পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে জাহাজ কেনায় আগ্রহী হচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। ২০১৪ সালের পর থেকে দেশীয় বিনিয়োগে জাহাজ কেনায় ভাটা পড়েছিল। তখন কেনা জাহাজও একে একে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছিলেন উদ্যোক্তারা। অবস্থা এমন হয়েছিল, বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ৬৮ থেকে ৪০-এ নেমে গিয়েছিলে। সেই দিন পাল্টে এখন জাহাজের সংখ্যা ৭৫টিতে উন্নীত হয়েছে।
করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে এখন নতুন করে জাহাজ কেনায় ঝুঁকছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। এ কারণে ২০২১ সালের জানুয়ারি-অক্টোবরে ১২টি সমুদ্রগামী জাহাজ কিনে চালু করেছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। আগে শুধু খোলা পণ্য পরিবহনে জাহাজ কেনায় ঝোঁক থাকলেও এখন কনটেইনার জাহাজ কেনা, এমনকি জ্বালানি তেল পরিবহনের জাহাজও কিনছেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের নিবন্ধন দেয় সরকারের নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়াতে বাজেটে সরকার বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। সমুদ্রপথে ৫০ শতাংশ পণ্য দেশীয় জাহাজে পরিবহন করার বাধ্যবাধকতা করে ‘বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ (সংরক্ষণ) আইন ২০১৯’ আইন করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে দেশীয় জাহাজ ভিড়তে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণেই দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা আবারও বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘বড় শিল্প গ্রুপগুলো এখনো নিজেদের পণ্য পরিবহনে নিজস্ব জাহাজ কেনায় বিনিয়োগ করছেন। এ কারণে দেশীয় শিল্প গ্রুপের বহরে গত ১০ মাসে মোট ১২টি জাহাজ যুক্ত হয়েছে। যে জাহাজগুলো কেনা হয়েছে তার প্রায় সবটারই পণ্য পরিবহন সক্ষমতা ৫০ হাজার টন। সব মিলিয়ে এখন ৭৫টি সমুদ্রগামী বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ রয়েছে। আরো কয়েকটি জাহাজ যুক্ত হবে নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই।’
নতুন যুক্ত হওয়া ১২টি জাহাজের মধ্যে মেঘনা গ্রুপের আছে পাঁচটি, কর্ণফুলী গ্রুপের বহরে চারটি এবং বসুন্ধরা গ্রুপের বহরে যুক্ত হয় দুটি জাহাজ। এতে তাদের বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের বহরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে এলপিজি এবং তেল পরিবহনকারী দুটি জাহাজ। এগুলো হলো ৪৬ হাজার টনের ‘বসুন্ধরা ওয়ারিয়র্স’ এবং ৩০ হাজার টনের ‘বসুন্ধরা মালিকা’। এ নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের বহরে মোট জাহাজের সংখ্যা হয়েছে আটটি। নিজস্ব পণ্য পরিবহনে বসুন্ধরা গ্রুপের আরো বেশ কটি জাহাজ কেনা প্রক্রিয়াধীন আছে।
সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর কর্ণফুলী গ্রুপের বহরে আগে থেকেই খোলা পণ্য এবং কনটেইনার জাহাজ ছিল। ২০২০ সালে তারা প্রথম দুটি কনটেইনার জাহাজ যুক্ত করে বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহন শুরু করে। ২০২১ সালে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সমুদ্রগামী আরো চারটি কনটেইনারবাহী জাহাজ। এগুলো হলো ‘এইচআর হেরা’, ‘এইচআর ফারহা’, ‘এইচআর আরাই’ এবং ‘এইচআর রেহা’। দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের মধ্যে কর্ণফুলী গ্রুপের কেবল সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ আছে। এ নিয়ে তাদের বহরে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়াল ছয়টিতে।
কর্ণফুলী গ্রুপের পরিচালক হামদান হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ছয়টি জাহাজে আমাদের পণ্য পরিবহন সক্ষমতা ১০ হাজার এককের বেশি। ধীরে ধীরে আমরা এই সক্ষমতা বাড়াচ্ছি। এ মাসেও নতুন কনটেইনার জাহাজ যুক্ত হবে।
তিনি মনে করেন, দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়াতে সরকারের শিপিং সেক্টর বেশ সহায়তা দিচ্ছে। আর এই সংখ্যা যত বাড়বে ততই দেশীয় মুদ্রা সাশ্রয় হবে। দেশের টাকা দেশেই থাকবে।
বাংলাদেশি মালিকানাধীন ৭৪টি সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে আরেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের রয়েছে সর্বোচ্চসংখ্যক ২৩টি জাহাজ। তাদের সব জাহাজই খোলা পণ্য পরিবহন করছে। এরপর রয়েছে মেঘনা গ্রুপের অবস্থান। তাদের জাহাজ ১২টি। তৃতীয় স্থানে থাকা আকিজ গ্রুপের হাতে রয়েছে ১০টি জাহাজ।
নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০০৯ সালের আগে সরকারি-বেসরকারি দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ছিল ২৪টি। সমুদ্রগামী জাহাজ নিবন্ধন সহজীকরণ এবং শুল্ককর কমানোর কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা তখন জাহাজ কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। আবার শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকরা পরিবহনে খরচ সাশ্রয় করতে যুক্ত হন এই খাতে।
দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশীয় বহরে যুক্ত হয় ৪১টি সমুদ্রগামী জাহাজ। এরপর ২০১২ সালের জুনে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা উন্নীত হয় ৬৮টিতে। ২০১৩ সালে ৯টি জাহাজ নিবন্ধন নেন উদ্যোক্তারা। এরপর থেকে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা কমাতে থাকেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। খরচ পোষাতে না পেরে অনেকেই পুরনো জাহাজগুলো স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেন। এরপর থেকে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা কমে আসে।