সিসিটিভি ফুটেজে দিল্লির পরিবারটির ‘আত্মহত্যার আয়োজন’

সিসিটিভি ফুটেজে দিল্লির পরিবারটির ‘আত্মহত্যার আয়োজন’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গত রোববার দিল্লির বুরারি এলাকার ভাটিয়া পরিবারের ১১ সদস্যের মৃত্যুর ঘটনাটি এমনই ছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা, সিসিটিভি ফুটেজেও ওই পরিবারের এই স্বেচ্ছামৃত্যুর আয়োজনের পারিপার্শ্বিক চিত্র প্রকাশিত হয়েছে বলে এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

গত শনিবার রাতে, যখন দিল্লির অধিকাংশ পরিবার তাদের রাতের খাবার খেতে ব্যস্ত, তখন বুরারির একটি পরিবার উদ্ভট এক গণফাঁসির আয়োজনে ব্যস্ত ছিল। ওই সময় তারা টুল, দড়ি যোগাড় করছিল এবং রুটি সরবরাহের আদেশ দিয়েছিল; ঘটনাক্রমে ওই রুটিই হয়ে গেছে তাদের শেষ আহার। ভাটিয়া পরিবারের ১১ জনের এই মৃত্যুতে ‘বাইরের কারো ভূমিকা নেই’, সিসিটিভি ফুটেজে ও ১১টি ডায়েরির নোটে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি এনডিটিভির। তবে ডায়েরির নোটগুলো থেকে এমন কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যা থেকে মনে করা হচ্ছে, পরিবারটির বিশ্বাস ছিল এই ‘আধ্যাত্মিক ফাঁসিতে’ ঝুললেও তারা মারা যাবেন না, বরং আরও ‘শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবেন’।

ভাটিয়া পরিবারের বাড়ির প্রবেশপথের উল্টোপাশে লাগানো এক সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে ওই রাতে ওই পরিবারটির বড় পুত্রবধূকে কয়েকটি টুল নিয়ে আসতে এবং পরিবারটির দুই কিশোরকে দড়ি নিয়ে আসতে দেখা গেছে, যেগুলো ওই গণআত্মহত্যায় ব্যবহার করা হয়েছে। ওই পরিবারের সব সদস্য রাত প্রায় ১টার দিকে ফাঁসিতে ঝুলে মারা গেছেন বলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। পরিবারটির অধিকাংশ সদস্যকেই খুব কাছাকাছি বাড়িটির হলওয়ের ছাদে লাগানো গ্রিলে ফাঁসিতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

সিসিটিভি ফুটেজ থেকে এমন ধারণা পাওয়া গেছে যে, পরিবারটির ৭৭ বছর বয়সী কর্ত্রী নারায়ণী দেবীর ছোট ছেলে ৪৫ বছর বয়সী ললিত চুনদাওয়াতের নির্দেশনা পরিবারটির স্বেচ্ছায় অনুসরণ করেছিল। ডায়েরির নোটগুলোও তারই লেখা এবং সেগুলো থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, তার মৃত বাবা তাকে মোক্ষ লাভের বিষয়ে ‘উপদেশ দিচ্ছেন’, ললিত এমন ‘দৈবপ্রত্যক্ষণে’ (হ্যালুসিনেশন) ভুগতেন।

পরিবারটির আরেক সদস্য ললিতের ৩০ বছর বয়সী ভাগ্নি প্রিয়ঙ্কাও ওই ডায়েরিগুলোর নোট লেখায় সহায়তা করেছেন। গত ১৭ জুন তার বিয়ের বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল। ডায়েরির নোটগুলো থেকে বোঝা গেছে, ললিতের মৃত বাবার আত্মা তাদের রক্ষা করবে বলে পরিবারটি বিশ্বাস করতো। শেষ ডায়েরিটির শেষ লাইন, যা আত্মহত্যার দিনটিতেই লেখা হয়েছে, বলছে, “এক বাটিতে পানি রাখ, পানির রং যখন পাল্টে যাবে, আমি তোমাদের রক্ষা করতে আসবো।” বাস্তবে পানির রংও পাল্টায়নি, আর কেউ তাদের রক্ষা করতেও আসেনি।

ধর্মভীরু ও পরোপকারী পরিবারটির কোনো আর্থিক দৈন্যতা ছিল না বলে জানিয়েছেন প্রতিবেশীরা। এনডিটিভি ধর্মভীরু ও পরোপকারী পরিবারটির কোনো আর্থিক দৈন্যতা ছিল না বলে জানিয়েছেন প্রতিবেশীরা। ছবি: এনডিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, পরিবারটির সবচেয়ে ছোট দুই সদস্য, ১২ বছর বয়সী ধ্রুব ও ১৫ বছর বয়সী শিবাম নিচে নেমে একটি ফার্নিচারের দোকান থেকে দড়ি নিয়ে আসছে, এই দড়িই ফাঁসিতে ব্যবহার করা হয়েছে। এই দড়ি দিয়েই তাদের বাবা-মা তাদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছিল। পরদিন সকালে এই স্কুল বালকদেরসহ ভাটিয়া পরিবারের ১০ জনকে ফাঁসিতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

পুলিশ জানিয়েছে, ছাদের গ্রিলের জালিকা থেকে তারগুলো যে রকমভাবে ঝুলানো হয়েছে তা ছাদে না গিয়ে করা সম্ভব নয়, পরিবারটির কোনো সদস্যই তা করেছেন। একমাত্র ললিতের স্ত্রী টিনা বাদে বাকি সবার মুখ, চোখ, হাত, পা বাঁধা ও গলায় ফাঁস লাগানো ছিল। টিনাই অন্যদের বেঁধে দিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরিবারের কর্ত্রী নারায়ণী দেবীকে পাশের একটি ঘরে মেঝেতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, তার মৃত্যুও ফাঁসিতে ঝুলেই হয়েছে; ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন তা নিশ্চিত করেছে। পরিবারটির নয় সদস্য ফাঁসিতে ঝুলে পড়তে পাঁচটি টুল শেয়ার করে ব্যবহার করেছেন।

ললিতের নির্দেশমতো চলে পরিবারটির ব্যাপক আর্থিক উন্নতি হয়েছিল বলে জানিয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। বয়স হয়ে যাওয়ার পরও প্রিয়ঙ্কার বিয়ে হচ্ছিল না। ললিতের নিদের্শ মতো চলার পর দ্রুতই প্রিয়ঙ্কার বিয়ের পাকা ব্যবস্থা হয়ে যায়। এসব কারণে ললিতে দৈবদর্শনের বিষয়ে পরিবারটির আস্থা জন্মেছিল। তাই তারা ‘আত্মাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য এ আচার পালন করেছিল’ বলে মন্তব্য ওই পুলিশ কর্মকর্তার। ললিতের মাধ্যমে পুরো ভাটিয়া পরিবার ‘শেয়ারড সাইকোসিস ডিসঅর্ডারে’ আক্রান্ত হন বলে ধারণা পুলিশের। ৩০ জুন, শনিবার শেষ বারের মতো ডায়রিতে নোট লেখা হয়েছিল। তাতে দেওয়া নির্দেশনার শিরোনাম ছিল ‘ভগবানের পথে’।

নোটে বলা হয়েছে, নয় জন ছাদের ওই গ্রিলের ‘জাল’ থেকে ফাঁসিতে ঝুলবে; ললিতের বিধবা বড় বোন বেবি ও বড় ভাই ভুবনেশ কাছাকাছি থাকবে এবং একটি ছোট টুল ব্যবহার করবে। নোটে কোন সময় কী করতে হবে তার বিস্তারিত দেওয়া হয়েছে। রাত ১০টায় রুটি আনার আদেশ দিতে হবে, ‘মা সবাইকে রুটি খাওয়াবেন’ এবং রাত ১টায় ‘ক্রিয়া’ সম্পন্ন করতে হবে। মুখ, কান ও চোখ ডাক্তারের পট্টি (ব্যান্ডেজ) দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।

ডায়েরির নোট ও সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করে ঘটনার ধাপগুলো দাঁড় করিয়েছে পুলিশ, নিচে তা তুলে ধরা হল : শনিবার রাত ১০টা : পরিবারের বড় পুত্রবধূ বাইরে থেকে কয়েকটি টুল নিয়ে আসতে দেখা যায়। রাত ১০টা ১৫ মিনিট : ধ্রুব ও শিবাম দোতলা বাড়িটি থেকে নিচে নেমে একটি ফার্নিচারের দোকান থেকে দড়ি নিয়ে আবার বাসায় ফিরে। রাত ১০টা ৩৯ মিনিট: একটি লোক এসে পরিবারটির অর্ডার দেওয়া ২০টি রুটি দিয়ে যায়। রাত ১০টা ৫৭ মিনিট: নারায়ণী দেবীর বড় ছেলে ভুবনেশ বাড়ির কুকুরটিকে নিয়ে হাঁটতে যান। রাত ১১টা ৪ মিনিট: কুকুরকে নিয়ে বাড়ি ফিরেন ভুবনেশ। পরদিন (রোববার) ভোর ৫টা ৫৬ মিনিট: বাড়ির নিচের মুদি দোকানের সামনে দুধের কার্টন রেখে যায় একটি ট্রাক, যেগুলো কেউ নিতে আসেনি। সকাল ৭টা ১৪ মিনিট: এক প্রতিবেশী তাদের বাসায় প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পর অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় চিৎকার করতে করতে বের হয়ে আসে।

ভাটিয়া পরিবার অন্যান্য দিন অনেক সকালে তাদের বাড়ির নিচতলার মুদি দোকান খুললেও এদিন দেরি করায় ও রাস্তায় দুধের কার্টন পরে থাকায় ওই প্রতিবেশী খোঁজ নিতে যান এবং খোলা সদর দরজা দিয়ে ঢুকে মৃতদেহগুলো দেখতে পান।

‘শেয়ারড সাইকোটিক ডিসঅর্ডারের’ বিভিন্ন ঘটনায় এর আগেও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গণআত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনাটিও সে ধরনের কোনো ঘটনা কি না তা তদন্ত করে দেখছে দিল্লি পুলিশ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *