- আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
কেউ বলতে পারে এটা তো একটা নৈতিক বয়ান, নৈতিক বিধান। কিন্তু সকলেরই জানা থাকা দরকার, ইসলামে নৈতিক নির্দেশের মূল্য আইন থেকেও বহু উর্ধ্বে। আর এর উপরই বয়ে চলেছে মুসলিমের জীবন।
এখন যদি অধিকারের আলোচনায় আসি তবে বলতে হয়, ইসলাম নারীকে সর্বক্ষেত্রেই অধিকার দিয়েছে বেশি, আর পুরুষকে দায়িত্ব দিয়েছে বেশি। আজকের যুগে সমঅধিকার বলে নারীর উপর অন্যায় জুলুম চালানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অথচ তাদের তো অগ্রাধিকার প্রাপ্য।
প্রথমে মা। আমার মা থেকেই শুরু করি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক সাহাবী রা, জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার উপর কার অধিকার বেশি?’ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, ‘মা’র। আবার সাহাবী রা. একই কথা জানতে চাইলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, ‘লি উম্মিকা- তোমার মা’র’। সাহাবী রা. পুনর্বার জানতে চাইলেন একই বিষয়ে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘লি আবিকা-তোমার পিতার।’ এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মা’র অধিকার পিতার উপর ৩:১ অনুপাতে। এখানে পিতার চেয়েও মা অগ্রাধিকার রাখেন। সমঅধিকারের দাবীদাররা এবার কী করবেন?
কন্যা হিসাবে দেখা যাক। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যখন কিছু নিয়ে ঘরে আসবে তখন প্রথমে কন্যার হাতেই তুলে দিবে সে উপহার। এ ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে পুত্রের অগ্রেই অবস্থান করছে কন্যা। আমরা জানি মুসলিম সমাজে আহলে বায়াত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী বংশের শেষ্ঠত্বের মর্যাদা রাখে নিঃসন্দেহে, আর নবী বংশের ধারা তো কোন পুত্রের মাধ্যমে আসেনি। এসেছে নবী দুহিতা হযরত ফাতিমা রা.-এর মাধ্যমেই। সব পুরুষতান্ত্রিক বংশধারা এখানে এসে হেঁট হয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। কন্যাকে কি অধিকার স্থাপন করা হয়েছে তা বুঝতে কি আইনের কিতাব ঘাটতে হবে কারো? পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে পিতার দায় গ্রহণ করতে হয় তার সাবালক হওয়া পর্যন্ত। পক্ষান্তরে কন্যা সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা, ভরণ-পোষণসহ যাবতীয় দায়ভার গ্রহণ করতে হয় স্বেচ্ছায় সুসম্মতিতে তার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত। পিতা তার অসম্মতিতে কোথাও বিয়ে দিয়ে নিজে নিজে দায়মুক্ত হয়ে যাবে এই অধিকারও পিতাকে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রেও কন্যা অগ্রাধিকার সংরক্ষণ করে।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যখন কিছু নিয়ে ঘরে আসবে তখন প্রথমে কন্যার হাতেই তুলে দিবে সে উপহার’
এবার ভগ্নি সিবাবে দেখা যাক। যীরেহেম হিসাবে পিতার যাবতীয় দায়িত্ব ভ্রাতার উপরই আবশ্যকীয় হিসাবে আইনত বর্তায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো তাঁর এক দুগ্ধভগ্নির সম্মানার্থে তাঁর কওমের বিরাট সংখ্যক যুদ্ধ বন্দীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কোন নারীকে স্ত্রী হিসেবে দেখলে তো দেখা যায় ইসলামী আইনে সব অধিকার স্ত্রীর। শরীয়া আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, যৌন আহ্বানের অধিকার ছাড়া স্ত্রী থেকে আর কিছু নেই স্বামীর। একজন স্ত্রীকে কেবল তখনই নাশেযা বা অবাধ্যচারী হিসেবে বিচারের সম্মুখীন করা যাবে যখন ওজর ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর যৌন আহ্বানে সাড়া না দেয়। এক্ষেত্রেও অগ্রে মোহরানা প্রদান শর্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর নির্ধারিত মোহরানা আদায় না করা পর্যন্ত স্ত্রীর ওজর ছাড়াও স্বামীর আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তা ছাড়া খোরপোষ ও রক্ষণাবেক্ষণসহ যাবতীয় দায়িত্ব স্বামীকেই বহন করতে হবে। এমনকি স্ত্রী যদি ধনিও হয়, সে ক্ষেত্রেও স্ত্রীর ভরণপোষণ, লালন- পালন, শিক্ষা-দীক্ষা, রক্ষাণাবেক্ষণসহ যাবতীয় দায়িত্ব স্বামীর উপর ন্যাস্ত। মা তাঁর সন্তানকে দুগ্ধ দানেও বাধ্য নন। ক্ষেত্র বিশেষে এমনকি স্বীয় সন্তানকে দুগ্ধদানের বিনিময়ে সন্তানের পিতা থেকে ন্যায্য সম্মানীও দাবী করতে পারেন জন্মদায়ীনী মা।
সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা দান করা হয়েছে নারীকে ইসলামে। এই ক্ষেত্রে অনেক সময় নারী পুরুষদেরও অতিক্রম করে যেতে পারে। মুসলীম সমাজে হযরত খাদীজা রা., ফাতিমা রা., মারইয়াম আ., রহিমা এমন গুণবতী নারীদের সামাজিক মর্যাদা কত উচ্চে তা আমরা সকলেই জানি। কুরআন মাজীদে এক স্থানে হযরত মারআমের মা যখন কন্যা সন্তান প্রসব করায় আফসোস করছিলেন তখন এর জবাবে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, ‘লাইছায যাকারু কাল উনসা – পুরুষ, সে তো মর্যাদায় নারীর মত নয়।’
বিয়ের অধিকারের ক্ষেত্রে তো ইসলামী আইনে নারী সম্পূর্ণ স্বাধীন। এমনকি পিতা-মাতাও তাকে এই বিষয়ে কোনরূপ চাপ প্রদানের ক্ষমতা রাখে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে একবার এক কন্যাকে তার পিতা সম্মতি না নিয়েই স্বীয় পছন্দমত বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন সেই কন্যা মসজীদে নববীতে সকলের সামনে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এ তোমার অধিকার। ইচ্ছা করলে পিতার পছন্দকে গ্রহণ করতে পার, আর না চাইলে তা প্রত্যাখানও করতে পার।’ তখন এই মহিলা বলেন, ‘আমি আমার পিতাকে বিব্রত করব না। তবে এখন এসেছি কিয়ামত পর্যন্ত নারীর অধিকারকে স্পষ্ট করার জন্য।’
মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও ‘নারীদের স্বাধীন অধিকার প্রদান করা হয়েছে। জাতীয় মহাসংকটকালেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলা সাহবীদের মতামত গ্রহণ করেছেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় সাহাবীগণ যখন ইহরাম খুলতে অগ্রসর হচ্ছিলেন না তখন উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামার রা. মত গ্রহণ করে তিনি নিজে আগে ইহরাম খোলেন। ফলে সাহাবীগণও তাঁর অনুসরণ করেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁফ ছাড়লেন।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও ইসলাম নারী-পুরুষের তারতম্য করেনি। উম্মে সুলাইম রা. নামক এক আনসারী মহিলার শিক্ষার আগ্রহের তারিফ খোদ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে করেছেন। শিক্ষামূলক কোন বিষয়ে কোন প্রশ্ন করতে তিনি তথাকথিত সামাজিক লজ্জাকে স্থান দিতেন না। পুরুষদের সাথে বিভিন্ন শিক্ষামূলক মজলিসে নারীরা শরিক হতেন। এছাড়াও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য সপ্তাহে একটা দিন আলাদা করে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা. কে তো তিনি নিজে গড়ে তুলেছিলেন। ফলে শুধু ধর্ম বিষয়েই নয় কুরআন, হাদীস, তাফসীরসহ ইতিহাস, এমনকি চিকিৎসা বিষয়েও তিনি অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে সাহাবীগণের খুব কমজনই ছিলেন তাঁর সমকক্ষ। এমনকি রাজনৈতিক মতামত দানের ক্ষেত্রেও তিনি বহুবার নিয়ামক হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন।
পুরুষদের সাথে বিভিন্ন শিক্ষামূলক মজলিসে নারীরা শরিক হতেন
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোন তারতম্যই নেই ইসলামে। আমরা জানি অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া সামাজিক মূল্যায়ন ও মর্যাদা অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে নারীদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। এমনকি স্বাধীনভাবে তাদের জন্য নিজেদের পেশা বেছে নেয়ার অধিকারও স্বীকৃত। সাহাবী মহিলাগণের অনেকেই তৎকালে প্রচলিত বহুপেশা স্বাধীনভাবে অবলম্বন করেছিলেন।
নারীর উপার্জনে স্বামী, পিতা, ভাই, পুত্র কারোরই হস্তক্ষেপের অধিকার দেয়া হয়নি। নারী যা উপার্জন করবে তা তার, এ কথা কুরআন মাজীদে একাধিকবার উল্লেখ রয়েছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে যেমন তার পূর্ণ অধিকার তেমনি ব্যায়ের ক্ষেত্রেও তাকে পূর্ণ অধিকার প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বামী, পিতা বা অন্য কোন পুরুষের অনুমতি নেয়ার কোন প্রয়োজন রাখা হয়নি। তবে হারাম হালালের গন্ডি পুরুষের মত নারীর ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।
নারীর সম্পদ অর্জনের উপায় তিন ধরণের। এক. নিজ উপার্জিত সম্পদ। দুই. মোহরানা প্রাপ্ত অর্থ। তিন. উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ। এক্ষেত্রে নারীরা অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। কারণ, পুরুষের ক্ষেত্রে সম্পদ অর্জনের মাত্র দুটো পথই রয়েছে। এক, স্ব-উপার্জিত সম্পদ। দুই. উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ। তৃতীয় কোন সোজা পথ তার নেই।
ইসলাম সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা বই থেকে চিত