নিখিলের ধ্যানের ছবি।। পর্ব – ৭

নিখিলের ধ্যানের ছবি।। পর্ব – ৭

গত পর্বের পর

সহিষ্ণু মুহাম্মাদ সা.

একজন মহান রাসূলের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক যে, তিনি হবেন সহিষ্ণু, উদারমতি, প্রশস্ত বক্ষপঞ্জরের অধিপুরুষ, কোমল স্বভাবী, মধুর চরিত্রবান। যিনি ক্রোধানলকে নিমিষেই নির্বাপণ করবেন। পদস্খলিতকে মার্জনা করবেন। নিজের হকের বেলায় ছাড় দিবেন, আল্লাহর হকের ক্ষেত্রে নয়।

যারা তাঁকে নির্যাতন করেছে, নির্বাসিত করেছে, কষ্টজর্জরিত করেছে, গালমন্দ করেছে, যুদ্ধাহত করেছে, তিনি তাদেরকেও ক্ষমাভিক্ষা দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের দিনে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “যাও তোমরা মুক্ত।” চাচার ছেলে আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেস, যে মক্কাজয়ের দিন তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আল্লাহ তোমাকে আমাদের অগ্রনেতা বানিয়েছেন, এতদিন বুঝিনি, ভুলের মধ্যে ছিলাম,’ রাসূল সা. তাঁকে শুধু ক্ষমা করেই ক্ষান্ত হননি, বলেছিলেন, আজ তোমাদের উপর কোন প্রতিশোধ নেব না, আল্লাহই মাফ করবেন, তিনি পরম কৃপাময়।

বেদুঈনদের রূঢ়তা-রুক্ষতাও তিনি সয়েছেন, ক্ষমাসুন্দর নজরে দেখেছেন। ‘ক্ষমাগুণ অর্জন করুন’ প্রভুর এই আদেশের মূর্তরূপ ছিলেন তিনি। মন্দের শোধ মন্দে নয় ক্ষমার মাধ্যমে নিতেন। নিজের ক্রোধ প্রয়োগ করতেন না, নিজের ব্যাপারে প্রতিশোধও নিতেন না, বরঞ্চ রাগ যত বাঁধভাঙ্গা হতে চাইতো তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ততই মজবুত হতো। কেউ ক্রোধমূলক আচরণ করলে তিনি মৃদু হেসে দিতেন। একজন সাহাবীকে উপদেশ দিয়ে তিনবার বলেছিলেন, “রাগ দেখাবে না, রাগ দেখাবে না, রাগ দেখাবে না”।

বলতেন, আমাকে নিয়ে কিছু বলা হলে কেউ যেন তা আমাকে না বল, আমি নির্মল হৃদয়ে তোমাদের মুখোমুখি হতে চাই।

নিজের ব্যাপারে রটানো কুৎসা কানে আসতো তবুও তালাশ করতে যেতেন না কে রটিয়েছে? কেন রটিয়েছে? জানতে পারলেও কোন শাস্তি দিতেন না, তিরস্কারও করতেন না। বলতেন, আমাকে নিয়ে কিছু বলা হলে কেউ যেন তা আমাকে না বল, আমি নির্মল হৃদয়ে তোমাদের মুখোমুখি হতে চাই।

একবার ইবনে মাসঊদ রা. একটি কটুক্তির খবর তাঁকে জানিয়ে দিলেন, তাতে তাঁর চেহারা রক্তিম হয়ে গেলো। বললেন “আল্লাহ মুসার উপর রহম করুন, না জানি তাঁর স্বজাতি তাঁকে এরচেয়ে কত বেশি জ্বালাতন করেছে, তিনি সহ্য করে গেছেন”। বিরুদ্ধবাদিরা কষ্ট দিয়েছে, রেসালাতকে কেন্দ্র করে, মর্যাদাকে ঘিরে, পরিবারের ব্যাপারে কটাক্ষপাত করেছে, তিনি উদারতা দেখিয়েছন, ক্ষমা করে দিয়েছেন, বলেছেন, “ক্রোধকে যে দমন করবে আল্লাহ শাস্তিকে তার উপর থেকে অবদমন করবেন”।

একজন বলল, ন্যায় পরায়ণ হোন। জবাবে তিনি বললেন “ধ্বংস আমার, যদি ন্যায়বান না হয়ে থাকি” শুধু এইটুকুই বলেই ক্ষান্ত দিলেন, না ধমকি দিলেন, না শাসালেন।

তাঁর চরিত্রমাধুরিমায় উদারতায় প্রশস্ত হত মানুষের সঙ্কীর্ণ বক্ষতট, সহিষ্ণুতা দিয়ে নিভিয়েছেন শত্রুতার অগ্নিদাহ। “সুন্দর দিয়ে অসুন্দরকে প্রতিরোধ করুন, তারা কি রটাবে তা আমার ভালোভাবে জানা আছে” রবের এই আদেশ পালনার্থে।

পরিবারের সাথে ছিলেন সদালাপী, তাদের সাথে আমোদ-প্রমোদ করতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন, তাঁদের হৃদয়কে সুখ-আহ্লাদে ভরপুর রাখতেন। আনাস রা. বলেন, দশ বছর ধরে আমি তাঁর সেবা করে আসছি, কোন কিছু করলে কোনদিন বলেননি, ‘এটা কেন করলে?’ না করলে বলেননি, ‘কেন করলে না?’

হ্যাঁ, একেই বলে উদারতা, এর নামই সহিষ্ণুতা, এটিই চূড়ান্ত দয়া, করুণা, ভালোবাসা। বরং এর চেয়েও বেশি উদারতা প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর আপনজন আত্মীয়স্বজন।

একারণেই বহু হৃদয় তাঁর ভালোবাসায় জুড়ে থাকতো, আচ্ছন্ন হয়ে যেতো, বিভোর হয়ে থাকতো।

দয়ার সাগর

প্রভুই তাঁকে দয়াবান অভিধায় অভিহিত করে বলেছেন, ‘জগদ্বাসীর জন্য শুধুই দয়ারূপে আপনাকে প্রেরণ করেছি’।  মানবতার জন্য তিনি করুণা। বলেছেন, ‘আমি তো একখণ্ড করুণা’। কোন এক দৌহিত্রের মৃত্যুর সময় তিনি কাঁদলেন, কারণ জানতে চাওয়া হলে বললেন, ‘এ হচ্ছে এক ধরণের মায়া, আল্লাহ যার হৃদয়ে চান ঢেলে দেন, আর মায়াময়ের হৃদয়েই কেবল আল্লাহ মায়া দান করেন।’

দূরের কাছের সবার জন্যই তিনি করুণাময়। মানুষকে কষ্ট দিবেন? অসম্ভব। মানুষের দেখভাল করে বরং কষ্ট আরো লাঘব করতেন। নামাজ দীর্ঘ করতে মনস্থ করেছেন, পেছন থেকে শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনেছেন, মায়ের কষ্টের কথা ভেবে নামাজ সংক্ষেপ করে  নিয়েছেন।

কন্যা যয়নব তনয়া উমামা কাঁদছিলো, নামাযেই তিনি তাঁকে কোলে তুলে নিলেন, যখন সেজদা দেন তাকে রেখে দেন, দাঁড়ালে আবার কোলে নেন। সেজদায় গিয়েছেন নাতি হুসাইন তাঁর পিঠে চড়ে বসলেন, তিনি সেজদা দীর্ঘ করলেন। নামাজ শেষে স্বতঃস্ফূর্ত কৈফিয়ত, ‘আমার এই বাচ্চাটা পিঠে চড়ে বসেছিল, পড়ে যায় কিনা সেই ভয়ে আর মাথা উঠোইনি’। বলেন, ‘কেউ যদি ইমামতি কর তাহলে নামাজকে সংক্ষেপ করো, শিশু-বৃদ্ধ, নারী, কর্মব্যস্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ থাকে এখানে’।

মু‘আয রা. একবার লম্বা নামাজ পড়ালেন, তিনি তাঁকে বললেন, মানুষকে কি ফেতনায় ফেলবে মু‘আয? বলেন, ‘যদি উম্মতের কষ্টের কথা না ভাবতাম তাহলে নামাজে নামাজে তাদেরকে মেসওয়াকের হুকুম দিতাম’। মানুষের উপর ফরয হয়ে যায় কিনা সেই ভয়ে অনেক সময় নিজে আমল করা থেকে বিরত থাকতেন।  ভাষণ প্রদানকালে শ্রোতাদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। এ সবই আল্লাহর দেয়া রহমতে সম্ভব হয়েছে। বলতেন, ‘মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো’। ‘নিরেট নিরঙ্কুশ ধর্ম নিয়েই আমার আবির্ভাব’। ‘সহজতম ধর্মই শ্রেষ্ঠতম ধর্ম ’।

বলেন, ‘যে আমল করা সম্ভব না তা করতে যেওনা, আল্লাহ ত্যাক্ত হন না বরং তোমরাই ত্যাক্ত হও’। ‘দুটোর একটি নাও’ প্রস্তাবে সহজতরটিই বেছে নিতেন, যদি না তা পাপের কিছু হতো। তিনজন লোক ইবাদাতকে নিজেদের উপর চাপিয়ে নিয়েছিলো, তাদেরকে তিনি কঠোরভাবে নিবৃত্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, কসম, আমি তোমাদের সবারচে’ বেশি আল্লাহভীরু তাকওয়াপূর্ণ; অথচ দেখো, আমি নামাজ পড়ি আবার ঘুমোই, রোযা রাখি আবার রোযাবহীনও থাকি। এ আমার সুন্নাত, আর যে আমার সুন্নাত থেকে বিমুখ হবে সে আমার উম্মত না।

‘দুটোর একটি নাও’ প্রস্তাবে সহজতরটিই বেছে নিতেন, যদি না তা পাপের কিছু হতো

তিনি সফরে রোযা ভেঙ্গেছেন, চার রাকাতকে দু’রাকাত পড়েছেন, জোহর ও আসর একসাথে পড়েছেন(১), মাগরীব আর এশার মাঝেও সমন্বয় করেছেন।

বাদল মুখর দিনে মুয়াজ্জিনকে ঘোষণা দিতে বলতেন, সবাই যেন নিজ নিজ বাহনেই নামাজ পড়ে নেয়। বলেন, ‘খাদ্য গুদামজাতকারী ধ্বংস হোক’। বলেছেন, ‘কোমলতায় শোভিত করে, কঠোরতায় করে অশোভিত’। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. কে অতি তাপস্যমগ্নতা থেকে থেকে বারণ করে বলেন, ‘বাড়াবাড়ি থেকে সাবধান’!

বলেন, ‘আমার উম্মত রহমতে সিক্ত উম্মত’। ‘আমি কোনকিছুর আদেশ দিলে সাধ্যমত পালন করবে’। তাঁর জীবনের এই স্বভাবজাত সারল্য ও সহজতা ধর্ম ও শরিয়তের সাথে সুসামঞ্জস্যময়। এ তো তাঁর রবের কথন ‘আমি তোমার জন্য কল্যাণের পথকে সহজ করে দিবো’ এর নির্যাস, ‘আল্লাহ কারও উপর তার সাধ্যাতিত কোন কিছু চাপিয়ে দেন  না’ এর প্রয়োগিক চিত্র। ‘যথা সম্ভব আল্লাহকে ভয় করো’ এরই ফলন। ‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজ করতে চান তিনি তোমাদের তরে কঠিন করতে চান না’ এর অনুরণন। ‘তিনি দীনের মধ্যে তোমাদের উপর কষ্ট চাপিয়ে দেন দেননি’ এরই বাস্তবায়ন।

তিনি সহজ-সাধারণ। ঘরে-বাইরে, চালচলনে, পোষাক-আষাকে, পানাহারে, নামায, রোযায়, তাবৎ ইবাদতে তিনি ছিলেন রহমতের নিবিড় ছায়াময়। পুরো জীবনটাই তাঁর সহজতার ডানায় নির্ভর। উম্মতের স্কন্ধদেশ থেকে বোঝা হালকা করতেই যেন তাঁর আগমন। সুতরাং তিনি ছাড়া সহজতার কল্পনাও করা যায়না। তাঁর ধর্মবিভা ছাড়া সরলতাকে ভাবা যায়না। আপাদমস্তক তিনি ‘সহজ’। তাঁর সত্তা পুরোদস্তুর রহমত।

(১) লেখকের নিজস্ব মাজহাবী ব্যাখ্যা। হানাফী  ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাসূল সা. দুই নামাজকে  ভিন্ন ভিন্ন দুই সময়েই পড়েছেন তবে প্রথমটি  ওয়াকতের শেষ সময়ে আর দ্বিতীয়টি  ওয়াকতের প্রারম্ভে আদায় করেছেন। ফিকহের ভাষায় একে ‘জমা’ বাইনাস সালাতাইন’ বলে।  

 

( ক্রমশ…)

মূল: ড. আঈদ আল ক্বারনী

ভাবানুবাদ: আব্দুস সালাম ইবনু হাশিম
পরিচালক আত তুরাস একাডেমী ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমী। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ

সম্পাদনা: যারওয়াত উদ্দীন সামনূন
সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

Related Articles