- মুফতি ইয়াহইয়া শহীদ
আমাদের শৈশব মোবাইলের স্ক্রিনে বন্দী ছিলো না। আমাদের দুরন্ত শৈশব কেটেছে খেলার মাঠে। নানী-দাদীর কোলে বসে কিচ্ছা কাহিনী শুনে। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলা ছিল আমাদের নিত্যকার রুটিন। আমরা যারা একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম, মাঝেমধ্যে গুগলি ধাঁধা খেলতাম। আমাদের ধাঁধা খুব সাদামাটা ছিল; কারণ আমরা ছিলাম সাদাকালো যুগের শিশু।
আমাদের ধাঁধার কমন একটা প্রশ্ন ছিলো, একটা পুকুরে কত বালতি পানি থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা একেকজন একেকভাবে দিতাম। কেউ বলতাম— কত বালতি বলা সম্ভব না। একটু চালাকচতুর আমাদের যে বন্ধুটা ছিল, সে বলত— এক হাজার বালতি পানি থাকে, বিশ্বাস না হলে মেপে দেখো। আর সবচেয়ে ধুরন্ধর যে, সে উত্তর দিত; একটা পুকুরে কত বালতি পানি থাকতে পারে, এটা নির্ভর করে বালতির আকারের উপর৷ বালতির যদি পুকুরের মত বড় হয়, তাহলে পুকুরে এক বালতি পানি থাকবে, আর যদি বালতি পুকুরের থেকে অর্ধেক পরিমাণ বড় হয়, তাহলে পুকুরে পানি থাকবে দুই বালতি। আমরা তার কথাই মেনে নিতাম। আমাদের সরল মন মনে করত, এই ধাঁধার সঠিক উত্তর এটাই।
তারপর অনেক বছর কেটে গেলো। হঠাৎ একদিন এমনই এক প্রশ্ন করে বসলো আমার এক ছাত্র৷ ক্লাসে কী নিয়ে যেন আলোচনা করছিলাম, এক ছাত্র প্রশ্ন করলো— বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আলেম কে? প্রশ্ন শোনামাত্র আমার মনে পড়ল ছোটবেলার সেই ধাঁধার কথা; কিন্তু এখনকার ছাত্ররা আমাদের মতো সহজ-সরল না, তারা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কেবল কিছুটা সহজ-সরল, লেখাপড়া ছাড়া সব বিষয়েই তারা পটু। এই পটু ছাত্রদের আমার মতো সহজ-সরল শিক্ষক কীভাবে এতো কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিই; সেটা নিয়ে খানিক চিন্তা করে উত্তর দেওয়া শুরু করলাম। কারণ শিক্ষকদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।
আমি আমার ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, কে সবচেয়ে বড় আলেম, এইটা নির্ভর করে আমার পরিমাপের স্কেলের উপর। আমার পরিমাপের স্কেল যদি হয় ‘ইলিম-জ্ঞান’ তাহলে আমি সবার চেয়ে বড় আলেম বা জ্ঞানী হতে হবে, যেহেতু আমি নিজে বড় আলেম বা জ্ঞানী না, তাই কে বড় সে উত্তরটা দিতে পারছি না। আর যদি পরিমাপের স্কেল ভিন্ন হয়, তাহলে স্কেল অনুযায়ী উত্তর আলাদা আলাদা হবে। এখন তুমি সঠিক উত্তর জানতে হলে প্রথমে তোমাকে পরিমাপের স্কেল ঠিক করতে হবে, তারপর সে অনুযায়ী বড় কে খুঁজতে হবে।
পরিমাপের স্কেল যদি হয় স্যোশাল প্লাটফর্ম, তাহলে যার স্যোশাল প্লাটফর্মে অনুসারী বেশি সেই বড় আলেম। পরিমাপের স্কেল যদি হয় বয়স, তাহলে যার বয়স যত বেশি, সেই তত বড় আলেম। পরিমাপের স্কেল যদি হয় বেফাকের সিরিয়াল, তাহলে যে সিরিয়ালে যতো আগে, সে তত বড় আলেম। পরিমাপের স্কেল যদি হয়, সার্টিফিকেটের সংখ্যা, তাহলে যার সার্টিফিকেট যত বেশি, সে তত বড় আলেম। আমি আমার ছাত্রকে বুঝাতে চাইলাম, আসলে কে বড় আর কে ছোট সেটা নির্ণয় করার আগে তোমাকে পরিমাপের স্কেল বা মাপকাঠি কী, সেটা নির্ণয় করতে হবে। মাপকাঠি ঠিক করতে না পারলে বড়-ছোট আলাদা করা যাবে না, বড়-ছোট আলাদা করতে না পারলে মুরব্বি বা অভিভাবক ঠিক করা যাবে না।
আমাদের বড় সমস্যা যেটা সেটা হলো, আমাদের মুরব্বি বা অভিভাবক নির্ণয়ের মাপকাঠি ঠিক না। আমরা কেউ কেউ মাপকাঠি বানিয়ে ফেলেছি স্যোশাল একটিভিটি। যে যত বেশি স্যোশাল মিডিয়ায় একটিভ, আমরা তাকেই বড় মনে করা শুরু করছি। কেউ কেউ তো স্যোশাল মিডিয়ার ফলোয়ার সংখ্যা বা ভিডিওর ভিউ দেখে অভিভাবক নির্ণয় করা শুরু করে দিয়েছি। আবার কেউ কেউ জনপ্রিয়তাকে মাপকাঠি মনে করে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাক্তিকে নিজের অভিভাবক বানিয়ে ফেলছি। এই ট্রেন্ডটা শুরু হয়েছে মূলত আমাদের চিন্তার দৈন্যতা থেকে। ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ থেকে।
‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ থেকে যেরকম এদেশে হিরো আলমদের উত্থান হয়েছে বলা হয়, একই দুর্ভিক্ষের কারণে উত্থান হয়েছে স্যোশাল একটিভিস্ট শায়খদের। ‘পাবলিক খায়’ মনে করে আমাদের রাজনৈতিক মাঠে যেরকম খেলা হবে -এর প্রচলন শুরু হয়েছে, ঠিক একই ভাবে ‘পাবলিক খায়’ এই থিউরিতে ‘চিল্লায়া কন ঠিক কি না’ এসব প্রলাপ বকা শুরু হয়েছে ওয়াজের মাঠে।
পাবলিক যেভাবে খায়, সেভাবেই আমরা নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে শুরু করেছি। বৃত্তের বাইরে এখন আমরা চিন্তাই করতে পারছি না। পাবলিক আমাদেরকে একটা বৃত্তের ভেতরে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। আমরা এই বৃত্তকে উপেক্ষা করে কোনো কাজ করতে পারছি না, কেউ করলে সেটা মেনে নিতেও পারছি না।
তো এ বৃত্তের ভেতর থেকে ‘কে বড় কে ছোট’ নির্ণয় করা কঠিন। পুকুরের পানি মাপার বালতি যদি পুকুর থেকে বড় হয়, তাহলে পুকুরে যেরকম এক বালতি পানিও হবে না, ঠিক আমাদের বৃত্ত যদি একটু বড় করি, দেখবো কেউ-ই আসলে বড় না। সুতরাং বড় ছোট নির্ণয় করার আগে আসুন আগে বৃত্তের বাইরে যাই।
লেখক, শিক্ষক ও এক্টিভিস্ট