রোহিঙ্গা ইস্যুতে ওআইসি ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ওআইসি ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুথিডাং শহরে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও সম্পত্তি ধ্বংসের সাম্প্রতিক খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।


মঙ্গলবার ওআইসি জেনারেল সেক্রেটারির অফিস থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ওআইসি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য সঙ্ঘাতে জড়িত সব পক্ষের, বিশেষ করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও আরাকান সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীলদের প্রতি জোরদার আহ্বান জানায় এবং অবিলম্বে নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার ও রোহিঙ্গা জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের নির্দেশিত অস্থায়ী ব্যবস্থাগুলোর সম্পূর্ণ সম্মতির আহ্বান জানায়।


ওআইসির জেনারেল সেক্রেটারির অফিস রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতা ও নৃশংসতার ধারাবাহিক ঘটনার অবসান এবং তাদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।


মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ার কারণে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গলবার এ কথা জানিয়ে বলেছে, ‘রাখাইনের সহিংসতা নৃশংসতার দিকে চলে যেতে পারে।’ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর রাখাইন অধ্যুষিত শহরগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়া এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ সব বাসিন্দার বাস্তুচ্যুত করার খবর উদ্ধৃত করে এ কথা বলেছে।


গত নভেম্বরে আরাকান আর্মি (এএ) দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করার পর থেকে রাখাইনে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, যা ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর করা যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার প্রধানও সপ্তাহান্তে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই রকম সতর্কতা জারি করে বলেছেন, জাতিগত রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা চলছে এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এই উত্তেজনাকে আরো প্ররোচিত করছে।


মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রাখাইন রাজ্যে এবং সারা মিয়ানমারে আন্তঃসাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর ইতিহাস ছাড়াও রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অন্যান্য অপরাধের ঘটনা বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মারাত্মক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘বর্তমান বর্ধিত সহিংসতা ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরো নৃশংস ঘটনা ঘটার ঝুঁকি বাড়িয়েছে।’


মিয়ানমারের সামরিক শাসক ও সব সশস্ত্রগোষ্ঠীকে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা ও নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহয়তার অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মিলার। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলের বেশ কয়েকটি সশস্ত্র জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে একটি, যারা ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে স্বায়ত্তশাসন এবং লাভজনক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে সামরিক বাহিনীর সাথে লড়াই করেছে।


আরাকান আর্মি ২০১৯ সালে সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়ায় এবং সেই সংঘর্ষে প্রায় দুই লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেনাবাহিনী ২০১৭ সালে সেখানে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করে, যা এখন জাতিসঙ্ঘের গণহত্যা আদালতের মামলার বিষয়।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উৎখাতে নেমেছে আরাকান আর্মি


কক্সবাজার অফিস থেকে গোলাম আজম খান জানান, এবার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উৎখাতে নেমেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। আর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আগমন ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তার সেনাদের সাথে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির তুমুল লড়াই চলছে। দু’পক্ষের এ যুদ্ধ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের কবলে পড়ে ফের পালাচ্ছেন সেখানকার রোহিঙ্গা বাসিন্দারা।


২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর হত্যা-নিপীড়নের মুখে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তবে এবার রাখাইন রাজ্যে নিপীড়ন চালাচ্ছে এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মিরা। বুথিডং ফুমালি নামে একটি রোহিঙ্গা গ্রামে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মধ্যে গতকাল দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বহু রোহিঙ্গা হতাহত হয়েছে। অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটছে।


এপারের রোহিঙ্গাদের সূত্র মতে, রাখাইনের বুথিডং শহরজুড়ে ব্যাপক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তারা অগ্নিসংযোগের জন্য আরাকান আর্মিকে অভিযুক্ত করেছেন। আরাকান আর্মি বুথিডং দখল করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছে। আগুনে ঘরবাড়ি হারা রোহিঙ্গাদের কোনো আশ্রয়কেন্দ্র, সরকারি ভবন, হাসপাতাল বা স্কুলভবনে আশ্রয় নিতে দিচ্ছে না আরাকান আর্মি। এর আগে ১৮ মে’র মধ্যে বুথিডং ছেড়ে রোহিঙ্গাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য আলটিমেটাম দিয়েছিল। তাদের আলটিমেটাম শেষ হওয়ায় বুথিডং এলাকার আরাকান আর্মির যোদ্ধারা স্থানীয়দের বাড়িঘর থেকে বের করে দিয়ে আগুন দিয়েছে।


স্থানীয় রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়া একটি স্কুল ও হাসপাতালেও আগুন দেয়া হয়েছে। এতে কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। এর আগে ৩ মার্চ থেকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সাথে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে প্রাণ বাঁচাতে কয়েক দফায় সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য নাফ নদ ও নাইক্ষ্যংছড়ি স্থলসীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেন। এত দিন তাদের বিজিবির হেফাজতে নাইক্ষ্যংছড়ির একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছিল। পরে সেনা ও বিজিপি সদস্যকে জাহাজে করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।


রাখাইনে দু’পক্ষের তুমুল লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বান্দরবান সীমান্ত এলাকা থেকে বিজিবির একটি অংশকে কক্সবাজার জেলার মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো: মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সীমান্তে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কোনো ধরনের সুযোগ নেই।


বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধ শুরু আরাকান আর্মির : এ দিকে আরাকান আর্মি মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উত্তর-পশ্চিম রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে বড় আকারের হামলা চালিয়েছে। শহরের উপকণ্ঠে দু’টি বর্ডার গার্ড পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হামলার মাধ্যমে এটি শুরু হয়। দ্য ইরাবতী জানায়, গত সপ্তাহের শেষ দিকে জাতিগত সেনাবাহিনী বুথিডাং শহর দখলের পর এ হামলা চালানো হয়। দু’টি শহরই বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে উত্তর-পূর্ব রাখাইনে অবস্থিত। এই এলাকায় বসবাসকারীরা মূলত রোহিঙ্গা।
আরাকান আর্মি (এএ) সৈন্যরা বিভিন্ন দিক থেকে মংডুতে অগ্রসর হয়েছে এবং শহরটিকে ঘিরে রেখেছে বলে জানিয়েছেন একজন সামরিক বিশ্লেষক।

তিনি বলেন, এএ সৈন্যরা মংডুতে প্রবেশ করতে পারবে দু’টি বর্ডার গার্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পরাজিত হওয়ার পর ব্যাটালিয়ন নং ৪র্থ মাইল গ্রামে এবং ব্যাটালিয়ন নং ৫ মিথুগি ওয়ার্ডে। ব্যাটালিয়ন নং ৫ এর সদর দফতর মংডু শহরের প্রবেশপথের কাছে এবং শহরের পূর্বে বুথিডাং-মংডু রোডে নং ২ ব্যাটালিয়নের সংলগ্ন। ব্যাটালিয়ন নং ৪ এর সদর দফতর মংডু শহরের প্রায় ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি বড় ঘাঁটি। ইরাবতীতে একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল থুরেইন তুন, ১৫তম সামরিক অপারেশন কমান্ডের কমান্ডার, ৪নং ব্যাটালিয়নের দায়িত্বে আছেন।


মঙ্গলবার জান্তা সেনাদের প্রাক-ভোরের বিমান হামলায় ৪নং ব্যাটালিয়নের সদর দফতরের কাছে তিনটি গ্রামে অন্তত একজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। মংডুর একজন বাসিন্দা বলেছেন, ‘তিনটি জান্তা জেট মঙ্গলবার ভোর ৩টার দিকে তিনটি গ্রামে বোমা বর্ষণ করে… শবে বাহো গ্রামে আশ্রয় নেয়া এক ২৩ বছর বয়সী বাস্তুচ্যুত মহিলা তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন। আরো কয়েকজন আহত হয়েছে কারণ তাদের কাছে বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে পালানোর সময় ছিল না।’


অন্তত পাঁচজন বেসামরিক লোক গুরুতর আহত হয়েছে এবং বাওধিকোণ গ্রামে বাড়িঘরে বোমা হামলা হয়েছে। এএ সৈন্যরাও বুথিডাং থেকে পালিয়ে আসা জান্তা সৈন্যদের তাড়া করছে। আরাকান আর্মি ১৮ মে বুথিদাংয়ের নিয়ন্ত্রণ দখল করে। আরাকান আর্মি যদি মংডু দখল করতে পারে, তবে উত্তর রাখাইনের শুধু একটি শহরই সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে : সেটি হলো রাজ্যের রাজধানী সিত্বইয়ে।


সিত্বইয়ের অনেক বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছেড়েছেন। সরকারের সামরিক বাহিনী শহর অবরোধ করে রেখেছে, যার ফলে বাসিন্দাদের পালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। মংডু দখল করলে আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সাথে ২৭০ কিলোমিটার সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ পাবে। এএ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে, বুথিডাং, মংডু ও থান্ডওয়ে শহরের বেসামরিক নাগরিক এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে যুদ্ধের মাধ্যমে আটকা পড়া এড়াতে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এএ দক্ষিণ রাখাইনের থান্ডওয়ে এবং তাংআপের মধ্যে জান্তা অবস্থান এবং অ্যান টাউনশিপে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পশ্চিমি কমান্ডের কৌশলগত কমান্ড ঘাঁটিতেও আক্রমণ করছে।


সরকার নির্বিচারে আর্টিলারি এবং নৌ বোমাবর্ষণের মাধ্যমে আবাসিক এলাকাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার কারণে তাংগুপ এবং থান্ডওয়ে শহরগুলোর মধ্যে সংঘর্ষে বেসামরিক হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। ইরাবতীকে একজন সামরিক বিশ্লেষক বলেছেন : ‘এএ এখনো সিত্বইয়ে ও কিয়াউকফিউতে আক্রমণ করেনি, সম্ভবত কারণ তারা যদি সরকার ভারী নৌ আক্রমণের সাথে প্রতিক্রিয়া জানালে বেসামরিক হতাহত ও ধ্বংসের পরিমাণ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। যদি এএ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তারা প্রথমে সিত্বইয়েতে আক্রমণ করতে পারে।’


আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের অর্ধেকেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ৯টি শহর গত বছরের নভেম্বরে রাজ্যে জান্তা অবস্থানের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করার পর থেকে দখলে নিয়েছে এএ। চিন রাজ্যের প্রতিবেশী পালেতওয়া টাউনশিপেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি।

সূত্র:রয়টার্স

Related Articles