সফেদ নির্মল মুখখানা দেখবো বলে

সফেদ নির্মল মুখখানা দেখবো বলে

  • মোহাম্মাদ আইয়ুব

পঙ্গপালের মতো আমরা কজন ছুটছি বারিধারার দিকে। কতকাল যাবত অদেখা রূহানী পিতার নূরানী মুখখানা। একপলক দেখব বলে আজ আমরা ছুটি। কল্পনা আর বাস্তবতার বারিধারায় হাজির যখন হয়েছি তখন মাগরিব। জামাতে নামাজ পড়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ আমরা কজন নবীন মাঝি।

ঘড়ির কাটায় ৬টা ৪০ মিনিট অপেক্ষা কত বিষাদময় আজ আরেকবার তার তিক্ত স্বাদ পেলাম। ঘনিয়ে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ডাক এলো সাক্ষাতের। আমরা অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে সিঁড়ি ভাঙতে থাকলাম। দরজা খুলে হাসিমুখে বরণ করে নিলেন শ্রদ্ধেয় উস্তায প্রিয় মাকনুন সাহেব।

আনন্দে গড়াগড়ি খাওয়ার পালা। চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করা গেলে বড্ড ভালো লাগত, কিন্তু আদবের যে খেলাফ। আমরা চুপচাপ বসলাম কিন্তু আবেগের ফিসফিসানিকে থামাবে। অপেক্ষা, অপেক্ষা, অপেক্ষা! তারপর আমাদের প্রিয় বড় হুজুর (শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ), আস্থার অবিচল ঠিকানা, সফেদ জান্নাতি নির্মল মুখখানা নিয়ে আমাদের সামনে ধরা দিলেন।

বয়স, ওমরা সফর, ক্লান্তি সবকিছু ছাপিয়ে সেই চিরচেনা মুখেই সালামে সালামে সন্তানদের আগলে নিলেন বুকে। প্রশান্ত চিত্তে উদার মানসিকতায়, পুলকিত হৃদয়ে ভরাট কন্ঠে সেই পুরনো সমীহ জাগানিয়া আদুরে ভাষায় ‌’কেমন আছিস রে তোরা?’ আমাদের জাগিয়ে দিল। ধীরস্থির ভাবে সোফায় বসলেন, আর আমরা বাচ্চাগুলো সামনে, একদম সামনে, নিরাপদে।

বেশ কিছুক্ষণ অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোদের দেখে মনটা আজ ভরে গেল। কত কষ্ট করে ছুটে এসেছিস। কে কোথায় কি করছিস বল।

আমরা উপস্থিত ভাগ্যবান বিশ জন একে একে নাম, ঠিকানা কর্মস্থলের কথা বলতে শুরু করলাম। প্রত্যেকের খেদমতের কথা শুনে হুজুর খুব উচ্ছ্বসিত হচ্ছিলেন, মাশাআল্লাহ-আলহামদুলিল্লাহ, তোর কাজে আল্লাহ বরকত দিন, কবুল করুন, ইত্যাদি দোয়ায় সিক্ত করছিলেন।

দুইজন শুধু ব্যবসার কথা বললে হুজুর বললেন, ব্যবসার পাশাপাশি কিছু দ্বীনি খিদমতও করবে বুঝলে। কাছাকাছি ডাকার মতো করে অতি আদরে বলতে লাগলেন শুন, তোমাদের এ আগমনে খুব খুশি লাগছে। যে কষ্ট স্বীকার করে দেখা করতে আসছিস।

উস্তাযের সাথে সুসম্পর্ক রাখা এটা অস্তিত্বের পরিচয়। এটা হচ্ছে মূল, কখনো এটাকে ভুলে যাবে না। কখনো এটা বিচ্ছিন্ন করবে না। যদি করো, তাহলে তুমি অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাবে। নবীজীর সাথে সাহাবীদের বন্ধন ছিল অস্তিত্বের, প্রাণের। জীবন থেকেও বেশি তাঁরা এ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন।

তারপর সাহাবীদের সাথে তাবেয়ীদের, এভাবে যুগযুগ ধরে হাজার বছর ধরে চলে আসছে। তবে আফসোস! আজ আর এ সম্পর্কটা নেই। সবাই উস্তায ছাড়াই নিজে নিজে বড়। এজন্য আজ ফেতনা ছড়াচ্ছেও বেশী। মাশাআল্লাহ, তোমরা প্রত্যেকেই দ্বীনি খেদমত করছো। যার যার স্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছো। শোনে খুব ভালো লাগছে। সকল কাজের তাওফিক একমাত্র আল্লাহ পাকই দেন।

বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, দোয়া করো তোমরা। আমরা বললাম, হুজুর, আমরাই তো আপনার দোয়ার মুহতাজ! কতদিন হয়ে গেল আপনার মালিকময় দোয়ায় শরীক হই না! হুজুর বললেন, দেখো, দোয়ার জন্য সুকুন লাগে। লাগাতার অসুস্থতার কারণে সেই সুকুন মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলি। তাই সাধারণত জনসম্মুখে এখন আর দোয়া করি না।

আমাদের পিড়াপিড়িতে ইহসানবশতঃ হুজুর দোয়া শুরু করলেন। কান্নার রোল পড়ে গেল চারিদিক। এবার বিদায়ের পালা। হুজুর মনে হয় আমাদের ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। পিতা পুত্রের সাক্ষাৎ তো বিচ্ছেদের জন্য নয়, তবুও কথায় আছে না- ”যেতে নাহি দিব হায়/তবু যেতে দিতে হয়/তবু চলে যায়!’

এই পর্বে আমাদের হৃদয় ছিল ভগ্ন, চেহারা ছিল মলিন। তবুও সাক্ষাতের সুখস্মৃতি নিয়ে আমরা কজন সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম। মনে মনে ভাবলাম, আবার আসিব এই বারিধারায় জান্নাতি নূরানী মুখখানা দেখতে, প্রশান্তচিত্তে। ইনশাআল্লাহ।

  • লেখক: খতিব, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *