লেবাননকে গাজায় পরিণত করতে দেয়া যাবে না; জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব

লেবাননকে গাজায় পরিণত করতে দেয়া যাবে না; জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : লেবাননকে গাজায় পরিণত হতে দেয়া যাবে না বলে সতর্ক করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। গত শুক্রবার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি। এ সময় ইসরাইল ও লেবাননের হিজবুল্লাহর মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বৃদ্ধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি শান্ত করতে এবং ভুল হিসাব-নিকাশ রোধ করতে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষীরা কাজ করছেন। গুতেরেস বলেছেন, বিশ্বকে অবশ্যই জোর গলায় এবং স্পষ্টভাবে বলতে হবে, অবিলম্বে সঙ্ঘাত কমানো কেবল আবশ্যকই নয়, বরং অপরিহার্য। এই সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান নেই। এ দিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিষয়ক উপ-সহকারী হিসেবে কাজ করা একজন সিনিয়র কর্মকর্তা শুক্রবার পদত্যাগ করেছেন। পারিবারিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি দায়িত্ব ছাড়েন বলে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়। অ্যান্ড্রু মিলার তার সহকর্মীদের বলেছিলেন যে তিনি তার পরিবারকে গাজায় আট মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরাইলি যুদ্ধের মধ্যে ‘অল্পই’ দেখেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, ‘তাড়াহুড়ো করে নেয়া কোনো পদক্ষেপ, একটি ভুল হিসাব বিপর্যয়কে আরো বেসামাল করে তুলতে পারে, যা সীমান্তের বাইরে সত্যি বলতে কি কল্পনারও বাইরে চলে যেতে পারে।’ এ সময় তিনি আরো বলেন, ‘আসুন এ বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক, এই অঞ্চলের জনগণ এবং বিশ্ববাসী লেবাননকে আরেকটি গাজায় পরিণত হতে দিতে পারে না।’


অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ইসরাইলে রকেট নিক্ষেপ করছে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ। এতে অনেক ইসরাইলি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেখানে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ইসরাইলে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এ দিকে, দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলি হামলার পর কয়েক হাজার লেবানীজ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।


জাতিসঙ্ঘে ইরানের মিশন শুক্রবার বলেছে, হিজবুল্লাহর নিজেকে এবং লেবাননের ইসরাইলের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার ক্ষমতা রয়েছে। এ সময় মিশন সতর্ক করে বলেছে, ‘সম্ভবত এই অবৈধ শাসনের আত্মধ্বংসের সময় এসেছে।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে করা একটি পোস্টে ইরানের জাতিসঙ্ঘ মিশন আরো বলেছে, ‘নিজেকে বাঁচাতে দখলদার ইসরাইলি শাসনের যেকোনো বিবেকহীন সিদ্ধান্ত এই অঞ্চলকে একটি নতুন যুদ্ধে নিমজ্জিত করতে পারে।’
হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন দেবে যুক্তরাষ্ট্র্র : এ দিকে লেবাননের শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে ইসরাইলকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের এক কর্মকর্তার বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম সিএনএন। এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক জ্যাক সুলিভান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠক করেন দখলদার ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক তাজাখি হানেঘবি এবং কৌশলগত সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রী রন ডারমান। সেখানেই ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তারা। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হলে ইসরাইলকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্কিন সেনাদের সেখানে সরাসরি মোতায়েন করা হবে না।

শরণার্থী শিবির ও রেডক্রস অফিসে হামলায় নিহত ৬৭ : গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের প্রধান সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেছেন, গতকাল শনিবার গাজার আল-শাতি শরণার্থী শিবির এবং তুফাহ এলাকায় ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৪৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল আলজাজিরাকে বলেছেন, আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি গোলাবর্ষণে হতাহতদের কাছে পৌঁছানো খুব কঠিন ছিল। এর আগে গাজায় আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) কার্যালয়ের কাছে ভারী গোলাবর্ষণে ২২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ইসরাইলের হামলার মুখে অনেকেই আশ্রয়ের জন্য রেডক্রস কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে বিবিসি। হামলায় রেডক্রসের কার্যালয়ের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। এক বিবৃতিতে আইসিআরসি বলেছে, শুক্রবার দুপুরের দিকে কার্যালয় ও তাদের কর্মীদের আবাসস্থলের আশপাশে ভারী গোলা এসে পড়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি বলছে, বেসামরিক লোকজন এবং মানবকি সহায়তা কেন্দ্রগুলোর ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর দায়িত্ব সব পক্ষেরই রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে এটি একটি বলে দাবি করেছে আইসিআরসি। তবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন মুখপাত্র বলেছেন, ওই এলাকায় তারা কোনো হামলা চালায়নি।


গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলের হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭,৫৫১ জন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই হামলায় আরো ৮৫,৯১১ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় ১০১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ সময়ে আহত হয়েছেন ১৬৯ জন।

গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে আইসিজেতে কিউবা : ফিলিস্তিনের গাজায় অভিযানের নামে গণহত্যা চালানোর ঘটনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) আগেই মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এবার তাতে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ কিউবা। গতকাল শনিবার আলজাজিরার খবরে বলা হয়, শুক্রবার কিউবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে বলেছে, কিউবা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার গণহত্যার অভিযোগকে সমর্থন করবে।


কারণ, গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহু সরকারের ক্রমবর্ধমান আক্রমণ বন্ধের কোনো লক্ষণ নেই। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, গণহত্যা, বর্ণবাদ, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি এবং নির্বিচারে শাস্তি আধুনিক বিশ্বে স্থান পেতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এসব সহ্য করতে পারে না। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা বন্ধ করতে বৈধ আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে যথাসম্ভব সমর্থন করে দেশটি। তাই মামলায় অবদান রাখতে কিউবা অটল প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে।


এর আগে নিকারাগুয়া, কলম্বিয়া, লিবিয়া, মালদ্বীপ, মিসর, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, তুরস্ক ও চিলি ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলায় অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করে এতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা দায়ের করে। দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদনে বলা হয়, গাজায় ইসরাইলের কার্যক্রমে গণহত্যার আচরণ স্পষ্ট। তারা ফিলিস্তিনি জাতীয়তা, জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে হামলা করছে।


শিক্ষা খাতে বড় ক্ষয়ক্ষতি : এ দিকে গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় ইসরাইলি হামলায় শিক্ষা খাতের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেখানে এখন পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিকের ৪৩০ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো ১২ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী। এখন পর্যন্ত গাজার সাড়ে ৩০০ শিক্ষক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া সেখানকার ৩০৭টি স্কুল ভবনের ২৮৬টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স, মিডল ইস্ট আই ও বিবিসি

Related Articles