শুক্রবারে সুরা কাহাফ

শুক্রবারে সুরা কাহাফ

  • তামীম আব্দুল্লাহ

শুক্রবারকে জুমাবারও বলা হয়। এদিনে সুরা আল কাহাফ পড়তে বলা হয়েছে। হাদীসের বর্ণনায়—
হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) রাসুল (সা.)–এর পক্ষ থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি জুম’আর দিন সুরা কাহাফ পাঠ করবে, তার জন্য এক জুমা’আ থেকে অপর জুম’আ পর্যন্ত নূর বর্ষিত হবে।’

এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে শুক্রবারে সুরা কাহাফ তিলাওয়াতের মাধ্যমে দাজ্জালের ফিতনাসহ অনেক ফিতনা থেকে মুক্তির কথা বলা হয়েছে।

কাহাফ মানে গুহা। গুহাবাসীদের বিবরণ এখানে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। সরল পথের আলোচনা করে মোহাম্মদ (সা.)-কে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে, মক্কাবাসীদের পথদ্রষ্টতার জন্য চিন্তা করা নিরর্থক, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। জ্ঞানান্বেষণে এক প্রভু ভক্ত মহাপুরুষের সাক্ষাৎ এবং জুল কারনাইন ও ইয়াজুজ মাজুজের কথা আলোচনা করা হয়েছে।

সুরা কাহাফে চারটি ঘটনা, চারটি বক্তব্য ও উপদেশ রয়েছে। সুরার ১ থেকে ৮ আয়াতে রয়েছে বক্তব্য। ৯ থেকে ২৬ আয়াতে আছে আসহাবে কাহাফের ঘটনা। ২৭ থেকে ৩১ আয়াতে আবার বক্তব্য এসেছে। ৩২ থেকে ৪৪ আয়াতে দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা রয়েছে। এরপর আবার লম্বা বক্তব্য ও উপদেশ এসেছে ৪৫ থেকে ৫৯ আয়াতে।

এ সুরায় দুটি কাহিনী এসেছে ৬০ থেকে ১০১ আয়াতে। সে দুটি হলো মুসা (আ.) ও খিজির (আ.) ঘটনা এবং জুলকারনাইন সম্পর্কিত ঘটনা। আবার সুরা শেষ হয়েছে বক্তব্য ও উপদেশ দিয়ে।

গুহাবাসীর চমকপ্রদ আখ্যান

অবিশ্বাসে ভরা সমাজে কয়েকজন যুবক আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছিলেন। বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাঁরা একটি গুহায় গিয়ে লুকালেন। সেখানে আল্লাহ তাঁদের সবাইকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন।

ঘুম ভাঙার পর তাঁরা বুঝতেই পারেননি, তাঁদের ঘুমের মধ্যে আল্লাহ অনেকগুলো বছর অতিবাহিত করে ফেলেছেন। এ অবস্থায় তাঁদের একজন খাবার কিনতে শহরে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন, লোকজন তাঁকে চিনে ফেলবে এবং তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন, কেউ তাঁকে চেনে না। খাবার কিনে টাকা পরিশোধ করার সময় পুরোনো মুদ্রা দেখে শহরের লোকেরা হতবাক হয়ে গেল।

এ ঘটনার তাৎপর্য একাধিক। তবে আল্লাহ রব্বুল আলামিন কীভাবে তাঁর ওপর সমর্পিত বান্দাদের কী করে কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন তা দেখানো হয়েছে।

বাগানের মালিকের সম্পদের ঘটনা

এক ব্যক্তির সুন্দর একটি বাগান ছিল। কিন্তু লোকটি ছিলেন অহংকারী। পবিত্র কোরআনে আছে, ‘আর তার প্রচুর ধনসম্পদ ছিল, তারপর কথায় কথায় সে তার বন্ধুকে বলল, ধনসম্পদে আমি তোমার থেকে বড় এবং জনবলেও তোমার চেয়ে শক্তিশালী’ (আয়াত ৩৪, সুরা কাহাফ)

অহংকারী হয়ে আল্লাহর নিয়ামতের কথা ভুলে যাওয়ায় আল্লাহ তাঁর বাগান ধ্বংস করে দেন।

ঘটনাটি তাদের জন্য, যারা নিজের অহংবোধে আল্লাহর নিয়ামতের কথা ভুলে যায়। তাঁরা ভুলে যায় যে আল্লাহ চাইলেই মুহূর্তে তাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিতে পারেন।

একসঙ্গে হযরত মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)

হযরত মুসা (আ.) খিজির (আ.)–এর সঙ্গে সফর করার সময় তিনটি ঘটনা সংঘটিত হয়।

প্রথম ঘটনায় খিজির (আ.) একটি নৌকা ছিদ্র করে ফেলেন, অথচ নৌকার মালিক বিনা ভাড়ায় তাঁকে নৌকায় উঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনায় তিনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেন। তৃতীয় ঘটনায় তিনি একটি দেয়াল উঠিয়ে দেন।

ঘটনা তিনটি দেখে হযরত মুসা (আ.) চুপ থাকতে পারলেন না। তখন খিজির (আ.) ঘটনাগুলোর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দেন। হযরত মুসা (আ.) বুঝতে পারলেন আল্লাহ কীভাবে কাউকে কাউকে অন্তর্দৃষ্টি দেন, যাতে তাঁরা সুদূরপ্রসারী অর্থে এমন কাজ করতে পারেন যাকে আপাতদৃষ্টিতে বোধগম্য বলে মনে হয় না।

সব জ্ঞানের অধিকারী কেবলই আল্লাহ। তাই জ্ঞান নিয়ে অহংকার করা অনুচিত।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর এ-দেওয়ালটি ছিল শহরের দুই এতিমের। তার নিচে ছিল গুপ্তধন। আর ওদের পিতা ছিল এক সৎকর্মপরায়ণ লোক। সে জন্য তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলেন যে ওরা যেন সাবালক হয় ও তারপর ওরা ওদের ধন উদ্ধার করে। আমি নিজ থেকে কিছু করিনি। তুমি যে-বিষয়ে ধৈর্য রাখতে পারনি এটাই তার ব্যাখ্যা।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত ৮২)

জুলকারনাইনের ঘটনা

জুলকারনাইন ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও সৎ বাদশাহ। তিনি পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত সফর করেছিলেন। দুই পর্বতের মাঝখানে তিনি এক জনগোষ্ঠীকে খুঁজে পান। তারা তাঁর কাছে ইয়াজুজ ও মাজুজের হাত থেকে রক্ষা পেতে একটি দেয়াল নির্মাণের আবেদন জানাল। জুলকারনাইন কাজটি করে দিতে সম্মত হলেন। তিনি তাঁর কাজ নিয়ে গর্ব দেখাননি।

দেয়াল তৈরির পর তাঁর দেওয়া ভাষণ পবিত্র কোরআনুল কারীমে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে তখন তিনি ওকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন, আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত ৯৮)

ওপরের চারটি ঘটনা থেকে চার রকম পরীক্ষার কথা জানা যায়।
১. আসহাবে কাহাফের ঘটনা থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার প্রতি বিশ্বাসের এবং ভালোবাসার নিদর্শন ও তার প্রতিফল
২. দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা থেকে সম্পদের ওপর পরীক্ষা,
৩. হযরত মুসা (আ.) এর খিজির (আ.) থেকে জ্ঞান শেখা
৪. জুলকারনাইনের ঘটনা থেকে ক্ষমতা নিয়ে পরীক্ষা।

চারটি দাওয়াত

এই চারটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় আল্লাহ পাক প্রত্যেক মানুষের মাঝে এক হেদায়েতের পয়গাম ও দাওয়াতের কথা বলেছেন।

১৪ নম্বর আয়াতে যুবকেরা বাদশাহকে দাওয়াতের কথা বলেছেন। (আসহাবে কাহাফের ঘটনা)।

৩৭ নম্বর আয়াতে একজন সঙ্গী আরেক সঙ্গীকে দাওয়াত দিয়েছে (দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা)।

৭০ নম্বর আয়াতে একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে দাওয়াত দিয়েছে (হজরত মুসা (আ.) এবং জ্ঞানী ব্যক্তি হযরত খিজির আ. এর ঘটনা।

৮৭-৮৮ আয়াতে একজন শাসক তার প্রজাদের দাওয়াত দিয়েছে (জুলকারনাইনের ঘটনা)।

এবং এই দাওয়াতের মাধ্যমেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করে আমাদের পরস্পরের মধ্যে ইমান, আমলের কমতি দূর করে আখেরাতের অনন্ত জীবনকে আলোকিত করার তাওফিক দান করুন।

 

লেখক, সাংবাদিক 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *