নিখিলের ধ্যানের ছবি (পর্ব-৩)

নিখিলের ধ্যানের ছবি (পর্ব-৩)

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকমের ধারাবাহিক সীরাত আয়োজন ‘ নিখিলের ধ্যানের ছবি’র আজ ৩য় পর্ব

কিশোর মুহাম্মাদ সা.

চরিত্রে, বীরত্বে, আস্থায়, বাগ্মিতায়, বুদ্ধিমত্তায় তিনি ছিলেন তারুণ্যের অনুসৃতজন, যুবকদের আদর্শ পুরুষ। একটি মিথ্যাও জীবনে বলেননি, একটি স্খলন, একটি পতন কিংবা একটি বিচ্যুতিও হয়নি কখনো।

আপাদমস্তক তিনি পবিত্র, ভেতর বাহির সর্বাঙ্গীণ তিনি সুন্দর, নির্জনে-কোলাহলে সর্বত্র তিনি অনাবিল, গাম্ভীর্যময়তায় তন্ময়। তাঁর সন্নিধান নিরুপদ্রব। তিনি বদান্য, তিনি উদার, তিনি মহান, তিনি মহাপ্রাণ। সত্যকথনের প্রবাদপ্রতীম। তিনি অনিন্দ্য, পরমেশ্বর।

শত্রুরা ওঁৎ পেতে থাকতো, ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের জাল বুনতো। অথচ হাজার চেষ্টা করেও তাঁর কোন খুঁত খুঁজে পায়নি, তাঁর চরিত্র মাধুর্যে দোষের কোন চিহ্ন পায়নি। যা পেয়েছে , তাতে বরং হিংসার অনলে আরো দগ্ধ হয়েছে।

তাঁর সিদ্ধান্তে তারা কেবল কল্যাণই দেখেছে, তাঁর চারিত্রিক খতিয়ানে কেবল স্বচ্ছতা আর নির্মলতাই পেয়েছে, তাঁর চলনে-বলনে কেবল পবিত্রতার ছাপই হেরিছে। তাঁর সততার ঔজ্জ্বল্য তো প্রভাকরকেও হার মানায়। তাঁর পবিত্রতার পরশে মেঘগলা জলও পরিশোধিত হতে চায়।

তিনি ছিলেন অনুপম চরিত্রের উচ্চমার্গে অধিষ্ঠিত, চারিত্রিক নির্মলতার শীর্ষচূড়ায় উন্নীত। কৈশোরেই তাঁর কাছে সমর্পিত হতো মুল্যবান আমানত, জিজ্ঞাসা করা হতো নানা সমস্যার সমাধান, প্রার্থনা করা হতো দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদের মীমাংসা। জ্ঞানে-গুণে, প্রজ্ঞা, সততা ও সভ্যতায় মানুষ তাঁকেই উপমা হিসেবে পেশ করত। “নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী” (কলাম: ৪)

এলেন রাসূল হয়ে

তাঁর জন্ম এক মহাসংবাদ। মহাপ্রলয়ের আগমনী বার্তা। বিশ্বময় বিস্ময়ের সুর। এক মহিমান্বিত উপাখ্যানের সূচনা। “তারা কোন ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে? মহাসংবাদ সম্পর্কেই তো, যে ব্যপারে তাঁরা মতবিরোধে লিপ্ত।” (নাবা: ১-৩)

সত্যিই তাঁর জন্মের সংবাদটি ছিলো সবচেয়ে স্পর্শময় সংবাদ। সকল খবরের শিরোনাম, চাঁদনী রাতের গল্পকথনের মূলকথা। ছিলো উটের কাফেলার গানেরদলে মিশে থাকা সুর। মহাকাল চমকে গিয়েছিলো যে সংবাদ শুনে। যামানা হয়ে পড়েছিলো আত্মহারা। ইতিহাস স্থির হয়ে গিয়েছিলো ক্ষণিকের জন্য। আনন্দের আতিশয্যে সূর্য তার কক্ষপথ ভুলতে বসেছিলো।

কোন আধাঁর গ্রাস করতে পারবে না তাঁর ইতিহাসকে। ধূসরিত করতে পারবে না কোন ধূলিঝড়, আড়াল করতে পারবেনা কালোমেঘ। পারাবার লঙ্ঘন করে, বনবাদাড় মাড়িয়ে, অবিনাশী গল্প হয়ে বেঁচে থাকবে তাঁর ইতিহাস আপ্রলয়। মেঘ হয়ে বর্ষিত হবে, রবি হয়ে কিরণ ছড়াবে। আর, কে কবে পেরেছে কিরণকে লুকিয়ে রাখতে? “তারা চায় আল্লাহর নূরকে ফুঁ দিয়ে নেভাতে আর আল্লাহ তাঁর নূরের বিভা দান কারী, যদিও তা তাদের অপছন্দনীয়”। (ছফফ: ৮)

তিনি আবির্ভূত হয়েছেন ‘লা শারীক লাহু’ খোদার আরাধনা করতে, একত্ববাদের প্রসার ঘটাতে, মহাবিশ্বে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ প্রতিপাদ্যের প্রচলন ঘটাতে। এসেছেন সত্যের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ধরতে, অসত্যের আস্ফালনকে মিটিয়ে দিতে। এসেছেন একটি আলোকিত পথ, শুভ্রধবল ধর্ম, প্রতিশ্রুতিশীল একটি জীবনবিধান সাথে নিয়ে। আবির্ভূত হয়েছেন ন্যায় ইনসাফ ও স্বজনবন্ধনের পরাকাষ্ঠা রূপে। প্রেরিত হয়েছেন শান্তি ও সৌহার্দের পয়গাম নিয়ে, সত্য ও কল্যাণের স্লোগান নিয়ে, প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-সমৃদ্ধির স্বপ্নচারী হয়ে। নিরাপত্তা ও আস্থার স্থপতি রূপে। এসেছেন পবিত্রতা, নামায, রোযা, হজ্জ্ব, যাকাত, জিহাদ সত্য ও অসত্যবোধের স্থৈর্য নিয়ে। প্রেরিত হয়েছেন তিনি চারত্রিক উৎকর্ষ ও উন্নত স্বভাবশোভার দৃষ্টান্ত রূপে। শিরকের নাম নিশানা মিটিয়ে দিতে, প্রতিমা গুঁড়িয়ে দিতে, পৌত্তলিকতার সমাধি রচনা করতে, মূর্খতার জাল ছিন্ন করতে, অত্যাচারীর খড়গ খর্ব করতে, বাতিলের রক্তলোলুপ চক্ষু উপড়ে ফেলতে। অন্যায়ের মূলে কুঠারাঘাত করতেই যেন তাঁর জন্ম। কোন ভালোকাজ নেই যার পথ তিনি দেখাননি। কোন খারাপ কাজ নেই যার পথ তিনি রুদ্ধ করেননি।

তাঁর চরিত্রমাহাত্ম্যর কথা কী আর বলবো? স্বয়ং আল্লাহ তাঁর চরিত্রে মাধুরী মিশিয়ে দিয়েছেন, মনোহারিতা ঢেলে দিয়েছেন। তাই তো তাঁর চরিত্র সবচেয়ে বিমল, তাঁর কথন সবচেয়ে নির্মল, তাঁর চলনভঙ্গি সবচেয়ে মানানসই, তাঁর বার্তা সবচেয়ে বাস্তবিক, তাঁর নির্দেশ সবচেয়ে ন্যয়সঙ্গত, তাঁর ভেতরটা সবচেয়ে পূতপবিত্র। তাঁর রীত ও চরিত সবচেয়ে মহিমাযুক্ত। তাঁর গুণ ও বৈশিষ্ট্য সবচেয় মধুর। তাঁর হাত দুটি সবচে দানশীল, তাঁর হৃদয়তট সবচে বিস্তির্ণ, বক্ষপিঞ্জর সবচেয়ে মায়াভরা। তিনি সবচেয়ে তাকওয়াপূর্ণ, খোদাভীতিতে সবচেয়ে বিগলিত, উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে সবচেয়ে সচেতন, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষায় সবচেয়ে তৎপর, বংশলতা সবচেয়ে সজিব, জাতিকুলে সবচেয়ে সম্মানী, সবচেয়ে অকাট্য যুক্তিবল সম্পন্ন, সবচেয়ে সাহসী, সবচেয়ে স্থৈর্যশীল, মননে চরিত্রে বংশে ধর্মে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠজন।

তিনি গুণে অনন্য, রূপে অনন্তর, প্রেমময়, সহজ সুন্দর বরকতময়। মহিমা টিকায় দীপ্ত ছিলো তাঁর ললাট, প্রতাপের ঔজ্জ্বল্যে জ্বলজ্বল করত তাঁর মুখচ্ছবি। তাঁর রূপ মূর্ত হয়ে ওঠতো নবুয়তের আলোকচ্ছটায়। হিরের পংক্তি ঝরত তাঁর দন্তপাটির উন্মীলনে। তিনি জীবন্ত হৃদয়ের ভাস্কর, পবিত্রতার এক পশলা মেঘ, মহানুভবতার এক সাগর ঢেউ, সুচিন্তনের শুদ্ধতম সংজ্ঞা।

তাঁর বক্ষপট যেন সহানুভূতি সিঞ্চিত এক বালুচর। লোকে তাঁর সঙ্গলাভ নিজের ভাগ্যোদয়ের কারণ মনে করত। তাঁর কাছে এসে আপনাকে ধন্য ভাবত। তাঁর ছায়ায় একটু শান্তি খুঁজে ফিরত। তিনি শুভঙ্কর পছন্দ করতেন, অশুভঙ্করকে অপছন্দ করতেন। তিনি মার্জনা করতেন, ক্ষমা করে দিতেন। তিনি দয়া দেখাতেন, দান করতেন। হু হু করে ছুটে চলা অবাধ সমীরণ থেকেও তাঁর দান ছিলো আরো গতিময়। অঝোর শ্রাবণের চাইতেও বর্ষিত হতো তাঁর মহিমা।

ডানা মেলা অষ্টমীর চাঁদের চাইতেও আলোকিত ছিলেন তিনি। নিজ চরিত্র মাধুর্যে সকল শুষ্কতা বিদূরিত করেছেন, মধুর মায়ামন্ত্রে সবাইকে আকৃষ্ট করেছেন। শান্তিময় দাওয়াতে মানবতাকে সুখময় জীবন দিয়েছেন।

যে তাঁকে এক পলক দেখেছে, ভালোবেসে ফেলেছে। যে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়েছ। যে কাছে এসেছে, সম্মানে নুইয়ে পড়েছে। তাঁর বলার ধরণ সবার মন কেড়ে নিত, তাঁর চরিত্র হৃদয়কে এক অজানা বন্ধনে আবদ্ধ করে নিত।

আল্লাহ তা’আলা তাঁর চিত্তে স্থৈর্য্যের সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন; তাই তিনি কখনো মচকে যাননি। তাঁর কথামালাকে সঠিকত্বের ছাঁকনিতে ছেঁকে দিয়েছেন; তাই তা সবসময় মূর্খতার স্পর্শন থেকে বিমুক্ত থেকেছে। তাঁর দৃষ্টিপটকে সুরক্ষিত করেছেন, তাই তাঁর চোখজোড়া খোশখেয়ালি থেকে মুক্ত রয়েছে। বাকশৈলী সর্বপ্রকার স্খলন থেকে সুরক্ষিত রয়েছে।

খোদ আল্লাহ তাঁর আনিত ধর্মের দেখভাল করেছেন, কাজেই তা ভণ্ডামোর আগ্রাসন থেকে রক্ষিত। এর যাবতীয় দায়দায়িত্ব তিনিই নিয়ে নিয়েছেন , কাজেই তা থেকেছে সুসংগত, সুসংযত, সুসংহত অবিলুপ্ত। “ নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের অধিপুরষ”। (কলাম:৪ ) “ আল্লাহর করুণা বলেই করুণাবলেই আপনি বিগলিত চিত্ত লাভ করেছেন”। (আলে ইমরান: ১৫৯)

তিনি বলেন “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর ভয়ে সবচেয়ে বেশি ভয়কাতর আমিই, এবং তাঁকে সবচেয়ে বেশি নিসঃন্দেহে আমিই জানি ”। বলেছেন, “পরিবারের চোখে যে সবচেয়ে ভালো, প্রকৃতপক্ষেই সে ভালো, আর আমি আমার পরিবারের চোখে সবচেয়ে ভালো”। আরো বলেছেন, “সচ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটাতেই আমার আবির্ভাব”।

‘ফাসুবহানা মান ইজতাবাহু’, প্রশংসিত তিনি, যিনি নিজে তাঁকে মনোনীত করেছেন, নির্বাচিত করেছেন, তাঁর দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁকে সুরক্ষা দিয়েছেন, তাঁর দেখভাল করেছেন, তাঁর জন্য যথেষ্ট হয়েছেন আর তাঁকে ফেলেছেন মধুর পরীক্ষায়।

(চলবে…)

মূল: ড. আঈদ আল ক্বারনী

ভাবানুবাদ: আব্দুস সালাম ইবনু হাশিম
পরিচালক আত তুরাস একাডেমী ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমী। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ

এই সিরিজের পূর্বের লেখাগুলো পড়ুন: 

১. নিখিলের ধ্যানের ছবি (পর্ব-১)
২. নিখিলের ধ্যানের ছবি (পর্ব-২)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *