁর আগে তাঁর বাবাও ছিলেন এই ইজ্জত ও সম্মানিত আসনে। তাঁর শতবছর আয়ু-পাওয়া বাবা মরহুম ছামিদ মাস্টার (রহ.) ছিলেন আমাদের মুরুব্বিদেরও মুরুব্বি। তাঁর অবিসংবাদিত সুনামের কথা এখনো প্রবীণ ও মুরুব্বিদের মুখে মুখে আমরা শুনতে পাই। তাঁর তাকওয়া তথা বুযুর্গীর ঘটনাবলি সর্বজনস্বীকৃত বিষয় ছিল।

আমার সৌভাগ্য যে, এমন বুযুর্গ একজন মানুষকে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল যে, যখন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমি তখন তাঁর একেবারে শিয়রের পাশেই ছিলাম—উনার ছোট্ট নাতী মরিয়মকে যথারীতি পড়াচ্ছিলাম।

বাবার কল্যাণে জামাল ভাইয়ের আলাদা একটা শান ও মান ছিল সমাজে। আমাদের এমন অনেক সময় ও মুহূর্ত পার হয়েছে দুজন একসাথে কথা বলেছি। বিশেষত, পা কাটানোর পরের সময়গুলোতে জামাল ভাইয়ের জীবনে একাকীত্বটা একটু বেড়ে যায়। আমি বাড়িতে থাকার সময় চেষ্টা করেছি উনাকে সময় দেওয়ার। পাশাপাশি চেয়ারে বসে কত আলাপই না আমরা দুজন মিলে করেছি।

আমাদের একান্ত সুহৃদ ও প্রিয় মানুষ মুফতী মিজানুল হক নাঈম ভাই যখন মরিয়মের সম্বন্ধ নিয়ে আমার কাছে ব্যক্ত করেন, তখন তাৎক্ষণিক আমি বিষয়টা জামাল ভাইকে জানাই। পাত্র সম্পর্কে সবিস্তারে তাঁকে ওয়াকিবহাল করলে উনি জামাতা হিসেবে নাঈম ভাইকে ‘না দেখেই’ যেন পছন্দ করে নিয়েছিলেন।

শিশুকালে পাড়ার অন্য সব ছেলেমেয়ের সাথে আমিও মুন্সীবাড়ি মসজিদে গিয়ে মক্তব পড়তাম। আজকের যে সুরম্য মসজিদ হয়েছে সেটি তখনো হয়নি। তবে যেটি ছিল সেটি ছিল ঐতিহাসিক ও বেশ পুরোনো মসজিদ। কথিত আছে যে, মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল সে মসজিদটি। জামাল ভাই তখন পড়াতেন আমাদেরকে। আমরা যারা নূরানী কায়দা এবং আমপারা পড়তাম তাদেরকে তিনি বসাতেন একেবারে পেছনের ফ্লোরটিতে। এর ওপরে ছিল খোলা আকাশ। আর কুরআন শরীফ থেকে যারা সবক দিতো তাদেরকে বসাতেন মসজিদের ভেতরের অংশটিতে।

২০১৫ সাল পর্যন্ত আমি বাড়িতেই ছিলাম। সে সুবাদে ওয়াক্তিয়া নামাজ পড়তাম আমাদের বেলংকার মুন্সীবাড়ি জামে মসজিদেই। সে সময়টাতে জামাল ভাইকে ‘ইমাম সাহেব’ হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। আজানের আগে উনাকে খুব কমই বাড়িতে থাকতে দেখেছি। থাকলেও আজান শোনামাত্রই মসজিদে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যেতেন। নজরকে নিচের দিকে রেখে দ্রুত হেঁটে মসজিদে যেতেন। মসজিদের কামরায় থাকার সময়টা কুরআন তিলাওয়াত আর কিতাবাদি পড়ে কাটাতেন। বিশেষত, ফজরের জামাত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো সময়টা কুরআন তিলাওয়াতে নিমগ্ন থেকেই পার করতেন। ইমামতিতে সুরেলাকণ্ঠে তিলাওয়াত করতেন।

ইলমী দিকে জামাল ভাইয়ের বেশ ভালো দখল ছিল। দেশসেরা মাদরাসা চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেছিলেন। সে সময়কার অনেক স্মৃতিকাতর ঘটনা আমাকে শোনাতেন তিনি। বিশেষত, তাঁর বুখারীর উস্তাদ সদ্য প্রয়াত শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ আহমাদ শফী (রহ.) সম্পর্কে খুব শ্রদ্ধা ও ভক্তিভরে আমাকে স্মরণীয় কথাগুলো স্মৃতিচারণ করে বলতেন। আরেক বুযুর্গ উস্তাদ আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)-এর ব্যাপারেও স্মৃতিঘন আলাপ করতেন। বছর দশেক আগে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে বাবুনগরী সাহেবকে ট্রেনের টিকিট ইনতিজাম করে দেওয়ার সেই আবেগঘন স্মৃতিচারণা করতেন খুব দিলখোশভাবে।

আমাদের বেলংকার ইসলাহী ইজতেমার রাতগুলোতে তাহাজ্জুদের সময় মঞ্চে ওঠে সামিয়ানার নিচে ঘুমন্ত মানুষদেরকে মাইকে এলান দিয়ে সজাগ করতেন তিনি।

তাহাজ্জুদের নামাজে ছিলেন খুবই নিয়মিত। এ ব্যাপারে আমার জানাশোনার কমতি না থাকলেও তাঁর জামাতা মুফতী মিজানুল হক নাঈমের স্মৃতিচারণ এ রকম যে, ‘রাত তিনটার পরে শ্বশুর আব্বাকে কখনোই ঘুমিয়ে থাকতে দেখিনি। তিনি অযু-ইস্তেঞ্জা থেকে ফারেগ হয়ে আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা‘আলার দরবারে নিজেকে সঁপে দিতেন নিবেদিত হয়ে। মুরাকাবা-ধ্যানমগ্ন নামাজ শেষে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন। দরূদ শরীফের ওয়াজীফা ও শের (উর্দু-ফারসি আধ্যাত্মিক কবিতার পঙক্তিমালা) উচ্চারণ শেষে লম্বা মুনাজাত করতেন। মুনাজাতে তিনি অবুঝ শিশুর মতোই হাউমাউ করে কাঁদতেন।’ আমাদের বেলংকার ইসলাহী ইজতেমার রাতগুলোতে তাহাজ্জুদের সময় মঞ্চে ওঠে সামিয়ানার নিচে ঘুমন্ত মানুষদেরকে মাইকে এলান দিয়ে সজাগ করতেন তিনি।

কত সুখকর ঘটনা আর স্মৃতিমেদুর কথা মনে পড়ছে আজ। ভেজা চোখে বিক্ষিপ্ত মনে আর লিখব না আজ! আল্লাহ তা‘আলা ইমাম সাহেবকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন, আমীন।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *