সততা ও আমানতদারিতার শিক্ষা

সততা ও আমানতদারিতার শিক্ষা

সততা ও আমানতদারিতার শিক্ষা

মুফতি সালমান মানসুরপুরি ❑ শৈশবকাল থেকেই বাচ্চাদের সত্যবাদী বানানোর চেষ্টা করা উচিত। যদি তাদের থেকে ভুলক্রমে মিথ্যা প্রকাশ পায় তাহলে এমনভাবে তারবিয়ত করা দরকার যাতে সামনে কখনো মিথ্যা বলার সাহস না করে। কেননা সততা এমন এক গুণ যেটা মানুষকে উভয় জগতে সফলতা এনে দেয়। প্রিয় নবীজী হযরত মুহাম্মাদ [সা.] সবসময় সত্য বলার ও মিথ্যা পরিত্যাগের ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দিতেন।

সাইয়্যিদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ [রা.] হতে বর্ণিত হুজুরে আকরাম [সা.] বলেন, ‘সত্যকে অবলম্বন কর কেননা সত্য কল্যানের দিকে নিয়ে যায়। এবং নেকি জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।আর মানুষ যখন সত্য বলতে থাকে এবং সত্যন্বেষী হয় তখন আল্লাহর নিকট তার নাম সিদ্দিকীনদের তালিকায় উঠে যায়। আর তোমরা মিথ্যা বলা পরিহার কর। কেননা মিথ্যা অন্যায়ের পথে নিয়ে যায়, আর অন্যায় মানুষকে জাহান্নামের দিকে টেনে নেয়। আর যখন মানুষ লাগাতার মিথ্যা বলে এবং মিথ্যান্বেষী হয় তখন আল্লাহর ঐখানে মিথ্যাবাদীদের তালিকায় তার নাম উঠে পড়ে।’ [মিশকাতুল মাসাবিহ ২/৪১২]

হযরত রাসূলে পাক [সা.] আরো বলেন, ‘সত্যকে অনুসন্ধান কর যদিও তাতে তোমার মরণ লেখা থাকে। কেননা মুক্তি সত্য বলার মাঝেই।’ [আত তারগিব ওয়াত তারহিব মুকাম্মাল পৃঃ৬১৬]

অভিজ্ঞতা থেকে একথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে, যে মিথ্যা বলে মানুষের মাঝে তার ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং লোকেরা তাকে ভালো চোখে দেখে না। তাইতো আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা [রা.] বলেন, হুজুর [সা.] এর নিকট মিথ্যা সবচেয়ে অপছন্দনীয় বিষয় ছিল। যদি তিনি কোন ব্যক্তি সম্পর্কে জানতেন যে, সে মিথ্যাবাদী তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে এই মন্দ অভ্যেস থেকে ফিরে না আসত ততক্ষণ পর্যন্ত রাসূল [সা.] তার সাথে স্বাভাবিক হতে পারতেন না। [আত তারগিব ওয়াত তারহিব মুকাম্মাল পৃষ্ঠা,৬১৮ হাদিস নং, ৪৪৬৫]

হুজুর [সা.] এটাও বলেছেন যে, ‘মুমিনের মাঝে ভালো মন্দ গুণ থাকতে পারে কিন্তু সে মিথ্যুক হয় না।’ (অর্থাৎ যদি সে মিথ্যাবাদী হয় তাহলে তার ঈমানে দূর্বলতা দেখা দিবে)।

উল্লেখিত হাদিস সমূহ বাচ্চাদের সামনে বারবার বলা উচিত যেন তাদের মস্তিষ্কে সত্যের অপরিহার্যতা ও মিথ্যার কদর্যতা গেঁথে যায়।

বাবা-মা ও মিথ্যা থেকে দূরে থাকবেন : বাবা-মা ও বিশেষভাবে সন্তানদের সাথে সবসময় সত্য বলবেন। কেননা স্বয়ং মা-বাবাই যদি মিথ্যা বলে তাহলে সন্তানের উপর নসীহতের কোন প্রভাব ফেলবে না। এখানে হাদিস থেকে দৃষ্টান্ত সরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়-

সায়্যিদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমের [রা.] বলেন যে, একবার হুজুর [সা.] আমাদের ঘরে তাশরিফ আনলেন। আমার আম্মাজান (আমার দিকে বন্ধ হাত দেখিয়ে) বললেন, এদিকে আসো (যেভাবে মায়েরা বাচ্চাদের ডেকে থাকে)। হুজুর [সা.] আম্মাজানকে বললেন, তুমি তাকে কি দেওয়ার ইচ্ছা করেছ? আম্মাজান বললেন, আমি খেজুর দিতে চাইছি। তখন রাসূলে পাক [সা.] বললেন, ‘যদি তুমি তাকে খেজুর না দিতে তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যার গুনাহ লেখা হত।’ [আবু দাউদ শরিফ হাদিস নং ৪৯৯১/আত-তারগিব ওয়াত তারহিব পৃষ্ঠাঃ৬১৯ হাদিসঃ৪৪৬৮]

এই হাদিসের আলোকে আমরা বলতে পারি যে,বাস্তব জীবনে এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলোকে মিথ্যা মনে করা হয় না অথচ সেসব বিষয়েও মিথ্যার গুনাহ হতে পারে। আজকাল সব জায়গাতেই বাচ্চাদের মিথ্যা স্বান্তনা, মিথ্যা ওয়াদা দেওয়ার প্রচলন আছে। আর ভয়ংকর কথা হলো, এগুলোকে মিথ্যা ই মনে করা হয় না! অথচ মহানবী [সা.] এর কথানুযায়ী এটাও মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত।

মিথ্যা ও অলীক ঘটনা বলা থেকে বিরত থাকা : অনুরুপভাবে বাচ্চারা যখন পড়া লেখার বয়সে উপনীত হবে তখন তাদেরকে মিথ্যা বানোয়াট গল্প সম্বলিত বই পড়তে দেওয়া অনুচিত। উচিত হলো আম্বিয়ায়ে কেরাম, সাহাবায়ে ঈজাম ও ওলী-আউলিয়াদের জীবনী নিয়ে রচিত সহজ সহজ গ্রন্থ পড়তে দেওয়া। এর দ্বারা উত্তমভাবে তাদের মন ও মনন গঠন হবে এবং কুদরতি ভাবে ওলী-আউলিয়াদের সাথে সম্পদ ও তাঁদের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। বিশেষকরে শিশুদেরকে হাসি তামাশা, কার্টুন সম্বলিত বই থেকে যতদূর সম্ভব দূরে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করা উচিত। এবং তাদের মগজে এ কথা বসিয়ে দেওয়া যে, শরীয়তে হাসি ঠাট্টার জন্যও মিথ্যা বলা জায়েজ নেই।

রাসূলে পাক [সা.] হাসি তামাশার মধ্যেও মিথ্যা কথা বলা থেকে নিষেধ করেছেন। বরং এ ধরনের লোকদেরকে তিনি তিনবার অভিসম্পাত করেছেন। ‘যে ব্যক্তি মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে সে ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক।’ [আবু দাউদ হাদিস নং: ৪৯৯,মিশকাতুল মাসাবীহ ২/৪১৩]

সায়্যিদুনা হযরত ওমর ফারুক [রা.] হুজুরে আকরাম [সা.] থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘কোন ব্যক্তি সে সময় পর্যন্ত পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না সে হাসি তামাশায় মিথ্যা ও ঝগড়াঝাটি পরিত্যাগ না করবে যদিও সে সত্যের উপর থাকে।’ [আত-তারগিব ওয়াত তারহিব মুকাম্মাল পৃ: ৬১৭, হাদিস ৪৪৫৪]
আমানতদারীর গুরুত্ব : বাচ্চাদের মাঝে শুরু থেকেই আমানতদারীতা ও দিয়ানাতের গুরুত্ব ঢেলে দেওয়া উচিত। কেননা শৈশব থেকেই যদি তার মাঝে সম্পদের আমানত ও দিয়ানাতের বালাই না থাকে তাহলে পরবর্তীতে সম্পদের মোহ ও লালসা তার মাঝে গাঢ়ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে। এবং এটা বৃদ্ধি পেতে পেতে খিয়ানত ও চুরি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে বাচ্চাদের শক্ত গাইডলাইন আবশ্যক। তাদের বুঝানো উচিত যে, যখনই টাকা পয়সার দরকার হবে তখনই যেন বাবা মা’কে অবহিত করে এবং তাদের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন জায়গা থেকেই যেন টাকা না ধরে।

অনুরুপ ভাবে ঘরের অন্যান্য সদস্য ও আলমিরায়ও যেন হাত না দেয়। অন্যের জিনিস তার অনুমতি ব্যতিত কখনো যেন ব্যবহার না করে। যখন বাচ্চাদেরকে কোন কিছু কিনতে বাজারে পাঠানো হবে তখন ফেরার সাথে সাথেই তাদের থেকে হিসাব বুঝে নিবে। যদি এক্ষেত্রে লাগাতার ছাড় দেওয়া হয় তাহলে তাদের অভ্যেস খারাপ হয়ে যাওয়ার আশংকা প্রবল। [বাচ্চাদের আহকাম ও মাসাইল:২৯৩ মাওলানা ফয়সাল আহমাদ নদভী]

মোটকথা শৈশব থেকেই যদি বাচ্চাদের মাঝে আমানতের জজবা গড়ে উঠে তাহলে সে নিরেট মুমিন এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে তার জীবন পরিচালনা করবে। এবং সবার অধিকার ঠিকঠাক মত আদায় করবে। আল্লাহর হক্ব যেমন তেমনও বান্দারটাও আদায় করবে। আল্লাহ না করুন যদি খেয়ানত ও বদঅভ্যেস গড়ে উঠে তো সারা জীবন লাঞ্চনার মাঝ দিয়েই তাকে যেতে হবে।

এ বিষয়ে এক শিক্ষনীয় ঘটনা হলো, আবুল হাউরা সাদী বলেন যে, আমি একবার সায়্যিদুনা হযরত হাসান ইবনে আলী [রা.] কে জিজ্ঞেস করলাম আপনার কি নানাজান (হুজুর সা.) এর কোন বিষয় মনে আছে? হযরত হাসান [রা.] বললেন যে, ‘হ্যাঁ আমার মনে আছে। একবার শৈশবে একবার আমি সদকার একটি পড়ে যাওয়া খেজুর উঠিয়ে মুখে দিলাম (বাচ্চারা অনেক সময় যেমনটা করে থাকে) তখন বিষয়টি নবীজীর চোখে পড়তেই তিনি আমার মুখ থেকে খেজুর বের করে সদকার মালের ভিতর রেখে দিলেন। অথচ ঐ খেজুর আমার লালায় ভিজে গিয়েছিল! তখন উপস্থিত কেউ কেউ বলে ফেললেন, ‘একটি মাত্র খেজুরে আর তেমন কি সমস্যা?’ একথা শুনে মহানবী সা. বললেন, আমরা (নবী বংশের সদস্যরা) সদকার মাল ভক্ষণ করি না।’ এবং তিনি বললেন যে, রাসূল [সা.] আরো বলেছেন, সন্দেহযুক্ত কাজ পরিত্যাগ করে ঐ কাজ করো যাতে কোন সন্দেহ নেই কেননা সততার দ্বারা হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ হয় আর মিথ্যার দ্বারা অশান্তি। [মুসনাদে আহমদ হাদিস নং ১৭২৩-১৭২৭. সুনানে তিরমিজি হাদিস নংঃ ২৫১৮]

উক্ত ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায় যে, সন্তানদের লালন পালনে ও শিক্ষা দানে হযরত পয়গম্বর [সা.] কতটা গুরুত্ব দিতেন। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের জন্য উত্তম নমুনা। তাছাড়া নবীজী [সা.] আরো বলেন যে, ‘যার ভিতর আমানতদারীতা নেই তার ঈমানও নেই।’ [মুসনাদে আহমাদ ৩/ ১৩৩ হাদিস নংঃ ১২৪১. মিশকাতুল মাসাবীহ হাদিস নংঃ ১৫]

সুতরাং আমাদের সবারই এই বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক।আল্লাহ পাক আমাদেরকে ও আমাদের সন্তান সন্ততিদের পরিপূর্ণভাবে আমানতদারীতার গুণে গুণান্বিত করুন।

শিশুদের হৃদয় হিংসা বিদ্বেষ মুক্ত রাখা : বাচ্চাদের শৈশবে শিক্ষা দিক্ষার সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরিপক্কতার দরুণ তাদের ভিতর এই রোগটি চলে আসে। সে সমবয়সী সাথীর প্রতি হৃদয়ে ঘৃণার বীজ বপন করে এবং হিংসা বিদ্বেষের রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। যেমন- কোন ছেলে ভালোভাবে সবক শুনিয়ে দিল, পরীক্ষায় ভালোবাসা নম্বর পেল, খেলাধুলায় অগ্রগামী হয়ে গেল তখন অপর বাচ্চা নিজে মেহনত করে সফলতা অর্জনের পরিবর্তে হিংসা করতে শুরু করে। এভাবে অন্তরে অন্তরে দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং এটা কখনো মারামারি হাতাহাতির পর্যায়েও চলে যায়।

এমতাবস্থায় বাবা-মা’র খুব সতর্কতার সাথে বাচ্চাদের মন মগজ গঠন করা প্রয়োজন। বাবা-মা’র দায়িত্ব হলো, তারা সন্তানকে এই মন্দ স্বভাবের বেড়াজাল থেকে বের করে আনবে এবং তার ভিতর সামনে অগ্রসর হওয়ার স্পিরিট তৈরী করবে।আর সফলতা অর্জন করা ছেলেদের প্রতি তার ভাবনা পরিষ্কার করবে। তাদের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধির চেষ্টা করবে। তাদেরকে বুঝাবে যে, আজ তারা পরিশ্রম করে ঐ পর্যন্ত পৌঁছেছে সুতরাং তুমিও যদি মেহনত করো তাহলে তুমিও কাল তার থেকে আরো সামনে চলে যেতে পারবে।

মোটকথা এখনই সময় বাচ্চাদের মানসিকতা পরিবর্তনের, তাদের কোমল হৃদয়গুলোকে পরিচ্ছন্ন রাখার। নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার নিজের অল্পবয়স্ক খাদেম হযরত আনাস [রা.] কে নসীহত করতে যেয়ে বললেন, প্রিয় বৎস! যদি তোমার সকাল সন্ধ্যা এভাবে অতিবাহিত হয় যে,তোমার অন্তরে কারো প্রতি কোন হিংসা বিদ্বেষ নাই্ (হযরত আনাস রা. বলেন, তারপর আগে বেড়ে বললেন যে,) হে প্রিয়! এটা (অন্তর পরিষ্কার রাখা) আমার সুন্নত। আর যে আমার সুন্নতকে জিন্দা করল সে যেন আমাকে ভালোবাসল, আর যে আমাকে ভালোবাসল সে জান্নাতে আমার সাথে থাকবে। [সুনানে তিরমিজি/আবওয়াবুল ইলম, হাদিস নংঃ ২৬৭৮]

প্রিয় নবীজী [সা.] কতৃক হযরত আনাস [রা.] কে করা উক্ত নসীহত এ বিষয়ের সুস্পষ্ট দলীল যে, শুরু থেকেই শিশুদের মানসিক তারবিয়তের বিশেষ গুরুত্বারোপ করা দরকার। কেননা যদি এখনই তাদেরকে এ বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয় তাহলে ভবিষ্যতে পদে পদে এর সুফল তারা ভোগ করতে পারবে ইনশাআল্লাহ।

ভাষান্তর :: মুফতি আইয়ুব কাসেমী
প্রিন্সিপাল খাদিজাতুল কুবরা রা. আদর্শ মহিলা মাদ্রাসা গোপালগঞ্জ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *