- মুফতি মাহতাব উদ্দীন নোমান
গত পর্বের পর
আমরা পূর্বেও এ বিষয়টি আলোচনা করেছি যে, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে রাষ্ট্রপরিচালনার সুষ্ঠু ও সঠিক পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়ার জন্যই ফেরেশতাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং বিশ্বজগতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করেছেন। তারা বিশ্বজগত পরিচালনায় আল্লাহর সেই ইচ্ছা ও নির্দেশেরই বাস্তবায়ন করেন। আমরা আজ কোরআন সুন্নাহর আলোকে ফেরেশতাদের বিশেষ কাজগুলো সংক্ষিপ্তাকারে এখানে উল্লেখ করবো—
এক. প্রতিটি মানুষই নির্দিষ্টকাল মাতৃগর্ভে থাকার পরে দুনিয়াতে আসে। শিশু মাতৃগর্ভে ভ্রুন থাকা অবস্থায়ই আল্লাহ তা’আলা তার জন্য একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করেন। যে ফেরেশতা তাকে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করেন। হাদীস থেকে এর বিবরণ শুনি—
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা রেহেমে (মাতৃগর্ভে) একজন ফেরেশতা নিয়োজিত করেছেন। তিনি বলেনঃ হে প্রভু! এটি বীর্য। হে প্রভু! এটি রক্তপিণ্ড। হে প্রভু! এটি গোশতপিণ্ড। আল্লাহ তা’আলা যখন তার সৃষ্টি পরিপূর্ণ করতে চান, তখন ফেরেশতা বলে, হে প্রভু। এটি নর হবে, না নারী? এটি হতভাগ্য হবে, না ভাগ্যবান? তার জীবিকা কী পরিমাণ হবে? তার আয়ুষ্কাল কি হবে? তখন (আল্লাহ তা’আলা যা নির্দেশ দেন) তার মাতৃগর্তে থাকা অবস্হায় ঐরূপই লিপিবদ্ধ করা হয়। (বুখারি, হাদিস ৬৫৯৫, মুসলিম, হাদীস ২৬৪৬)
দুই. তাদের অন্যতম একটি দায়িত্ব হলো আল্লাহর হুকুমে মানুষকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা। অর্থাৎ মানুষের হিফাযতের জন্যেও তার সামনে-পিছনে ফিরিশতা নিযুক্ত থাকেন।
মহান আল্লাহ বলেন—প্রত্যেক জীবের উপরই একজন সংরক্ষক রয়েছে। ( আত্ব তারিক-৪)
‘আর তিনিই নিজ বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান এবং তোমাদের উপর প্রেরণ করেন হিফাযতকারীদেরকে। (আনআম-৬১)
সেজন্যই ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের নাক কান দিয়ে কোন কীটপতঙ্গ প্রবেশ করে না। তখন আমাদের হাত, পা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে তারা ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। রাস্তাঘাটে চলতে গেলে মহাবিপদ ও এক্সিডেন্ট থেকে আল্লাহর নির্দেশে তারা আমাদেরকে রক্ষা করে। ঘোর অন্ধকারে চলতেও তারা আমাদেরকে পথ দেখায়। তবে যদি আমাদের গুনাহ ও কৃতকর্মের কারণে বিপদ-আপদ বা এক্সিডেন্ট আল্লাহ কর্তৃক ফায়সালা হয়ে থাকে, তাহলে ওই ফায়সালাকে রোধ করার শক্তি না ফেরেশতার আছে, না আমাদের নিয়োজিত দেহরক্ষীর রয়েছে। পৃথিবীর কেউ তা প্রতিহত করতে পারবে না।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন–
মানুষের জন্য তার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে। এবং আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। কোন সম্প্রদায় সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা দমিত হবার নয়। এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন অভিভাবক নাই। (সূরা আর-রাদ: ১১)
‘তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তো তিনি ক্ষমা করে দেন। তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহ অভিপ্রায়কে ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নেই। সাহায্যকারীও নেই। (সুরা শুরা আয়াত ৩০-৩১)
তিন. কুরআনুল কারীমের অনেক আয়াতের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মানুষের সাথে কিছু ফিরিশতা নিয়োগ করেছেন, যারা তার সৎ-অসৎ সকল কাজকর্ম আমানতের সাথে লিপিবদ্ধ করেন।
আল্লাহ বলেন—
‘তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফিরিশতারাও তাদের নিকট থেকে সবকিছু লিপিবদ্ধ করে।’ (সুরা যুখরুফ আয়াত -৮০)
‘নিশ্চয় আমার ফেরেশতারা তোমাদের কুট-কৌশল লিখে রাখে।’ (ইউনুস-২১)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন—
যখন ডানে ও বামে বসা দু’জন লিপিবদ্ধকারী পরস্পর গ্রহণ করবে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে। (কাফ – ১৭-১৮)
‘আর নিশ্চয় তোমাদের উপর সংরক্ষকগণ রয়েছে। সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর।’ (ইনফিতার, ১০-১৩)
ফেরেশতারা শুধু কার্যবিধি লিপিবদ্ধ করেন। দুনিয়াতে তারা কোন কিছু না বললেও আখেরাতে তারা আমাদের বিরুদ্ধে এই আমলনামা পেশ করবেন এবং তারা নিজেরাও স্বাক্ষী দিবেন।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন—
আর প্রত্যেক ব্যক্তি উপস্থিত হবে, তার সাথে থাকবে একজন চালক ও একজন সাক্ষী। অবশ্যই তুমি এ দিবস সম্পর্কে উদাসীন ছিলে, অতএব আমি তোমার পর্দা তোমার থেকে উন্মোচন করে দিলাম। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি খুব প্রখর। আর তার সাথী (ফেরেশতা) বলবে, এই তো আমার কাছে (আমল নামা) প্রস্তুত। (ক্বাফ ২১–২৩)
প্রকাশ্যে-গোপনে, রাতের অন্ধকারে-দিনের আলোতে, জনসম্মুক্ষে-নিভৃতে যেখানে আমরা যে সামান্য আমল করি না কেন, সব আমলই ওই আমলনামায় উল্লেখ থাকবে। এটা একটি আয়াত দ্বারা আরো সুস্পষ্ট হয়।
আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহাফে এরশাদ করেন–
এবং উপস্থিত করা হবে আমলনামা এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে আতংকগ্রস্ত এবং তারা বলবে, ‘হায়, দুর্ভাগ্য আমাদের! এ আবার কেমন বই! তো ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয় নাই সে; বরং তা সমস্তহিসাব রেখেছে।’ তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে বিদ্যমান পাবে ; তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি জুলুম করেন না। (সূরা কাহাফ আয়াত–৪৯)
ক্রমশ..
লেখক, মুফতি ও সিনিয়র শিক্ষক, আল জামি’আ দারুল উলুম মাদরাসা, হাড়িনাল, গাজীপুর।