সর্বত্র পকিস্তানের হার
২৪ ঘণ্টা দূরত্বে ছিল সপ্তম নৌবহর
মানজুম উমায়ের :: সব জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনী হেরে যাচ্ছে। মিত্রবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে মিথ্যা অভিনয় করে আর কত দিন কাটানো যায়! মনে মনে ভাবছেন জেনারেল নিয়াজি। ঢাকা সেনানিবাসের যেখানে তিনি রয়েছেন, এই জায়গা আপাতত নিরাপদ। কিন্তু বিদেশি সাহায্য না এলে তো এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মাথার ওপর যে বিপদ ঘনিয়ে আসছে, এটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি জেনারেল নিয়াজির। টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন তিনি। এমন সময় বেজে উঠল ফোন। বুকের মধ্যে আলো জ্বলে উঠল নিয়াজির। ফোন ধরেই বললেন, কবে আসবে সাহায্য? অপর প্রান্ত থেকে জানতে পারলেন, আগামীকাল অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তর, দক্ষিণ—দুই দিক থেকেই বন্ধুরা এসে পড়বে। একটু স্বস্তি পেলেন নিয়াজি। ভাবলেন, আমরা যে ভয় পাইনি তা জানান দেওয়া যাক। বিদেশি সাংবাদিকদের তিনি বললেন, একটি প্রাণ জীবিত থাকা পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’
পাকিস্তান যেমন একদিকে সমর সাহায্যের প্রতীক্ষায় ছিল, তেমনি অপরদিকে তাদের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা কিসিঞ্জার ১১ ডিসেম্বর রাশিয়ার ওয়াশিংটন প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে ডেকে হুঁশিয়ার করে বলেন, পরদিন মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরদিন ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা মুখ থুবড়ে পড়ে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের দীর্ঘ বক্তব্যের পর অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়। এদিকে, ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টা দূরত্বে গভীর সমুদ্রে এসে থেমে ছিল সপ্তম নৌবহর।
সেদিন রাতে প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আলবদর ও আলশামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের ডেকে পাঠান সদর দপ্তরে। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় গোপন শলা-পরামর্শ। এই বৈঠকে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। ফরমান আলী তাদের হাতে তুলে দেন বুদ্ধিজীবীসহ বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকা।
যুদ্ধক্ষেত্রে ময়মনসিংহ অঞ্চলে মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভালুকা ও হালুয়াঘাট হয়ে ময়মনসিংহ সড়কের দিকে এগিয়ে যান। দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী খানসামা থানা আক্রমণ করে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১৫ জন ও সাত মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। তাদের হাতে এক মেজরসহ পাকিস্তানি বাহিনীর ১৯ জন ধরা পড়ে। এদিন নীলফামারী হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়।
জামালপুর থেকে পালিয়ে আসা কিছু শত্রুসৈন্য ও ময়মনসিংহ থেকে বিতাড়িত শত্রুরা টাঙ্গাইলে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামিয়ে দেয়। রাতে টাঙ্গাইলের ওপর আক্রমণ চালায় মিত্রবাহিনী। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কাদেরিয়া বাহিনী। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।
নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভারতকে পাকিস্তান ছেড়ে যেতে বলেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভূমি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি ঘোষণা করেন, কোনো শক্তি নেই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারে।
রেডিও পিকিং ঘোষণা করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের মাধ্যমে পাকিস্তান আক্রমণ করে মূলত চীনকেই দমন করতে চায়। বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার ভারতের মাধ্যমে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ সমর্থনের অন্যতম কারণ।
এপিআইয়ের জেনারেল ম্যানেজার সাংবাদিক নিজামউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। ওরা যখন বাসায় হানা দেয়, তখন তিনি বিবিসির জন্য সংবাদ লিখছিলেন। ঐ অবস্থায় ধরে নিয়ে আলবদররা তাকে হত্যা করে।
এদিন সকালেই মুক্ত হয়ে গেছে নরসিংদী। গত তিন দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ভারতীয় বাহিনীর পাঁচটি ব্যাটালিয়ন, দুটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও ৫৭ ডিভিশনের ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টার মেঘনা অতিক্রম করে। সুর্যাস্তের আগেই জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ভারতীয় জেনারেল নাগরার বাহিনী চলে আসে টাঙ্গাইলে। বিমান থেকে অবতরণ করা ছত্রীসেনারা মিলিত হয় নাগরার বাহিনীর সঙ্গে।