শাপলা চত্বর থেকে বলছি | আমিনুল ইসলাম কাসেমী

শাপলা চত্বর থেকে বলছি | আমিনুল ইসলাম কাসেমী

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

আশির দশকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)। যিনি বাংলাদেশের আলেম সমাজকে চৈতন্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্তিমিত হওয়া ওলামায়ে কেরামের মাঝে জিহাদী চেতনা জাগ্রত করে এদেশে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে রেখেছিলেন তিনি। কেননা, আলেমগণ বীরের জাতি। সৌর্য-বীর্যে তাঁরাই। কাউকে কভু পরওয়া করেনি।

ওলামায়ে কেরামের সোনালী ইতিহাস সবারই জানা। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সীমাহীন আত্মোত্যাগ। হাজার হাজার আলেমের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই উপমহাদেশে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছিল। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রহ.), হাজী জামেন শহীদ (রহ.), ফকীহুন নফস রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী (রহ.), শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এ সকল আলেমদের নেতৃত্ব এবং তাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষায় এদেশে ঈমানী চেতনার জোয়ার বইয়ে যায়। তাদের নেতৃত্বে ঝাপিয়ে পড়ে লাখো লাখো মানুষ এবং দেশের সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরাম।

১৯৪৭ সনে এই উপমহাদেশ ব্রিটিশদের নাগ-পাশ থেকে মুক্তি পায়। স্বাধীন দেশ ফিরে পাই আমরা। ব্রিটিশ বাহিনী এদেশ থেকে বিদায় নিলে নতুন করে আবার পাকিস্তানী বালা-মুসিবত শুরু হয়। পাক বাহিনীর নির্মম-নির্যাতনে অতিষ্ট মানুষ। আবার শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সনে পাকিস্তানীদের জুলুমের অবসান ঘটে।দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ। লাখো শহীদের রক্তে বাংলাদেশ নামক ভুখন্ড ফিরে পাই। এযুদ্ধেও বহু ওলামায়ে কেরাম অংশ নেন। যে ইতিহাস এখন আমাদের সামনে জ্বল জ্বল করছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের আলেম সমাজ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিলেন। সক্রিয় ভাবে তাঁরা ময়দানে নাম ছিলেন না। কিন্তু ১৯৮১ সনে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) তওবার ডাক দেন। যে ডাকে সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরাম জেগে ওঠেন। জিহাদী চেতনায় ময়দানে অবতীর্ণ হন। বিশেষ করে সব শ্রেণীর আলেমগণ ঐক্যবদ্ধ ভাবে হাফেজ্জীকে সাপোর্ট দেন।

হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর আলেমগণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। খেলাফত আন্দোলন থেকে খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোটসহ নানান দল-উপদলে দেখা যায়। অনেকে পুর্বের দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামে ফিরে যান। এভাবে বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত হয়ে দ্বীন ইসলামের কাজ করতে থাকে। তবে এসব দলগুলো তেমন যুৎ করতে পারেনি। অনেকেই সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। হাফেজ্জী হুজুরের সময় যেভাবে গণ জোয়ার দেখা যায়, সেটা আর ফিরে আসেনি।

হাটহাজারী মাদ্রাসা বাংলাদেশের বৃহত্তর এক দ্বীনি ইদারা। এদেশের মানুষের ভালবাসা ওই প্রতিষ্টানের সাথে। দারুল উলুম দেওবন্দের পরে হাটহাজারী মাদ্রাসাকে বাংলাদেশের আলেমগণ সমীহ করে থাকেন। আর প্রতিষ্টানের যিনি প্রধান থাকেন, তাকেও আলেমগণ ভক্তি- শ্রদ্ধার নজরে দেখেন।

আল্লামা আহমাদ শফি (রহ.) আশির দশক থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি যেমন একজন মুহাক্কিক আলেম আবার বাগ্নি ব্যক্তিত্ব। সারাদেশের মাঝে তাঁর বাগ্মিতা এবং ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। একজন অনুসরনীয় ব্যক্তি হিসাবে আভির্ভূত হন। ২০১০ সনের দিকে হেফাজতে ইসলাম নামে এক অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। যে সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি অরাজনৈতিক ভাবে মানুষের খেদমত করে যাওয়া। অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কথা বলা। মানুষের সেবা মুলক কাজ করা। এরকম বিভিন্ন কার্যক্রম বা কর্মসূচি হাতে নিয়েই মূলত হেফাজতের যাত্রা শুরু হয়।

২০১৩ সনের দিকে কিছু মানুষ ঢাকা শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে মুখর হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধাপরধীদের ফাঁসি চেয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি সেখানে হাতে নেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের দাবীগুলো যুক্তিযুক্ত ছিল। কেননা যুদ্ধাপরাধীগণ দেশ ও জাতির দুশমুন। তাদের শাস্তি হোক সেটা এদেশের দেশ প্রেমিক জনতা চাচ্ছিল। যে কারণে তাদের এই আন্দোলন এদেশের বহু মানুষ এমনকি অনেক আলেম-উলামা সমর্থন জানিয়েছিল।

কিন্তু দুঃখের বিষয় অনলাইনে কিছু ইসলাম বিদ্বেষী মানুষ দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করে। শাহবাগের কিছু কর্মি সে কাজে জড়িয়ে পড়ে। যার সূত্র শাহবাগের সাথে জড়িয়ে আছে বলে প্রমাণিত হয়। এ কারণে শাহবাগের সে আন্দোলনের প্রতি আর কোনো আলেম-উলামা এবং সচেতন মানুষের সমর্থন থাকে না। বরং আলেমগণ শাহবাগের সেই ইসলাম বিরোধী কার্যক্রমের জওয়াব দিতে থাকেন।

শাহবাগের ইসলাম বিরোধী কার্যক্রমের জওয়াব হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে শুরু হয়। আল্লামা আহমাদ শফি সাহেব হাটহাজারী থেকে হেফাজতের ব্যানারে প্রতিবাদ শুরু করেন। এভাবে আস্তে আস্তে ঢাকা থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়। আল্লামা আহমাদ শফি সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে হেফাজতের ব্যানারে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে এবং অনৈলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আলেম- উলামাগণ জাগরণ তুলে দেন। আলেমগণ কিছুটা কোণঠাসা অবস্হায় ছিল। ময়দানে নামার অবস্হা তাদের ছিলনা। কেননা অনেকেই ছিন্ন- ভিন্ন অবস্হায় তখন। আবার ওদিকে বিএনপি – জামাতজোট ও চরম কোনঠাসায় ছিল। তারা ময়দানে নামার কোন সুরত খুঁজে পাচ্ছিলনা। রাজনৈতিক ভাবে অনেকখানি দেউলিয়াপনায় ভুগছিল তারা।

আল্লামা আহমাদ শফি হেফাজতের ব্যানারে ডাক দিলে মানুষ সাড়া দিতে লাগল। ইসলামী দলগুলো এগিয়ে আসল। কেননা, হেফাজতের প্রথম সারিতে তখন ওই বিএনপি- জামাত জোটের বিভিন্ন নেতার চেহারা দেখা যেত। যারা জোটের ব্যানার নিয়ে নির্বাচন করেছিল, তারা তখন হেফাজতের বড় লিডার। এ কারণে হেফাজতের আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। কোথাও হেফাজতের কর্মসূচি দেওয়া হলে ওই জোটের লোকের উপস্থিতি দেখা যেত। অনেক জায়গাতে গোপনীয় ভাবে হেফাজতকে প্রক্সি দিতে থাকে।

৫ মে হেফাজত ইসলাম ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু হেফাজতের অভ্যন্তরে তখন ঔই জোটের ঘুটি চালনা শুরু হয়। ঢাকা ঘেরাও করতে এসে জমা হয় মতিঝিল শাপলা চত্বরে। শাপলাতে তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু ওই যে হেফাজতের প্রথমসারির কিছু জোট নেতা। যারা হেফাজতের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার প্রচেষ্টা করতে লাগল। যার বড় প্রমাণ স্বরুপ বলা যায়, হেফাজতের শাপলা চত্তরের মিটিংএ হাজির জামাত বিএনপি নেতারা।

অনেক জনপ্রিয় ইসলামী দলের জায়গা হয়নি হেফাজতের মঞ্চে। তাদেরকে সাধারণ জনতার কাতারে দেখা গেছে। কিন্তু ওদিকে বিএনপি জামাতের নেতারা ঠিকই মঞ্চে ছিল। অথচ হেফাজত তো অরাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু হেফাজত চলে গেল তখন রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতারা প্রলুদ্ধ করেছিল আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার। অনেকে এ আন্দোলনকে পুঁজি করে রঙিন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। হেফাজতকে সিঁড়ি বানিয়ে বঙ্গভবনে বসতি গড়বেন এমন স্বপ্নে বিভোর।

হেফাজতের আন্দোলনে মুলতঃ বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন নিরীহ আলেম এবং তালেবুল ইলম। তাদেরকে সামনে রেখে ওরা পগারপার হতে চেয়েছিল। যার জন্য বায়তুল মোকাররমে অগ্নি সংযোগ এবং বিজয়নগরের রাস্তার দুধারের গাছগুলো ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কেটে ভীতি ছড়ায়ে পিছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চেয়েছিল তারা। আবার কিছু লোক ওই যে ওদের সাথে বৈঠক করে আন্দোলন বেচা-কেনার কাজেও সময় দিয়েছিল বলে জানা যায়।

শাপলা ট্রাজিডির পরে হেফাজত কিছুটা কোনঠাসা হয়ে যায়। সেই জৌলুস আর থাকে না। এরও কিছু কারণ ছিল। হেফাজতের কমিটিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতার আনাগোনা। হেফাজত হয়ে পড়ে অঘোষিত এক রাজনৈতিক দল। যারা হেফাজতকে নিজস্ব গতিতে কখনো আর চলতে দেয়নি।

আল্লামা আহমাদ শফির ইন্তেকালের পরে হেফাজত এর অবস্থা আরো নাজুক হয়ে দাঁড়ায়। নামে হেফাজত। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক নেতাদের হাতে থাকে ষ্টিয়ারিং। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে থাকে। কিন্তু হেফাজত যেন আরো করুণ পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। কালের বিবর্তনে হেফাজত থেকে সেসব রাজনৈতিক নেতাদেরও অবসান হয়। বড় নাজুক পরিস্থিতির শিকার হয় তারা।

আসলে এক মহৎ উদ্দেশ্যে নিয়েই হেফাজতের যাত্রা শুরু। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কদম রাখে। কিন্তু সুবিধাবাদীদের দ্বারা হেফাজত ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে বারবার। কিন্তু নিষ্ঠার সাথে যে সংগঠনের যাত্রা, তাকে কিন্তু সহজেই পরাভূত করা যায় না। তাছাড়া একজন জবরদস্ত আল্লাহওয়ালা মানুষ ছিলেন এটার প্রতিষ্ঠাতা। একে কিন্তু কেউ বিনষ্ট করতে পারবে না।

এজন্য হেফাজত যেন আবার শাপলা চত্তর থেকে কথা বলছে, এটা ন্যায়-নীতির সংগঠন।ইখলাসের সাথে এর পথচলা। যারা এ সংগঠনকে ভিন্ন খাতে নিতে চাইবে তারাই বরবাদ হবে। হেফাজত স্বমহিমায় এগিয়ে যাবে। কেউ তাকে রোধ করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *