- ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
অসীম পিয়াসী মানুষের মন অনন্ত এক সীমাহীনের মুতালাশী। গণ্ডির ঊর্ধ্বে মনকে উধাও করে দিয়েই সে তৃপ্তি খোঁজে। এতেই সে অপার্থিব পুলকে রোমাঞ্চিত হয়। অনন্ত আনন্দের উৎসমুখের প্রবল তাড়নায় নিয়তই সে উধাও, ঊর্ধ্বচারী তার প্রকৃতি। আকাশের নীলিমায় অসীমের ইঙ্গিত সে পায়, মহা এক ইঙ্গিতময় আহ্বানে নেচে উঠে তার তনু-মান-প্রাণ। মহা সঙ্গীত সুরে ভরে উঠে মন।
যা সে পায়নি, যাকে পাওয়ার আশা তার মনে, এরই জন্য তার প্রকৃতি সদা উদগ্রীব। অসীমে হারিয়ে যাওয়াতেই সে প্রাণ ফিরে পায়। সীমাবদ্ধতায়ই তার মৃত্যু। বরাবরই অস্থীর, উন্নয়ন প্রয়াসী তার মন অসীমে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত কোন স্তর, কোন মনযিলেই তার প্রকৃতি আটকে থাকতে চায় না। ‘ভাঙ্গ ভাঙ্গ কারা, আঘাতে আঘাতে কর’ বলে প্রবল এক আবেগবন্যায় সকল বাধা চারপাশের গণ্ডি ভাসিয়ে একাকার করে ছুটে চলে সে অসীমের মিলন উৎসের দিকে। তখন অসীমতার চিৎকারে বাঙময় আমি সমুক্ত, ‘খুলে গেছে মোর সব আবরণ, সব অবরোধ।
জাগতিক সবকিছু হতে ঊর্ধ্বে ওঠে যাওয়ার এই চেতনা মানুষের চিরন্তন সাধনার উৎস। এর পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রই তার কাছে অসহ্যকর, মৃত্যুর নামান্তর। উমর ছানী উমাইয়া খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আযীয বড় সুন্দর বলেছিলেন, তার খেলাফতের আমলে একবার তার জন্য সামান্য কিছু দিরহামের একটি কাপড় আনলে উনি বলেছিলেন, ‘বড় মিহি নিয়ে এসেছ, আরেকটু মোটা ধরনের হলে ভাল হত’। তখন তার খাদেম আশ্চর্য হয়ে বলল, হযরত! খলীফা হওয়ার পূর্বে বেশ কিছু দিরহাম দিয়েও যদি আপনার জন্য সবচেয়ে ভাল কাপড় বাছাই করে আনা হত, তখন আপনি বলতেন, বড় মোটা হয়ে গেছে, আরেকটু মিহি হলে ভাল হত । আর আজ একে মিহি বলছেন। উমর ছানী বললেন, ‘জান, বড় উচ্চাভিলাষী এবং উন্নয়নগামী আমার মন। যে কোন জিনিষই পেয়ে গেলে বড় ছোট মনে হত একে, জাগতিক স্তরের সর্বোচ্চ পদ সাম্রাজ্যও আমার হল। তাই আজ আমার মন পার্থিবতার ঊর্ধ্বে সেই অসীম অপার্থিবের উপরই রাজী হয়ে গেছে। অসীম পিয়াসী এখন আমি ।
পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও তার অনুভূতির উৎস সত্য। কিন্তু এ-ই তার শেষ কথা নয়, এ-ই তার চরম প্রাপ্তি নয়। সে উঠে আরো আরো ঊর্দ্ধে। চোখের দেখা যেখানে শেষ, চৈতন্যের দেখা তার আরম্ভ।
মানুষ তার চোখ যা দেখে, কান যা শোনে, হাত যা ধরে এতেই সন্তুষ্ট হয়ে থাকে না, থাকতে পারে না। দেখা-শোনা, ধরা-ছোঁয়ারও ঊর্দ্ধে সে ওঠে যেতে চায় এবং উঠেও। পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও তার অনুভূতির উৎস সত্য। কিন্তু এ-ই তার শেষ কথা নয়, এ-ই তার চরম প্রাপ্তি নয়। সে উঠে আরো আরো ঊর্দ্ধে। চোখের দেখা যেখানে শেষ, চৈতন্যের দেখা তার আরম্ভ। কানের শোনা যেখানে শেষ, চৈতন্যের শোনা তার আরম্ভ। হাতের স্পর্শবোধ যেখানে শেষ, চৈতন্যের স্পর্শবোধ তার আরম্ভ। তার লক্ষ্য যেমন অনন্ত ও সীমাহীন, তার চৈতন্যবোধও তেমনি অনন্ত ও সীমাহীন। সীমাহীনতাই এর শেষ।
ইয়া আইয়্যুহাল ইনসানু ইন্নাকা কাদিহুন ইলা রাব্বিকা কাদহান ফা মুলাকীহ— মানুষ! তুমি নিয়ত সংগ্রাম করে চলেছ। অনন্তর এই সংগ্রামের শেষ সীমাহীনের সাক্ষাতে অসীমের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়াতে। আর এই ঊর্দ্ধচেতনায়ই মেরাজের বোধিনী। আরবী ‘উরুজ’ ধাতু হতেই মেরাজ শব্দটি এসেছে। এর মানেই তো ঊর্দ্ধগামিতা। ঊর্ধ্বগামিতার চেতনা যেমন চিরন্তন; তেমনি মেরাজবোধও মানুষের চিরন্তন। ইসলামপূর্ব যুগেও বিভিন্ন জাতির মধ্যে এর ধারণা ছিল। হযরত ইবরাহীম, ইয়াকুব, মুসা এবং অন্যান্য নবীদের সম্পর্কেও এমন ধরনের ঘটনা তাওরাতে পাওয়া যায়। তবে যেহেতু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানবকুল শ্রেষ্ঠ, সকল নবীর সেরা। তাই তিনি সশরীরেই মেরাজ করতে পেরেছেন এবং এত ঊর্ধ্বে গিয়ে পৌঁছে ছিলেন যে, কারো পক্ষে আর তা সম্ভব হয়নি, হবেও না, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ।
আরও পড়ুন: বালাগাল উ’লা বি-কামালিহী, কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহী
নবীজির মেরাজ বিষয়ক ‘আহমেদ রেজা কাদরি’-এর প্রাণ জুড়ানো নাতটি শুনুন।