সিস্টেমের বাইরে অবস্থান করে ভেতরকার বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন: মাওলানা মাহমুদ মাদানী

সিস্টেমের বাইরে অবস্থান করে ভেতরকার বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন: মাওলানা মাহমুদ মাদানী

গত ৪ ও ৫ জুলাই ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ভারতের সর্ববৃহৎ ও শতবর্ষী ইসলামী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পরিচালনা পর্ষদের দুই দিনব্যাপী মজলিস। এতে ভারত ও বিশ্ব মুসলিমের বিদ্যমান পরিস্থিতি ও এ থেকে উত্তরণসহ সমসাময়িক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেছেন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।

এতে সভাপতির ভাষণে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আধ্যাত্মিক রাহবার, মুসলিম নেতৃত্বের প্রতিভূ, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি হযরত মাওলানা সায়্যিদ মাহমুদ আসআদ মাদানী দা.বা.। পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম কর্তৃক পাঠকদের জন্য বক্তব্যটির চুম্বকাংশ বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে। তিন কিস্তিতে প্রকাশিতব্য ভাষণটির ২য় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো।

১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

ভারতে একটি ব্যাধি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে; শ্রেণী-বৈষম্যের ব্যাধি। এই হতাশাব্যাঞ্জক অবস্থা থেকে উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকরি উপায় হল— পিছিয়ে পড়া ক্ষেত্রগুলো থেকে অবমুক্ত হয়ে এগিয়ে যাওয়ার যাবতীয় পথ ও পন্থা অবলম্বন করা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক কিংবা বাজার, শিল্পকলা হোক বা হাসপাতাল, আদালত কিংবা খেলার মাঠ— সব জায়গায় আমাদের (মুসলমানদের) উপস্থিতি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে নেয়ার স্পৃহা রাখতে হবে। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্তির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

আমরা যেমন ব্যবসার দিকে মনোযোগ দিই ঠিক একইভাবে সরকারী নিয়োগ প্রাপ্তিতেও সমান মনোযোগী হতে হবে। এ লক্ষ্যে নিজেদের সক্ষমতাও তৈরি করতে হবে। কারণ, সিস্টেমের বাইরে অবস্থান করে বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়া অনেক কঠিন কাজ। সিস্টেমের ভেতরে থেকে চেষ্টা করাই বেশি কার্যকর। এই পদক্ষেপ হলো দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টার একটি অংশ। স্বল্প মেয়াদে এই শ্রেণী-বৈষম্য মোকাবেলার জন্য অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

আমি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টিআকর্ষণ করতে চাই, আজকাল এমন কথা বুঝানোর অপচেষ্টা চলছে যে, ‘(দেশভাগের সময়) আমাদের আকাবীরদের এইদেশ–ভারতে রয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো।’ যুবকদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, আমাদের এদেশে রয়ে যাওয়া কেন সঠিক ছিল এবং আজও এদেশে থাকা কেন সঠিক— তা বুঝানোর জন্য আমাদের একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি আছে, সুযোগ হলে সন্ধ্যায় এটি উপস্থাপন করবো ইনশাআল্লাহ।

যুগে যুগে মুসলমানদের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে

একটা কথা আমরা বারবার বলে থাকি যে, জীবন্ত জাতি কখনও পরিস্থিতি দেখে ভয় পায় না। যে জাতি সঙ্গীন পরিস্থিতির সম্মুখে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, তারা মৃত।

সঙ্গীন পরিস্থিতি তো সবসময় আসে এবং আগামীতেও আসবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, যদি আমরা মুসলিম হই, তবে প্রতিটি যুগেই আমাদের পরীক্ষা আসবে। কখনো সুবিধার মাধ্যমে পরীক্ষা হবে, কখনো অসুবিধার মাধ্যমেও পরীক্ষা হবে।

আমি মুসলিম যুবকদের বলতে চাই, আপনাদের সাচ্চা জযবা ও নিঃস্বার্থ আবেগ-স্পৃহাকে কিছু স্বার্থপর ভণ্ড ব্যক্তি ও সংগঠন ছিনিয়ে নিতে সচেষ্ট। তাদের উদ্দেশ্য হলো, পুরো মুসলিম জাতিকে হতাশা ও নিরাশায় ডুবিয়ে ফেলা।

মনে রাখবেন, বিশ্বাস হলো মুমিনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আল্লাহর উপর ভরসা করুন। বিশ্বাস রাখুন, আমার প্রভু আমার শাহ রগেরও কাছাকাছি। বিশ্বাস রাখুন, তিনি আমার এই বিশ্বাসের মান রাখবেন।

রাতারাতি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে—এমন চটকদার স্লোগান থেকে দূরে থাকুন

আমার যুবক বন্ধু—জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নির্মাতাদের বলতে চাই, ভুলেও এই ফাঁদে পা দেবেন না। রাতারাতি ধনী করে দেওয়ার প্রলোভনে পা দেবেন না। রাতারাতি বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে এমন স্লোগান থেকে দূরে থাকুন। আল্লাহর শাশ্বত নিয়মে ইমান রাখুন। এই পৃথিবীতে আল্লাহর নিয়ম এটাই যে, জেগে থাকা মানুষই ফসল পাবে, আর যারা ঘুমিয়ে থাকবে তারা কিছুই পাবে না। সুতরাং ঘুমিয়ে থাকলে পেছনে পড়ে যাবেন। এখন তো অনেকেই মনে করছে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেছে; পরিস্থিতি তো তখনই ভালো হবে, যখন আমরা এবং আপনারা জেগে থেকে পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করবো। আমাদের সময়কে কুরবানী দেবো।

একটি জাতির উন্নতির পথে কোনো শর্টকাট নেই

যে ব্যক্তি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে সে বঞ্চিত থাকবে। যে ব্যক্তি উদ্যমী হবে সে সাফল্যের শিখরে পৌঁছাবে। জাতির উন্নতির ব্যাপারে একটি কথা মনে রাখবেন, একটি জাতির উন্নতির জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্মের পরিশ্রম ইতিহাসে একটি সাধারণ ঘটনা। এটি কোনো স্বল্প মেয়াদী বিষয় নয়। এখানে কোনো শর্টকাট নেই। যদি আপনি আপনার পরবর্তী প্রজন্মকে সম্মানজনক জীবন দিতে চান, তাহলে আপনি নিজে ফল ভোগ করতে পারবেন না। আপনাকে কেবলই ত্যাগ স্বীকার করে যেতে হবে।

কেউ একজন বলেছিলেন, “তুমি যদি একা খেতে চাও তাহলে গম বা ধান চাষ করো। কিন্তু যদি তুমি তোমার তৃতীয় প্রজন্মকে খাওয়াতে চাও তাহলে যায়তুন গাছ রোপণ করো।” আসুন প্রতিজ্ঞা করি, আমরা গম বা ধান চাষের কথা ভুলে যাবো। আমাদের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের জন্য যায়তুন গাছ রোপণ করবো। বর্তমান সামনে রেখে কিছু করবো না, যা করবো ভবিষ্যতের জন্য করবো। আমাদের দায়িত্ব পালন করবো; তবে তা প্রতিদানের আশায় করবো না। যদি প্রতিদানের আশায় কাজ করেন, তাহলে মনে রাখবেন হতাশা ছাড়া কিছুই পাবেন না।

জমিয়তে উলামা জীবিত থাকলে এই জাতি জীবিত থাকবে

খুশির বিষয় হলো, আমাদের সংগঠনে নতুন প্রজন্ম নতুন উচ্ছ্বাস এবং নয়া উদ্যম নিয়ে যোগদান করেছে। এই দেশের জন্য, দেশের ভবিষ্যতের জন্য, দেশের মুসলমানদের জন্যই কেবল নয়, বরং দেশের দুর্বলদের জন্য, নির্যাতিতদের জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তারা এক আলোর দিশার মতো।

আপনারা আকাবীর বুযূর্গদের রেখে যাওয়া এই আমানতের রক্ষণাবেক্ষণকারী। আপনারা জীবিত থাকলে জাতি জীবিত থাকবে। আপনারা ছাড়া কে আছে এই নির্যাতিত, এই অবহেলিত, সমাজের নিম্নতর স্তরে আছে যারা, তাদের হাত ধরার জন্য? আপনারা ছাড়া আর কেউ নেই। আপনি যান, খুঁজুন, কাউকে খুঁজে পাবেন না।

( আগামীকাল পড়ুন ৩য় পর্ব)

অনুবাদ: আব্দুর রহমান রাশেদ

সম্পাদনা: যারওয়াত উদ্দীন সামনূন

Related Articles