বাড়ি বাড়ি ঢুকে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে ইসরাইল

বাড়ি বাড়ি ঢুকে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে ইসরাইল

  • গত ২৪ ঘণ্টায় ১২১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা
  • হামাসের হামলায় দুই ইসরাইলি সেনা নিহত
  • রাফায় ৮ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু : জাতিসঙ্ঘ
  • মতবিরোধে পদত্যাগের হুমকি ইসরাইলি মন্ত্রীর

অবরুদ্ধ গাজায় ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। রাফাসহ বিভিন্ন শহরে একাধারে বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। গাজার পরিস্থিতি এখন অতীতের যেকোনো সময়ের সময়ের চেয়ে ভয়ঙ্কর। ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে ঢুকে ঢুকে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। ইসরাইলের এসব হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন আরো ১২১ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি।
গাজা উপত্যকার জাবালিয়া শরণার্থী শিবির ও নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বহু মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন অনেকে। অল্প সময়ের ব্যবধানে চালানো হামলায় এসব মানুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া পূর্ব গাজার আল-দারাজ এলাকায় একটি বাড়িতে বোমা হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছেন। একই অঞ্চলের একটি স্কুলে বোমা হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন।

তা ছাড়া শনিবার গাজায় ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৬৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ১২১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আলজাজিরা বলছে, গাজাজুড়ে হামলার মাত্রা আরো বাড়িয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। শনিবার তারা কমপক্ষে ৬৪ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে উত্তর গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালের কাছে একটি আবাসিক ভবনে হামলা চালিয়ে ২৮ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। আহত হয়েছেন বহু মানুষ। এ ছাড়া উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রের গেটে জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার ঘটনায় ১২ জন নিহত ও আরো ২৫ জন আহত হয়েছেন। জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের পশ্চিমে ফালুজাহতে পানির জন্য লাইনে দাঁড়ানো লোকজনের ওপর ইসরাইল মর্টার সেল ইল আর্টিলারি হামলা চালালে আটজন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে হামলায় অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। অন্য দিকে দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরের একটি বাড়িতে হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন। উত্তর-পশ্চিম রাফাতে একটি গাড়িতে পৃথক হামলায় শনিবার আরো একজন নিহত হয়েছেন।

দুই ইসরাইলি সেনা নিহত :
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে আরো দুই সেনা নিহত ও চার সেনা গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দখলদার ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। নিহত সেনাদের মধ্যে একজনের নাম স্টাফ সার্জেন্ট নাখমান মেইর হাইম ভাকন (২০)। অপরজনের নাম স্টাফ সার্জেন্ট নোয়াম বিত্তান (২০)। তারা দু’জনই গিভাতি ব্রিগেডের গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্য ছিলেন।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, এই দুইজন এবং আরো দুই সেনা ও একজন কর্মকর্তা রাফাতে গত শনিবার প্রাণ হারায়। তারা হামাসের একটি সুড়ঙ্গের ভেতর ঢোকে। ওই সুড়ঙ্গের ভেতর বিস্ফোরক পুঁতে রেখেছিল হামাসের যোদ্ধারা। সেনারা সুড়ঙ্গের ভেতর প্রবেশ করামাত্রই সেখানে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই দুইজন নিহত হওয়ার মাধ্যমে গত ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ২৮২ ইসরাইলি সেনার মৃত্যু হয়েছে।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আরো জানিয়েছে, রাফাতে আলাদা একটি ঘটনায় ৫৮৩২ নম্বর কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের আরেক সেনা গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ছাড়া সেখানে আরপিজি দিয়ে একটি বুলডোজারেও হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরাইল। বর্তমানে গাজার রাফাহ ও জাবালিয়াতে হামাস ও ইসরাইলি সেনাদের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ হচ্ছে।

ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর স্বীকার করেছে, চলমান যুদ্ধের মধ্যে জাবালিয়ায় সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। কারণ জাবালিয়ার রাস্তাঘাটগুলো খুবই সরু। আর রাস্তা সরু হওয়ায় সেখানে ট্যাংক নিয়ে প্রবেশ করতে পারছে ইসরাইলিরা। কিন্তু হামাসের যোদ্ধারা হঠাৎ করে ইসরাইলি সেনাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ইসরাইল দাবি করছে, তারা রাফাহ ও জাবালিয়ায় হামাসের অসংখ্য সুড়ঙ্গের সন্ধান পেয়েছে। এখন সেগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে।

রাফায় ৮ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু :
গাজার দক্ষিণের শহর রাফায় গত সপ্তাহ থেকে অভিযান জোরদার করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এর পর রাফাহ থেকে অন্তত আট লাখ ফিলিস্তিনি জীবন বাঁচাতে পালিয়েছেন, উদ্বাস্তু হয়েছেন। এ তথ্য জানিয়েছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ। সংস্থাটির প্রধান ফিলিপ লাজারিনি শনিবার এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনিদের বারবার বাস্তুচ্যুতির ঘটনায় সমালোচনা করেন। ফিলিপ লাজারিনি বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় ফিলিস্তিনিরা বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তারা বারবার পালাতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু নিরাপদ আশ্রয় পাননি। এমনকি জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত নানা আশ্রয়কেন্দ্রেও তারা নিরাপদ ছিলেন না।

পদত্যাগের হুমকি ইসরাইলি মন্ত্রীর :
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজার জন্য একটি একটি যুদ্ধ-উত্তর পরিকল্পনা নির্ধারণ না করলে পদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছেন ইসরাইলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গ্যান্টজ। ছয়টি ‘কৌশলগত লক্ষ্য’ অর্জনে ৮ জুনের মধ্যে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন গ্যান্টজ। এসব লক্ষ্যের মধ্যে গাজায় হামাসের শাসন অবসান ঘটিয়ে সেখানে একটি বহুজাতিক বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা অন্যতম।
‘আপনি যদি জাতীয়কে ব্যক্তিগতের ওপরে রাখেন তা হলে এই সংগ্রামে আপনি আমাদের অংশীদার হিসেবে পাবেন। কিন্তু ধর্মান্ধদের পথ বেছে নিয়ে পুরো জাতিকে রসাতলে নিয়ে গেলে আমরা সরকার থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হব’- গ্যান্টজ এমনটি বলেছেন বলে তাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বিবিসি। নেতানিয়াহু এসব মন্তব্যকে থথ‘অর্থহীন কথা’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এর অর্থ হবে ‘ইসরাইলের জন্য পরাজয়’।

গাজা ভূখণ্ডের উভয় প্রান্তে লড়াই তীব্র হয়ে ওঠার মধ্যেই যুদ্ধের গন্তব্য নিয়ে ইসরাইলে রাজনৈতিক মতভেদ বেড়ে চলেছে। কয়েক দিন আগে ইসরাইলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভার আরেকজন সদস্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গাজায় বেসামরিক ও সামরিক শাসনভার নেয়ার কোনো পরিকল্পনা ইসরাইলের নেই, প্রকাশ্যে এমনটি জানানোর জন্য নেতানিয়াহুর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
গ্যালান্ট ও গ্যান্টজ বলছেন, গাজার ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখলে ইসরাইলের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে। অন্য দিকে নেতানিয়াহুর ক্ষমতাসীন জোট সরকারের কট্টরপন্থী সদস্যরা বিশ্বাস করেন, হামাসকে পরাজিত করতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা প্রয়োজন। শনিবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে গ্যান্টজ নেতানিয়াহুকে বলেন, ‘ইসরাইলের জনগণ আপনাকে দেখছে। আপনাকে অবশ্যই জায়নবাদ ও সিনিসিজমের মধ্যে, ঐক্য ও দলাদলির মধ্যে, দায়িত্ব ও নৈরাজ্যের মধ্যে, জয় ও বিপর্যয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে।’

তার নির্ধারিত ছয়টি ‘কৌশলগত লক্ষ্যের’ অন্যতম ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গাজায় এখনো হামাসের হাতে বন্দী সব ইসরাইলি ও বিদেশী বন্দীকে ফিরিয়ে আনা এবং বাস্তুচ্যুত বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের গাজার উত্তরাঞ্চলে ফিরিয়ে আনা। তিনি আরো বলেছেন, ‘ইরান ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে মুক্ত বিশ্ব ও পশ্চিমাদের সাথে একটি জোট গঠনের জন্য ব্যাপক প্রক্রিয়ার’ অংশ হিসেবে ইসরাইলের উচিত সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। গ্যান্টজের ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘গ্যান্টজের দাবি পূরণ করতে গেলে যুদ্ধ শেষ করতে হবে আর ইসরাইলের জন্য পরাজয়, বেশির ভাগ জিম্মিকে পরিত্যাগ করতে হবে, হামাসকে অক্ষত রেখে চলে আসতে হবে আর একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে।’

আরেক বন্দীর লাশ উদ্ধার :
ফিলিস্তিনের গাজায় তিন বন্দীর লাশ উদ্ধারের পর আরো এক বন্দীর লাশ উদ্ধারের দাবি করেছে ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, উদ্ধারকৃত হলেন রন বেনিয়ামিন (৫৩)। গত শুক্রবার তিন বন্দীর লাশ উদ্ধারের পরপরই উদ্ধার করা হয় ৫৩ বছর বয়সী রন বেনিয়ামিনের লাশ।
সূত্র: আল জাজিরা