সুবিধাভোগীদেরই বারবার পদোন্নতি ও পদায়ন হয়

সুবিধাভোগীদেরই বারবার পদোন্নতি ও পদায়ন হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক ● ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তা। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রায় ৪ বছর নরসিংদীর জেলা প্রশাসক ছিলেন। ওই জেলার প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন তখন বিএনপির মহাসচিব ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী। অভিযোগ রয়েছে, তার আশীর্বাদে তখন জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এই কর্মকর্তাকে। সে সময় তার নির্দেশেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একের পর এক দেওয়া হয় জেল-জরিমানার দ-। বর্তমান সরকারের আমলে ওই কর্মকর্তা সচিব হয়েছেন। সচিব হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নৌপরিবহনমন্ত্রী প্রয়াত কর্নেল আকবরের একান্ত সচিব এস এম হারুনুর রশিদ এখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক। বর্তমান সরকারের আমলে পদোন্নতি পেয়েছেন দুই দফা। এখন তিনি সচিব হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

শুধু এই কর্মকর্তারাই নন, চারদলীয় জোট সরকারের আমলের সুবিধাভোগী অনেকেই এখন রয়েছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। অন্যদিকে ওই সরকারের আমলে মেধাক্রমে প্রথমদিকে থেকেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও একসময় ছাত্রলীগ করেছেন এ বিবেচনায় যারা বার বার পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, এখনও তারা বঞ্চনার শিকার। কেউ কেউ পদোন্নতি পেলেও তাদের দেওয়া হয়েছে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে। অথচ ওইসব কর্মকর্তা মেধাক্রমে প্রথমদিকে রয়েছেন। একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, প্রশাসনে দলীয়করণ কমলেও জেঁকে বসেছে অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাদা দলের নেতা ও ওই আমলের এক প্রোভিসির ভাই এখন সদ্য ভাগ হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব। জানা গেছে, ওই সচিবের আরেক ভাই লন্ডনে তারেক রহমানের স্থানীয় অভিভাবক। চারদলীয় জোটের আমলেও তিনি ছিলেন ভালো পদে।

বিদেশেও চাকরি করেছেন তিনি। অথচ ওই মন্ত্রণালয়েই কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সচিব পদে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এক এপিএসের ভাই, যাকে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৮ বার বদলি করে কোনো পদেই যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। তবে ওই কর্মকর্তার মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে যিনি সচিব হিসেবে রয়েছেন তার চেয়ে মেধাক্রমে অনেক ওপরে রয়েছেন তিনি। এরপরও তাকে দেওয়া হয়েছে কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব।

সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে যেসব কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সেলকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন ওই কর্মকর্তাদের ভাগ্যেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। ওই কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সচিব হলেও কাজ করছেন কম গুরুত্বপূর্ণ পদে। কেউ কেউ সচিব হয়ে নীরবে অবসরে চলে গেছেন। তাদের ভাগ্যে জোটেনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। অথচ ওই সময়ে যারা চারদলীয় জোট সরকারের আশীর্বাদে ছিলেন তারা এ সরকারের আমলে সচিব হয়েছেন। আবার এ পদে তারা চুক্তিও পাচ্ছেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বঞ্চনার শিকার সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, কাদের সরকার, নজরুল ইসলাম খান, মনজুর হোসেন, আবুল কালাম আজাদ, ইকবাল খান চৌধুরীসহ অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সচিব হলেও নীরবে চলে গেছেন অবসরে। দক্ষতা ও যোগ্যতার কমতি না থাকলেও এই কর্মকর্তাদের সরকারের কোনো কাজে সম্পৃক্ত রাখা হয়নি। অথচ তাদের ব্যাচের যেসব কর্মকর্তা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ভালো অবস্থানে ছিলেন, ওই সরকারের কোনো বঞ্চনার ছোঁয়া যাদের গায়ে লাগেনি তারা বার বার চুক্তিতে নিয়োগ পাচ্ছেন। সূত্র জানায়, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার ডিসি ও একটি বিভাগের কমিশনার ছিলেন এমন কর্মকর্তা রয়েছেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে। এ ছাড়া ঢাকা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব এখন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন। চারদলীয় জোটের আমলে কুড়িগ্রামে ডিসি ছিলেন, যার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হয়রানি করার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে এমন একজন কর্মকর্তা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বার বার পদোন্নতি বঞ্চিত ৮৬ ব্যাচের প্রায় ১০ কর্মকর্তা এ সরকারের আমলেও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছেন। কী কারণে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রশাসনে একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, গত ৮ বছরে প্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে দল সমর্থক বা বিরোধী দলের সমর্থক বলে কিছুই নেই। প্রশাসনে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের আশীর্বাদ যাদের জুটছে, তারাই পদোন্নতি ও পদায়ন পাচ্ছেন। আবার সিন্ডিকেটের সদস্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মও পরিবর্তন হচ্ছে। ওই সিন্ডিকেটে নতুন যে সদস্য অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন তার ঘনিষ্ঠ লোকেরা ভালো অবস্থানে থাকছেন। প্রশাসনের নতুন এ কৌশল কাজে লাগিয়ে পদোন্নতি ও ভালো পদায়ন পাচ্ছেন সব সরকারের আমলে সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তারা।

তবে এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, প্রশাসনে কিছু ভূত ঢুকেছে। এগুলো দূর করারও চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় কাউকে পদোন্নতি ও পদায়ন করা হচ্ছে না। পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে সামষ্টিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রিপোর্টও বিবেচনা করা হয় বলে জানান তিনি। তবে এসব কথা একেবারেই মানতে রাজি নন প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, জনপ্রশাসনের গুটিকয়েক কর্মকর্তা তাদের ইচ্ছামতো প্রশাসন চালাচ্ছেন। এর ফলে প্রশাসনিক কাঠামোতেও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, মাঠ প্রশাসনে নিয়োগেও লাগছে সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ। ডিসি ফিটলিস্টের নামমাত্র পরীক্ষা নেওয়া হলেও ওই কর্মকর্তারা যাদের তালিকা দিচ্ছেন তাদেরই ডিসি করা হচ্ছে। এতে দেখা যাচ্ছে এমন কর্মকর্তা ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন যারা ছাত্র জীবনে সরাসরি ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে ডিসি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। গোয়েন্দা রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, চারদলীয় জোটের আমলে গুরুত্বপূর্ণ জায়গার ইউএনওর দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ২৬ কর্মকর্তা এখন গুরুত্বপূর্ণ জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিএনপির আমলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতির পিএস এখন গুরুত্বপূর্ণ জেলার ডিসি। ওই সময়ে অনেক মন্ত্রীর জেলার ইউএনও ও এসিল্যান্ড এখনও গুরুত্বপূর্ণ জেলার ডিসি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *