শিশুর পুষ্টি
এ এম ইমদাদুল ইসলাম : জাতিসংঘের উদ্যোগে সকল মানুষের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে একটি অধিকতর টেকসই ও সুন্দর বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সার্বজনীনভাবে একগুচ্ছ সমন্বিত কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এতে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট রয়েছে। যার ২নং ক্রমিকে রয়েছে “ক্ষুধামুক্তি” ক্ষুধা দূর করা এবং সকল মানুষের জন্য, বিশেষ করে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকা মানুষ এবং শিশুদের জন্য সারাবছর নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের সংবিধান ও বিদ্যমান আইনে শিশুদের অধিকারের প্রতি রাস্ট্রের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে (১৮ বছরের নিচে) শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ যা মোট জন্যসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। এ বিপুলসংখ্যক শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মননশীল বিকাশে সর্বোচ্চ যত্ন নেয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। বিগত বছরগুলিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। অনেক মধ্যম আয়ের দেশের তুলনায় এ দুই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের শিশুকেন্দ্রিক বাজেট প্রায় ৬৫ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত ১৫টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জনের পরও আমাদের দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এরমধ্যে শিশুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ শিশুরা অনুপুষ্টিকনার বিশেষ করে ভিটামিন-এ, আয়োডিন ও জিংকের অভাবে সবচেয়ে বেশি ভুগে থাকে।
প্রায় ৩৬ শতাংশ শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম। এরমধ্যে সিলেট বিভাগে স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শিশুর সংখ্যা বেশি, যা প্রায় ৪৫ শতাংশ। পাঁচ বছরের ও কমবয়সী প্রায় শতকরা ৪১ ভাগ শিশু খর্বকায় (stunting)। সিলেট বিভাগে খর্বকায় শিশুর হার সবচেয়ে বেশি যা প্রায় ৪৯ শতাংশ। খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে এ হার সবচেয়ে কম, যা প্রায় শতকরা ৩৪ শতাংশ। পাঁচ বছরের কম বয়সী শতকরা ১৬ ভাগেরও বেশি শিশু কৃশকায় (wasting)।
অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ অথবা ঘনঘন সংক্রমন ও প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান যেমন- আমিষ, শর্করা, তেল ভিটামিন ও খনিজ লবণ ইত্যাদি উপাদানের ঘাটতির করণে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়। শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগলে ০৫ (পাঁচ) বছরে কম বয়সী শিশুরা বয়স অনুপাতে খর্বাকৃত (stunting), কৃশকায় (wasting) ও কম ওজন (underweight) নিয়ে বেড়ে ওঠে। ফলে এসব শিশুরা রোগা, পাতলা, দুর্বল খিটখিটে মেজাজের হয়। এরফলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দ্রুত শিশু রোগাক্রান্ত হয়। অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের ভবিষ্যত কর্মক্ষমতা কমে যায়।
মেয়ে শিশুদের ঠিকমত খাদ্য পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান না করলে তারা খর্বাকৃত হয়ে বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে খর্বাকৃত অপুষ্ট কিশোরী হিসেবে গড়ে উঠে। বিয়ের পর সে একজন কম ওজনের মহিলা হিসেবে গর্ভধারন করে, ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম হয়। সেই কম ওজনের মেয়ে শিশু সঠিক খাদ্য, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা না পেলে সেও অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে এবং বিয়ের পর অপুষ্ট শিশু জন্ম দেয়। এভাবে মেয়েদের ভিতর অপুষ্টির চক্র ঘুরতেই থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তৃণমূল পর্যায়ে পুষ্টি সেবা কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এইচ পি এন এস ডি পি (HPNSDP)-র আওতায় ২০১৭-২০২২ মেয়াদে ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেস (NNS) শীর্ষক একটি অপারেশনাল প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো অপুষ্টিজনিত ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠির মাঝে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পুষ্টি সেবা পৌঁছে দেয়া। এ কার্যক্রমের আরেকটি প্রধান লক্ষ্য হলো অপুষ্টি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস করা। তৃণমূল পর্যায় শিশুর অপুষ্টি রোধ করার জন্য জেলা সদর ও উপজেলা হাসপাতালে ৩৯৫টি Integrated Management of Childhood Illness Programme (IMCI) এবং পুষ্টি কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে শিশুর খাবার ও পুষ্টি বিষয়ক নানা রকম প্রচার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে পাঁচ বছরের কমবয়সী স্বল্প ওজনের ও খর্বাকৃত শিশুর হার ২৫ শতাংশ এবং কৃশকায় শিশুর হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শিশুর অপুষ্টি প্রতিরোধে বাবা মার করণীয় নির্ধারণ করে ব্যপক প্রচার কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে তাদের সচেতন ও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হচ্ছে। শিশুদের অপুষ্টি
প্রতিরোধে কিশোরী গর্ভবর্তী মা এবং দুগ্ধদানকারী মায়ের যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অপুষ্টি রোধে দেরিতে বাচ্চা নেয়া, নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, আয়রন ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শ মোতবেক কাজ করা প্রয়োজন।
শিশুর অপুষ্টিরোধে জন্মের সাথে সাথে (১ ঘন্টার মধ্যে) শিশুকে মায়ের দুধ দিতে হবে। জন্মের পর থেকে পূর্ণ ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের দুধ দিতে হবে। শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে (১৮১তম দিন থেকে) মায়ের দুধের পাশাপাশি পারিবারিক বাড়তি খাবার খাওয়ানো শুরু করতে হবে। শিশুকে ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত পারিবারিক খাবারের পাশাপাশি মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। সময়মত সবগুলি টিকা দিতে হবে। ২ বছর পর থেকে নিয়মিত কৃমিনাশক বড়ি খাওয়াতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনও কোনো ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। সবসময় শিশুকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
আমাদের সমাজে শিশুকে খাওয়ানোর ব্যাপারে নানা রকম কুসংস্কার/ভুলধারণা রয়েছে। যেমন শিশুর অসুখ হলে তার স্বাভাবিক খাওয়া বন্ধ করে দেয়া, ডায়রিয়া হলে মায়ের দুধ খাচ্ছে এমন শিশুর মা-কে শাকসবজি খেতে না দেয়া। বাড়তি খাবার খেলে শিশুর পাতলা পায়খানা হয় অথবা শুধুমাত্র দামী খাবারে বেশি পুষ্টি থাকে ইত্যাদি। এসব কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সরকার কর্তৃক গৃহীত ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো শিশুর উন্নয়ন ও শিশু অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে দেশের সকল শিশুর নিরাপত্তা বিধান, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পুষ্টি ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এছাড়া জাতীয় সমাজকল্যাণ নীতিমালা-২০০৫ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও ঝুঁকির মুখে থাকা পথশিশু, এতিম ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সুবিধা প্রদান ও তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করা। এছাড়া শিশু আইন ২০১৩ এর মাধ্যমে সকল শিশুর সুরক্ষার পাশাপশি সুবিধাবঞ্চিত ও ঝুঁকির মুখে থাকা শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক সেবা এবং বিকল্প যত্নের ব্যবস্থা প্রদানসহ শিশু কল্যাণ বোর্ড, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন ও শিশু আদালত প্রতিষ্ঠা অন্যতম।
শিশুদের প্রতি দয়া, মমতা, ভালবাসা, যত্ন ও সহযোগিতার মাধ্যমে আগামীর শিশুদের জন্য গড়ে তুলতে হবে উপযুক্ত বাসযোগ্য পরিবেশ। প্রতিটি শিশু একটি সুন্দর জীবন পাক, দেশের উন্নয়নে যোগ্যতার পরিচয় রাখুক, বেড়ে উঠুক বিশ্বের এক উজ্জ্বল কর্ণধার হিসেবে এটাই হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : কলামিস্ট