নিজামুদ্দীন ও শুরাপন্থীদের এখনও একত্র করা সম্ভব : আল্লামা মাসঊদ

নিজামুদ্দীন ও শুরাপন্থীদের এখনও একত্র করা সম্ভব : আল্লামা মাসঊদ

নিজামুদ্দীন ও শুরাপন্থীদের এখনও একত্র করা সম্ভব : আল্লামা মাসঊদ


আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ কয়েকদিন হলো পবিত্র হজব্রত পালন করে ফিরেছেন। হজের এই বিশ্বমিলনমেলায় সাক্ষাৎ হয়েছে আলোকিত অসংখ্য মানুষের সঙ্গে। যারা পৃথিবী চালান, পরিচালনা করেন। দ্বীনের খুঁটিগুলো্ও যারা পরিচর্যা করে থাকেন। বিশেষত তুচ্ছ কারণে বিশ্বতাবলীগ জামাতে ভাঙনের এই সময়ে হজের সফরটি ছিল খুবই তাৎপর্যরপূর্ণ। কারণ সেখানে বিশ্ব তাবলীগের আমীর মা্ওলানা সাদ কান্ধলবী, তাবলীগের বিখ্যাত মুরুব্বী মা্ওলানা আহমদ লাট, পাকিস্তানের মুফতীয়ে আজম রফী উসমানীসহ পৃথিবীবিখ্যাত আলেমদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। কী বলেছেন মা্ওলানা আহমদ লাট আর কী-বা তথ্য দিলেন মা্ওলানা সাদ। এ বিষয়েই পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডকটমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান ও ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার গ্র্যান্ড ইমাম শাইখুল হাদিস আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। পাঠকের সঙ্গে প্রতিশ্রুত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডকটমের সহযোগী সম্পাদক মাসউদুল কাদির। সঙ্গে ছিলেন কাউসার মাহমুদ। ভিডিও ও অডিও সহযোগিতায় ছিলেন শেখ মুহাম্মদ-


পাথেয় : আসসালামু আলাইকুম
আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ

পাথেয় : হজরত আপনি তো পবিত্র হজব্রত পালন করে এলেন কয়েকদিন হলো। সেখানে তো আপনার সঙ্গে পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত আলেমদের সাক্ষাৎ হয়েছে আমরা জেনেছি। তো কার কার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানি আল্লাহ তায়ালার ফজল ও করম। আল্লাহ তায়ালা একাধিকবার, বহুবার হজকে সামনে রেখে তার বায়তুল্লাহ যিয়ারতের তৌফীক দান করেছেন। এবারের যে হজের সফর ছিলো সেটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কুদরত এবং আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন বলেই হয়েছে। কারণ যাবার একদিন আগেও আমার সিদ্ধান্ত ছিলো না আর টিকেটের ব্যবস্থাও ছিলো না। এ অবস্থাটা হজের পুরো সময়টা আমি অনুভব করেছি। যে আল্লাহ তায়ালার কতো বড়ো কুদরত। আল্লাহ তায়ালার কতো বড়ো মেহেরবানি। আমি অসুস্থ ছিলাম। এর কয়েকদিন আগেই আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের দীর্ঘ সফর করে আমি ক্লান্তও ছিলাম। এরপরেও আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানি করে সমস্ত আমল করার তৌফিক দান করেছেন। এটি একমাত্র আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানি ও ফজল ও করম। তাই সমস্ত শোকরিয়া একমাত্র আল্লাহ তায়ালার।

এই সময় সারা পৃথিবী থেকেই বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে বড়ো বড়ো উলামায়ে কেরাম যারা আছেন তারা হজ করতে যান। সেসময় উলামায়ে কেরামদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং এটা একটা সুযোগ হয় পৃথিবীব্যাপী মুসলমানদের অবস্থা জানার এবং নিজেদের সঙ্কট সম্পর্কে পরস্পর আলোচনা করার। তো এবারও এমন একটা সুযোগ আমার হয়েছে। বহু উলামায়ে কেরাম ও ইসলামি স্কলারদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। উমান একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। ওমানের চার পাঁচ জন শায়খ আমি যেখানে ছিলাম সেখানো এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমার। আমাদের পরস্পরে মতবিনিময় হয়েছে এবং বর্তমানের প্রক্ষিতে মুসলমাদের করণীয় কী? এ নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

পাথেয় : তারাও কি তাবলীগ, দ্বীনি দাওয়াতি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্পৃক্ত। সবাই সম্পৃক্ত কি না আমার জানা নেই। এবং এখানে পাকিস্তানের মুফতীয়ে আজম আল্লামা রফী উসমানির সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। উনি আমাকে তার হাদীসের যত সনদ আছে মুসালসালাতসহ তা আমাকে দিয়েছেন। আমিও আমার যতো সনদ আছে মুসালসালাতসহ যা শায়খুল হাদীস হযরত যাকারিয়া রহ. থেকে তা হযরতকে দিয়েছি। তিরি তাঁর কিছু গ্রন্থও আমাকে হাদিয়া দিয়েছেন। তার সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি। আমিও আমার কিছু গ্রন্থ তাকে হাদিয়া দিয়েছি। এছাড়াও বাংলাদেশের বেশ কজন বড়ো বড়ো উলামায়ে কেরাম এবার হজে গিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়েছে। একটা পীড়ার বিষয় যে, সারা পৃথিবীব্যাপী তাবলীগ জামাতকে নিয়ে একটা অস্থিরতা চলছে। বিভক্তি চলছে। তো পৃথিবীর যেখানেই যে অবস্থাতেই হোক না কেন আমাদের বাংলাদেশে এটা একটা চরম আকার ধারণ করেছে। যেটা ভারতেও নেই, এমনকি পাকিস্তানেও নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এটি একটি চরম সঙ্কট আকার ধারণ করেছে। গ্রাম পর্যায়েও এই বিভক্তিটা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি মারামারি বা যার যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে ক্ষমতা ব্যবহারের ঘটনাও শুনতে পাচ্ছি। এটা যেই করুক, অবশ্যই নিন্দনীয় এটি।

তো এবার ছিলো দুই বছর অন্তর অন্তর বিশ্ব তাবলীগের পুনর্মিলন। যেটা হজকে কেন্দ্র করে সেখানে প্রতি দুই বছর পরপর হয়ে থাকে। তো এই উপলক্ষে দিল্লীর নিযামুদ্দীনের মাওলানা সাদের নেতৃত্বে এক বিশাল জামাত ছিলো। হিন্দুস্তানের অনেক আলেমগণ ছিলেন এখানে। এবং এর বিপরীতে অপরপক্ষ শুরাপন্থী হিসেবে প্রসিদ্ধ হযরত মাওলানা আহমাদ লাট সাহেবের (মা’আা) নেতৃত্বে এক জামাত ছিলো আলাদা। তারা উভয়পক্ষই যখন আমার সম্পর্কে জানতে পেরেছে, আমি হজে এসেছি। তারা আমার সাথে যোগাযোগ করে এবং আমাকে দাওয়াত দেয়। আমি হজের পরে ২৫ তারিখ মাওলানা সাদ সাহেবের ওখানে দাওয়াত রক্ষা করি এবং তাবলীগের বর্তমান সঙ্কট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় তাঁর সঙ্গে। প্রায় দুই আড়াই ঘণ্টা। তেমনিভাবে এরপর দিন সকালে হযরত মাওলানা আহমাদ লাট সাহেবের পক্ষ থেকে নাস্তার দাওয়াত করা হয়। আমি ফজরের সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওখানে যাই। তারা আমাকে নিয়ে যান। সেখানে তাবলীগের বর্তমান সঙ্কট প্রেক্ষিতে কি জরুরি এ নিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা আলোচনা হয়।

পাথেয় : আপনার কাছ থেকে আমরা শুনবো। তার আগে আরো একটি বিষয জানতে চাচ্ছি। মাওলানা সাদ কান্ধলবী দা:বা আলেমদের বড়ো একটি জামাত নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তো আমরা শুনতে পাই তার সঙ্গে কোনও আলেমই নেই।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এই কথাটা একটা বাড়াবাড়ি কথা। কারণ পৃথিবীর এমনকি হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানেও এই বিভক্তিটার রূপ আলেম এবং আওয়াম এ কথা নয়। আলেম এবং সাধারণ মানুষ যারা তাবলীগ করে তারা একপক্ষে আর আলেমরা একপক্ষে এভাবে বিভক্তিটা নয়। বিভক্তিটা মৌলিকভাবে যেটা হয়েছে হিন্দুস্তানে এবং পাকিস্তানে বা পৃথিবীর অন্য জায়গায়। সেটা হলো এই যে তাবলীগের একদল এমারতের মাধ্যমে তথা তাবলীগের প্রশাসনের দ্বারা তাবলীগ চলবে। আরেকদল বলেন, এখন এমারতের মাধ্যমে চলার সুযোগ নেই তাই এটি শুরার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। উভয়পক্ষেও বড়ো বড়ো আলেমগণ আছেন।

বাংলাদেশে বিষয়টি এমন যে এটি আলেম ও আওয়াম বিভক্তি হয়ে গেছে। অথচ, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেও কথাটা সত্য নয়। কারণ বাংলাদেশেও অনেক আলেম এমন আছেন যারা এমারাতের পক্ষে তাবলীগ পরিচালনা হওয়াটাকে অস্বীকার করেন না। আবার অনেক আলেমও শুরার পক্ষে তাবলীগের প্রশাসনিক দায়িত্ব পরিচালনা হওয়াকে অস্বীকার করেন না। সুতরাং বিষয়টাকে এভাবে বলা যে, এটা আলেম বা আওয়ামের বিষয় এটা ঠিক নয়। যারা এটা ছড়াচ্ছে তারা একটি বিভ্রান্তিমূলক কথা ছড়াচ্ছে। এমনকি যদি আপনি দেখেন শুরাপন্থীদের মৌলিক নেতা যিনি পাকিস্তানের হাজী আব্দুল ওয়াহাব সাহেব। উনি আলেম না। তিনি পাকিস্তানে দীর্ঘদিন যাবৎ তাবলীগের আমীর। সবাই মানে উনাকে, আর তাবলীগের ব্যাপারে উনার কুরবানীও অনেক। কিন্তু উনি মৌলিকভাবে কোনও আলেম না। এই আলেম না হওয়াটা, এমনকি আপনি আশ্চর্য হবেন।

পাকিস্তানের তাবলীগের ইতিহাসে প্রধান আমীর হয়েছেন খুব কম আলেমই। এর আগেও যিনি আমীর ছিলেন ‘বাবু বশীর সাহেব’। উনিও কিন্তু আলেম ছিলেন না। সুতরাং এখানে আলেম বা গায়ের আলেমের প্রশ্ন না বরং সবসময়ই দিল্লীতে আলেমদের নেতৃত্বেই তাবলীগের এ কাজ চলে আসছে। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. কত বড়ো আলেম ছিলেন, এ কথা সবাই জানেন। উনার পরে যিনি আমীর হলেন হযরত ইউসুফ রহ. তিনিও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বড়ো আলেম মুহাদ্দিস ছিলেন। এরপর হযরত এনামুল হাসান সাহেব। ইনিও অনেক বড়ো আলেম ছিলেন। এরপর বর্তমানে যে সাদ সাহেব দিল্লীতে আছেন। উনিও বড় আলেম। আবার উনার বিরুদ্ধাচরণ যারা করতেছেন মাওলানা আহমাদ লাট সাহেব, ইবরাহীম দিওয়ালা সাহেব উনারাও অনেক বড়ো আলেম। তো এই বিষয়টা আলেম বা জাহেলের বিভক্তি নয়।

পাথেয় : তাহলে কি এই বক্তব্য দ্বারা অন্যকিছু লুকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে? অর্থাৎ আলেম ও জাহেলের বিভক্তি’ এই কথাটা সামনে এনে কোনওকিছু লুকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কী?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : অসম্ভব কিছু নয়। কারণ এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। স্বভাবতই তাবলীগ যেহেতু দ্বীনের কাজ। আর দ্বীনের কাজের নেতৃত্ব থাকবে আলেমদের কাছে। এটা একটা অমূলক কথা নয়। এটাই হওয়ার কথা। সুতরাং সেখানে আলেম আর জাহেলের বিভক্তি চালালে সহজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। সেটাও হতে পারে বা অন্য কিছুও হতে পারে। আল্লাহ ভালো জানেন।

পাথেয় : আপনি মাওলানা সাদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলছিলেন। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের অনেকেই আমাদের পাথেয় টোয়েন্টিফোরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে যে, আপনি কি ম্যাসেজ দিতে চান। সারাদেশের মানুষ এই ম্যাসেজের অপেক্ষায় আছে। এই সঙ্কট কেউ দেখতে চায় না। যে সঙ্কট আমরা তাবলীগ জামাতের ভেতর দেখতে পাচ্ছি। মাওলানা সাদ সাহেবকে কেন্দ্র করে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে বিশেষত বাংলাদেশে। এই সঙ্কট দূর করার জন্য আসলে কোনও ম্যাসেজ আছে কি না!

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আমার ব্যক্তিগতভাবে উদ্দেশ্য ছিলো উভয়পক্ষের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত আলোচনা করা এবং বিষয়টিকে সুরাহা করা। তো এর কোনও সুরাহা করা যায় কিনা। এটাই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিলো। এই সঙ্কটের মূলটা কি? এটা দেখতে চেয়েছি।

আসলে বাংলাদেশে সঙ্কটটাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে মৌলিক সঙ্কট সেটা নয়। এমনকি বাংলাদেশে আমি শুনলাম আলেমদের কেউ কেউ মাওলানা সাদকে ফতোয়া দিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত থেকে খারিজ করে দিয়েছেন। তারা কোন পর্যায়ের আলেম আমার জানা নেই। কিন্তু আমি মাওলানা সাদকে নিয়ে উনার প্রতিপক্ষ যারা ছিলেন মাওলানা আহমাদ লাট সাহেব ও তার সঙ্গী যারা ছিলেন, প্রফেসর সানাউল্লাহ, ডক্টর আব্দুর রহমান, রায়বেন্ড মারকাজেরও একজন সাথী ছিলেন। এবং আরো যেসব বড়ো বড়ো আলেমরা ছিলেন কারো মুখেই আমি এ কথা শুনিনি যে মাওলানা সাদ আহলে সুন্নাহ থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। এবং সঙ্কট হিসেবে বলেনওনি।

বাংলাদেশে তো এটিকে সঙ্কট হিসেবে ধরছে এবং তাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত থেকে বের করে দিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের মুফতীয়ে আজম রফী উসমানী এবং ওমানের বড়ো বড়ে আলেম ও আরবের আলেমদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়েছে মা্ওলানা সাদের প্রতি তাদের অভিযোগ আছে। কিন্তু অনেকেই আছে আবার মাওলানা সাদের অনুরক্ত। তো যাদের অভিযোগ আছে তারাও এ কথা তুলছেন না যে মাওলানা সাদ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। এমনকি মাওলানা আহমাদ লাট সাহেব যেখানে ছিলেন। তিনি একটি বাসায় ছিলেন। সেখানে একজন আরব ছিলো। এছাড়া তেমন বড়ো কোনও আলেমদের সেখানে দেখিনি আমি। পক্ষান্তরে মাওলানা সাদের ওখানে দেশী বিদশী অনেক আলেমরা ছিলেন। সাউথ আফ্রিকা, শ্রীলংকান, ওমানের আলেমরা ছিলেন। এবং পাকিস্তানের মুফতী নঈম সাহেবও মাওলানা সাদের ওখানে অবস্থান করতে ছিলেন। আমার মনে হলো তিনি এখানে আছেন। তো যাইহোক আলেমরা মাওলানা সাদের সঙ্গে নেই একথাটা একটি বিভ্রান্তিমূলক কথা। সত্যের লেশমাত্র নেই। উভয় দিকেই আলেমরা আছেন। তো আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম। উনাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয় আমার। মাওলানা আহমাদ লাট সাহেব এবং শুরাপন্থী যারা আছেন তারা মাওলানা সাদের প্রতি মূল তিনটি অভিযোগ পেশ করেন। যে এই তিনটি বিষয়ে উনি পরিষ্কার হলেই তার সাথে একতাবদ্ধ হতে কোনও সমস্যা নেই।

তিনটি অভিযোগের প্রথমটি হলো : যে তাবলীগ মাওলানা ইলিয়াস রহ. থেকে মাওলানা এনামুল হাসান রহ.পর্যন্ত এক পদ্ধতিতেই চলে আসছিলো। মাওলানা সাদ মাশওয়ারা না করে, পরামর্শ না করে এই পদ্ধতিকে বদলে ফেলতে চাইতেছেন। নয়াতাবলীগ চালু করতেছেন। তো উনি যদি নয়াভাবে কোনও তাবলীগ চান। নতুন তাবলীগ করতে চান তবে করতে পারেন কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা চাই হযরত ইনআমুল হাসান রহ.পর্যন্ত তাবলীগ যে ধারায় চলে আসছে সেভাবেই চলুক। কিন্তু মাওলানা সাদ যদি তাবলীগের এই ধারায় ফিরে না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত তার সঙ্গে আমাদের কোনও মিল হতে পারে না।

দ্বিতীয় অভিযোগ : মাওলানা সাদ সাহেব যে আমীর হয়েছেন। এই আমীর হওয়াটা হযরত ইনআমুল হাসান রহ.তার শেষ জীবনে তৎকালীন মুরুব্বীদের সাথে পরামর্শ করে তাবলীগের এ কাজকে এমারত ভিত্তিক না করে শুরা ভিত্তিক করলেন। কিন্তু মাওলানা সাদ নিজেকে আমীর বলে প্রতিষ্ঠা করছেন। উনি যদি শুরাকে না মানেন। এমারতের উপর থাকতে চান। তাহলে মুশকিল।

এবং আরেকটা অভিযোগের কথা উনারা বলেন., মাওলানা সাদ উনার বক্তৃতায় (এটা বিশেষ করে আহমাদ লাট সাহেব বললেন) মশহুর তাফসীরের অনুসরণ না করে বিরল তাফসীরের কথা উনি আওয়ামদের সামনে বলেন। এতে আম্বিয়া আ. সম্পর্কে সাহাবা সম্পর্কে, আকাবীর সম্পর্কে এবং অন্যান্য বিষয়ে সাধারণ মানুষের ভেতর বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। যেহেতু সাধারণ মানুষের এই জ্ঞানটা নেই। সুতরাং এ বিষয়টা উনার পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ আমরা মানুষের কাছে উলামায়ে কেরামের মাশহুর তাফসীরটাই তুলে ধরবো। বিরল তাফসীর থেকে সংযত থাকবে।

ঠিক এমনিভাবে মাওলানা সাদও উনাদের প্রতি কোনও বৈরী মনোভাব রাখেন না। তিনি বলেম, আসলে আমি এমনটা চাইনি। আমি অনুরোধ করার পরও উনারা চলে গেছেন। এখন যদি আবার উনারা আসেন তাহলে আমি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত আছি।

পাথেয় : আমরা তো একটা ভিডিওচিত্রে দেখেছি হযরত ইবরাহিম দিউয়ালা সাহেবের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন মাওলানা সাদ কান্ধলবী।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : হ্যাঁ! তো এখন উনাদের মানে মাওলানা সাদ সাহেবদের যে কথা অর্থাৎ যে পর্যায়ে এখন তাবলীগ চলছে। এই তাবলীগকে নতুন কোনও পর্যায়ে নিতে চাচ্ছি না। আমি চাচ্ছি যে সীরাত এবং সাহাবায়ে কেরাম রা. এর অনুসৃত যে পদ্ধতি। আসলে তাবলীগের কাজটা আম্বিয়া আ. বিশেষ করে পেয়ারে হাবীব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে এটি পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। সাহাবায়ে কেরামের জীবনে এর বিকাশ ঘটেছে (আমি কিন্তু উনার হুবহু সব শব্দ বলছি না। উনার মনোভাব তথা উনি যা বলেছেন তার সারমর্মটা বলছি)। তো উনার কথা হলো আমি চাচ্ছি যে, তাবলীগের পদ্ধতি, মূলনীতি এবং যেকোনো সঙ্কট আসুক। সে সঙ্কটকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সাহাবায়ে কেরামের সীরাত অনুসারে তার সমাধাণ করা। কার কি অভিজ্ঞতা!

আল্লাহওয়ালাদের অভিজ্ঞতার ভেতর বহু বেশকম হতে পারে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয় হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত ও সাহাবাদের অনুসৃত পথ। আর প্রতিটা সঙ্কটেরই সমাধাণ সেখানে পাওয়া যায়। এবং এ বিষয়টিকে সামনে নিয়েই তাবলীগের দ্বিতীয় বিশ্ব আমীর হযরত ইউসুফ কান্ধলবী রহ. হায়াতুস সাহাবাহ রচনা করেছিলেন। আমি চাচ্ছি সাহাবাওয়ালী জিন্দেগির উপরে তাবলীগ উঠে আসুক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত অনুযায়ী। এবং এটা আমার মতামত (এটা মাওলানা সাদের কথা কিন্তু, আমার নয়) আর উনারা চাচ্ছেন অর্থাৎ সাদ সাহেবের অপরপক্ষে যারা আছেন যে হযরত ইলিয়াস রহ, হযরত ইউসুফ রহ ও হযরত এনামুল হাসান রহ. যেভাবে তাবলীগ করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ীই তাবলীগের কাজ চলুক। আর এটাতো উসূল হতে পারে না। উসূল হবে রাসূলের সীরাত সাহাবায়ে কেরামের জীবনী। আর এমারতের বিষয়টা নিয়ে তাদের যুক্তি হলো যে, হযরত এনামুল হাসান রহ. যে ১০ জনের শুরা করেছিলেন। এই ১০ জনের শুরাতে যাদের রাখা হয়েছিলো। হযরত এনামুল হাসান সাহেবের ইন্তেকালের পর মিয়াজী মেহরাবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। এই ১০ জনের একজন আমীর বানাবে।

এই কথা নয় যে এনামুল হাসান সাহেব রহ. ১০ জনের এমন একটি শুরা গঠন করে গেছেন। যে ১০ জন তাবলীগের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন। সেটা ঠিক নয়। বরং মিয়াজী মেহরাবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো এই ১০ জনের ভেতর ১ জনকে আমীর বানানোর জন্য। তো মিয়াজী মেহরাব তার অভিজ্ঞতা ও তার নিজস্ব চিন্তার আলোকে আমীর নিয়োগ না করে তিনজনকে আমীরে ফায়সাল নিয়োগ করেন। একজন মাওলানা ইজহারুল হাসান কান্ধলবী রহ., আরেকজন মাওলানা যুবাইরুল হাসান রহ, আরেকজন মাওলানা সাদ সাহেব। এই ১০ জনের মধ্যে এই তিনজন হলেন আমীরে ফায়সাল। তাহলে বুঝা গেল, এই ১০ জনের যে শুরা ছিলো এই ১০ জন তাবলীগকে পরিচালনা করার জন্য নয়। বরং হযরত উমর রা.যেভাবে শুরা বানিয়েছিলেন একজন খলীফা নিয়োগ করার জন্য। শেষ পর্যন্ত উসমান রা.কে তাদের মধ্যে নিয়োগ করা হলো। এটাও ছিলো এইরকম যে এনামুল হাসান সাহেব একজনকে আমীর না বানিয়ে একটি শুরা বানালেন। যে শুরার মাধ্যমে আমীর নিয়োগ করা হয়। অবস্থা প্রেক্ষিতে মিয়াজী মেহরাব অভিজ্ঞতার আলোকে সবচেয়ে পুরনো ছিলেন। হযরত ইলিয়াস রহ.-এর সঙ্গে তাবলীগ করেছেন। শুরায়ীদের মেম্বার ছিলেন।

উনি সবার সাথে ফায়সালা করে তিনজনকে বানালেন আমীরে ফায়সাল। অর্থাৎ ৩ জন তারা এমারতের মধ্যে আছে। তার মধ্যে মাওলানা ইজহারুল হাসান কান্ধলবীর ইন্তেকাল হয়ে যায়। তখন থেকেই মাওলানা যুবাইরুল হাসান সাহেবও ফায়সালার জন্য নির্ভর করতেন মাওলানা সাদ সাহেবের উপর। এবং দীর্ঘদিন যাবত প্রায় ২০ বছর ধরে মাওলানা যুবাইরুল হাসান সাহেব (উনি খুব উঁচু মাকামের মানুষ ছিলেন, নরোম প্রকৃতির ছিলেন) নিজে কোনও ফায়সালা না নিয়ে মাওলানা সাদ সাহেবের ফায়সালাকেই কার্যকর করেন। মাওলানা সাদের ফায়সালা অগ্রাধিকার দিতেন। কখনো এমন হয়েছে মাওলানা সাদ দিল্লীতে নেই, তখন তিনি নিজে ফায়সালা দিতেন না। বরং মাওলানা সাদের ফায়সালার অপেক্ষা করতেন। তো মাওলানা যুবাইরুল হাসান সাহেবের ওই তিন জনের মধ্যে মাওলানা সাদই বাকী আছেন। এবং দিল্লীতে যখন, তখন সেখানের অনেকেই তাকে আমীর হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। এবং পরে সম্ভবত ২০১৬ সালে যে ইজতেমা হয়। এ ইজতেমার মধ্যে পৃথিবীব্যাপী যারা তাবলীগ থেকে এলেন, মুরুব্বীরা এলেন। তারা সবাই মাওলানা সাদকে আমীর হিসেবে মেনে নিলেন।

আরেকটা বিষয় হলো তাবলীগের আমীর হওয়ার জন্য ১০০ পার্সেন্ট ভোট পেতে হবে এটা জরুরি না। এটা ভোটাভোটির প্রশ্নই না। তাহলে মাওলানা সাদ সাহেব বর্তমান শুরাকে কেন অস্বীকার করলেন! (উনাদের ব্যাখ্যা আমি বলছি। আমি কিন্তু আমার কোনও কথা বলছি না। তাদের ব্যাখ্যা দিচ্ছি) তাদের ব্যাখ্যা হলো এই, ওই যে শুরা এনামুল হাসান সাহেব বানিয়েছিলেন সেখানে আমীরে ফায়সাল হিসেবে ছিলেন মাওলানা সাদ শেষপর্যন্ত । আর সদস্য ছিলেন দুইজন। একজন পাকিস্তানের হাজী আবদুল ওহাব সাহেব আরেকজন মাওলানা সাদ সাহেব। এবং এটাও একটা ফায়সালা ছিলো যে,যে কোনও ফায়সালা নিতে হবে এ দুই জনের ঐক্যমতেই নিতে হবে। কিন্তু যে করেই হোক হাজী আ.ওহাব সাহেবের মাধ্যমে একটা শুরাকে বর্ধিত করা হলো। আর এক্ষেত্রে মাওলানা সাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয় নাই।এটা উনাদের দাবী। তাই পরে মাওলানা সাদ সাহেব এই শুরাকে মানেননি। শুরার স্বীকৃতি দেননি।

দুইজন জীবিত। এরমধ্যে একজন স্বীকৃতি দিছেন, আরেকজন স্বীকৃতি দেন নাই। এই প্রেক্ষিতে তো শুরাই গঠিত হয়নি। আসলে তাদের একেকজনের উপলব্ধির জটিলতা এটা। এখন একটা সূরত হতে পারে যে অসুবিধা কি মাওলানা সাদ সাহেব তাবলীগের এমারতি বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের মতো তাবলীগ করুক। তবুও তাবলীগের ঐক্যবদ্ধতা থাকুক। এবং এখানে তাবীর সত্য হওয়া সত্বেও অনেকে বলেন হযরত হাসান রা. তার দাবীকে পরিত্যাগ করে উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটা ভবিষৎবাণীও ছিলো। এরপর হযরত আমীরে মুআবিয়া রা.-এর উপর উম্মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলেন। এখানেও তো এমন হতে পারে, মাওলানা সাদ তার দাবী ছেড়ে দিতে পারেন। তো এইপক্ষ যেমন হযরত হাসান রা.ও হযরত মুআবিয়া রা. কে নমুনা পেশ করেন। অন্যদিকে উনারা আবার নমুনা পেশ করেন হযরত উসমান রা.কে। হযরত উসমান রা.কে বারবার এমারতের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের জন্য বলা হয়েছিলো। অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। অনেকে দাবীও করেছিলেন। কিন্তু হযরত উসমান রা.বলছেন যে তিনি মৃত্যুকে গ্রহণ করবেন কিন্তু এমারতের দায়িত্ব ছাড়বেন না। আর যে পোশাক আল্লাহ আমাকে পড়িয়েছে আমি নিজে তা খুলবো না। শেষপর্যন্ত উনি শাহাদাতকে কবুল করে নিয়েছেন কিন্তু দায়িত্ব ছাড়েন নি। কিন্তু সম্ভবপর হইতো যদি তিনি ছেড়ে দিতেন তাহলে শাহাদাতের ঘটনাটা আসে না।

উম্মতের এই বিভক্তির কথাটা আসে না। তাইলে উনাদের দাবি হলো, এমারতের দায়িত্ব যখন পেয়ে যায় তখন পদত্যাগ করাটা ঠিক নয়। আবার উভয়ের সঙ্গে আলাপ করার পর আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলো, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে প্রেক্ষিতে তারা উভয়দল পৌঁছে গেছে তাদের এক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। যদি আল্লাহ তায়ালা নিজের কুদরতে না করেন। তাই যুক্তি দিয়া উভয় দলকে এক করা খুবই ক্ষীণ। আমি মাওলানা আহমদ লাট সাহেবকে বারবার বলছি, যে আপনারা অন্য জায়গায় যেভাবে চিন্তা করতেছেন বাংলাদেশে কিন্তু ওরকম না। বাংলাদেশে ঘরে ঘরে, মসজিদে মসজিদে মারামারি শুরু হয়ে গেছে।

পাথেয় : আহমাদ লাট সাহেব কী বললেন?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : তখন তার পক্ষ থেকে মাওলানা আব্দুর রহমান সাহেব জবাব দিলেন যে, আমরা সবসময় বলি এই কথা। আমাদের আকাবিররা শিখিয়েছেন যে ‘মার খানা সুন্নত হে’ মার দেনা নেহি’। তো আমাদের সাথীদেরকেও এই কথা বলবো যে তারা যেনো মারামারিতে অগ্রসর না হয়। কেউ যদি তাদের মার দেয় তাহলে সে যেন মার খায়। অন্যকে যেন মার না দেয়।

পাথেয় : আমরা জেনেছি শুধু যে মার দিচ্ছে এমনও নয় বরং অপপ্রচারও চালাচ্ছে। আবার অনেকাংশে এমনও হয়েছে যে যাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে তারা জানেও না। সোশ্যাল মিডিয়াতে এইসব নানা জিনিস ঘুরছে।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : বাংলাদেশে সবচেয়ে বড়ে সমস্যা হলো, যে তাবলীগের সঙ্কটটা তাবলীগ ওয়ালাদের হাতে নেই। তাবলীগ ওয়ালাদের হাতে যদি হতো, তাহলে আমার মনে হয় এটির একটা সুরাহা বের হতো বা বর্তমানে যে মারাত্মক পর্যায় ঘটছে এটা হতো না।

পাথেয় : তাবলীগ ওয়ালা বলতে আপনি কাদের কে বুঝাচ্ছেন?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : তাবলীগ ওয়ালা বলতে আমি তাদেরকে বুঝাই, যারা তাবলীগে সময় লাগান। যারা তাবলীগ নিয়ে চলেন। এবং যারা তাবলীগ নিজের জীবনের একটি কাজ হিসেবে বানিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা কিছু রাজনৈতিক আলেমও এ বিষয়ে নাক গলানো শুরু করেছে। তাই সঙ্কটটা বেশী হয়েছে। নইলে হয়তো উভয়পক্ষের কেউই মাইরে আসতো না। বরং উভয়পক্ষই মার খেয়েই যেত। কিন্তু এখন বিষয়টা অত্যন্ত দুঃখজনক। যেভাবে মাদরাসার ছাত্র বা মাদরাসার বিষয়কে ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যবহারটাকে আমার পছন্দ নয়। এবং আমার যতটুকু পড়াশোনা এতে বোঝা যায় শরীয়তও এটাকে অপছন্দ করে। এবং আকাবিরে দেওবন্দ সম্পর্কেও আমার যে জানাশোনা তাদেরও এটা পছন্দ নয় ছাত্রদেরকে বর্তমানে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

পাথেয় : মাওলানা আহমাদ লাট সাহেবের মাত্র তিনটা অপিনিয়নের কথা আপনি বললেন?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আমি তিনটা বললাম মানে। তাদের সব কথার নির্যাস বললাম আলাপ তো হয়েছে প্রায় তিন ঘণ্টার মতো।

পাথেয় : কিন্তু বাংলাদেশে তো মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে তালিকার পর তালিকা করা হচ্ছে। এসবের সবই কি শরীয়তসিদ্ধ কি না এদিকেও অনেকের খবর নেই। ঘরে ঘরে এগুলো পৌঁছে দেয়া হচ্ছে এবং বিতর্কটা উসকে দেয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এইসব আলেমদের ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : মাওলানা আহমদ লাট সাহেব, মাওলানা ইবরাহিম দিওয়ালা সাহেব, হাজী আব্দুল ওহাব সাহেব তারাও তো দিতে পারতেন কিন্তু আমি তাদেরকে বা যেসব বড়ো আলেমদের সাথে আমার দেখা হয়েছে। তারা কেউই মাওলানা সাদের ব্যক্তিগত বিষয়টি নিয়ে কিছু বলে নাই। তারা বলছে যে এই তিনটা বিষয়ে তার ব্যাপারে আপত্তি এবং উনি নয়া তাবলীগ চালাচ্ছেন। বিশেষ করে এই কথাটায় তারা জোর দিয়েছেন বেশী। কারণ, দাওয়াত ও তাবলীগে উনি নতুন কিছু করতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশে মাওলানা সাদকে নিয়ে যেমন করা হচ্ছে এমন নীচতা আমি কোথাও দেখিনি।

পাথেয় : মাওলানা সাদ তো আর বাংলাদেশে নির্বাচন করবেন না! তাহলে তার বিরুদ্ধে এমন কুৎসা রটনা হচ্ছে কেন?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এটিই একটি আশ্চর্য বিষয় যে আমাদের উচিৎ ছিলো বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ইসলাম নিয়ে, মুসলমান নিয়ে এবং দেশের সঙ্কট নিয়ে কি অবস্থা তা ভাবা। এবং সামনে নির্বাচন আসতেছে এখানে মুসলমানদের বাংলাদেশের মানুষদের কি হতে পারে তাদের সামনে উন্নয়ন কীভাবে করতে পারা যায়। এসব পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা, অগ্রসর হওয়া। কিন্তু কোথায় দিল্লীর একজন লোক সে বাংলাদেশে আসলে হয়তো বছরে একবার আসবেন বা নাও আসতে পারেন। তাকে নিয়ে যেভাবে টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে, ওই যে এককালে আমরা দেখেছি বাংলা ভাষা ছেড়ে উর্দু নিয়ে যেভাবে টানাহেঁচড়া শুরু হয়েছিল। আলেমদের অবস্থা এখন এটাই। তো আমি বলবো বাংলাদেশে আলেমদেরই অনেকেই সবাই না কিন্তু। অনেকেই যুক্তির চেয়েও আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয় বেশী। হুজুগ দ্বারা পরিচালিত হয় বেশী। এদের বর্তমানের সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই আবেগতাড়িত।

পাথেয় : আমরা দেখেছি বাঙালি আলেমদের সাহু সেজদা দিতে হয়। অনেকাংশেই তাদের ফিরে আসতে হয়। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ফতোয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি তারা প্রথম বিরোধিতা করেছে ঠিক। কিন্তু পরে আবার ফিরে এসেছে। তেমনি স্বীকৃতি, যেটিকে এখন তারা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে এটিরও বিরোধিতা তারা করেছিল। এমনকি আশির দশকের আগে যে বাংলা ভাষার কথা আপনি বলছিলেন এ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধেও অনেকে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং যারা বিরোধিতা করেছিল তারা এখন পত্রিকাও বের করছে এবং নানাভাবে বাংলা ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্তও। মাওলানা সাদ সাহেবের এ বিষয়টিও তারা একসময় বুঝতে পারবেন কী?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হলো আন্তর্জাতিকভাবে এবং বিশেষভাবে হিন্দুস্তানে বর্তমানে মাওলানা সাদের যে অবস্থান। এ অবস্থান উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাবে আমার মনে হয়। তাবলীগ করবে আর দিল্লী মারকাজের বাইরে চলবে কাজ, এটা যারা সাধারণ তাবলীগ করে এরা এটা মানবে না। আর ছাত্রদের নিয়া বর্তমান বাংলাদেশে যে হুজুগ চলতেছে, এটা সাময়িক। বেশী হলে বছরখানেক বা দুই বছর চলবে। এরপর ছাত্রদের কাজ আছে, হুজুরদের কাজ আছে, উলাময়ে কেরামের নিজস্ব কাজ আছে তারা কি তা করবেন নাকি মারকাজ দখল করে চলবেন। এটা এভাবেই নিজে থেকে নিঃশেষ হয়ে যাবে আমাদের মনে হয়। যেহেতু তাদের সামনে নির্দিষ্ট কোনও আদর্শ নেই।

পাথেয় : এখন যে সঙ্কটটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। অনেকেই বলছেন সাধারণ মানুষ তাহলে কার কাছে যাবে। তো অনেকে উত্তর দিচ্ছেন। আপনি দেখবেন যে, কার কাছে আলেমদের সংখ্য বেশী। হক্কানী আলেমরা যেদিকে বেশী সেদিকেই আপনারা থাকবেন। তো আপনার বর্ণনানুসারে আমরা দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে মুজাহারার জায়গা এবং মুসলমানদের সংগঠিত হওয়ার জায়গা হজ। সে হজে মাওলানা সাদ কান্ধলবীর সঙ্গে সমগ্র পৃথিবীর বড়ে বড়ো আলেমগণ ছিলেন। আপনি দেখে এসেছেন। তো এই কথা কি আমরা বুঝতে পারি মাওলানা সাদ সাহেব একা নন। বিশ্বের বড়ো বড়ো আলেমরা তার সঙ্গে আছেন।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : উনি তো একা ননই এবং আমি যেটা বলতে চাচ্ছি যে এটা আলেম বা আওয়ামের কোনও সংঘাত নয়। বরং দু’দলেই বড়ো বড়ো আলেমগণ আছেন। এবং আপনি আশ্চর্য হবেন খোদ দারুল উলুম দেওবন্দ মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে কোনও ফতোয়া দেয়নি। মাওলানা সাদকে তারা পরামর্শ দিয়েছেন যে, এই এই কথাগুলো তোমার অতিরিক্ত হয়ে গেছে। এই কথাগুলো থেকে তুমি রুজু করো। ফতোয়া দিলে তো এই কথা বলেই দিতো যে মাওলানা সাদ এই কথা বলে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বাইরে চলে গেছেন। ফতোয়া দিয়ে দিতো। ফতোয়া তো হলো কোনও একটা সিদ্ধান্ত দেয়া। আর তার ব্যাপারে দারুল উলূমের কথার মধ্যে কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নেই। আরেকটা হলো এখন পর্যন্ত উলামায়ে দেওবন্দ (মূল দেওবন্দ) কিন্তু মাওলানা সাদকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বহির্ভূত বলে ফতোয়া দেয়নি। এমনি দেওবন্দের (দারুল উলূম ওয়াকফ, কারী তৈয়ব সাহেব রহ. যেটি করেছেন) তারা পরিপূর্ণভাবে মাওলানা সাদের সঙ্গে। বড়ো বড়ো উলামায়ে কেরাম আছেন সেখানে। এমনকি আমার আসাতেযায়ে কেরামও ছিলেন। তো এরপরে মূল দারুল উলূম দেওবন্দ সেখানকার বহু উলামায়ে কেরাম মাওলানা সাদ সাহেবের পক্ষে।

খোদ দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিশে শুরার অনেকেও মাওলানা সাদ সাহেবের পক্ষে আছেন। এমনকি জমিয়তে উলামা হিন্দ। হিন্দুস্তানে উলামায়ে কেরামের সবচেয়ে বড়ো দল তার মধ্যে অনেকেই মাওলানা সাদ সাহেবের পক্ষে। এমনকি শাহী মুরাদাবাদ মাদরাসা, সাহারানপুর মাদরাসা, নদওয়াতুল উলামা মাদরাসা যেসব প্রসিদ্ধ এর অধিকাংশই মাওলানা সাদের পক্ষে। বড় বড় মুফতীয়ানে কেরাম মাওলানা সাদ সাহেবের পক্ষে। সুতরাং এই ধরনের বিভক্তি যেটা আমাদের দেশে হয়েছে তা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। এটা সত্য না।

পাথেয় : তাহলে কি আমরা বলবো যে এই হুজুগীদের যে আন্দোলন তারা যে ‘ডোর ডু ডোর’ গিয়ে চেষ্টা করছে মাওলানা সাদ সাহেবের বিরুদ্ধে একটা বিষয় দাঁড় করাতে এটা একটি বাতুলতা।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : তাদের অধিকার আছে মাওলানা সাদের দোষ সম্পর্কে অর্থাৎ মাওলানার যে ত্রুটিগুলো আছে সে সম্পর্কে যে কোনও আলেমের আলোচনা করার অধিকার আছে। কিন্তু যে রূপে করছে এ রূপটা টিকবে না এটা টিকার পথ না। তাদের উপর যদি শরীয়তের কোনও কাজ সাদের হয়ে থাকে, যে কারো উপরই হয়ে থাকে এমনকি মাওলানা আহমদ শফী সাহেবের উপরও হয়ে থাকে তাও আলোচনা করার অধিকার একজন আলেমে হক্কানীর থাকে। আর ওই যে আপনি প্রথম বলছিলেন ‘যেইদিকে উলামায়ে হক্লানি আছে’ তো উলামায়ে হক্কানী তো উভয় দিকেই আছে। তাই না!

পাথেয় : আরেকটা বিষয় বিশেষত জানতে চাই, আপনার সাথে শুধু এই হজে না। আমরা জানি বিশ্ব ইজতেমায়ও বা অন্য জায়গায়ও মাওলানা সাদ সাহেব, আহমাদ লাট সাহেব বা ইবরাহিম দিওয়ালা সাহবের সঙ্গে অতীতেও আপনার সাক্ষাত হয়েছে। এবং আপনার সঙ্গে বেশ কথাবার্তা হয়েছে এবং আপনিও বলতে আগ্রহী। তো বাংলাদেশে অনেকেই আশাবাদী আপনি দেওবন্দে যাবেন এবং দিল্লী নিযামুদ্দীনে যাবেন এবং এই সঙ্কট দূরীভূতকরণে কোনও ধরনের প্রস্তাবনা নিয়ে আপনি কাজ করতে পারেন কি না। অনেকেই এমন আশাবাদ করছে।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : সেটা একটা পর্যায়ে ছিলো। আশা করা যাচ্ছিলো। কিন্তু এখন উভয় গ্রুপ যে পর্যায়ে গিয়েছে, আমার মনে হয় এই সফর দ্বারা বিশেষ কোনও উন্নতি হবে না। তবু আশা করছি।

পাথেয় : আমরা আশাবাদী হতে পারি। ভারতে মাওলানা মাহমুদ মাদানী আছেন আরো অন্যরা আছেন। তবুও বিশ্ব তাবলীগের এই সঙ্কট দূর হতে পারে কি না?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : অসম্ভব কিছু নয়। অসম্ভব বলা তো ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তায়ালার যখন রহমত হবে সে সময় জিনিসটা সুরাহা হয়ে যাবে। তবে বর্তমানে যে পর্যায়টা চলছে আমাদের দেশে। সে পর্যায়টা পার করতে হলে ধৈর্য এবং সময়ের দরকার। আমাদের দেশে হুজুগে থাকেন মৌলভী সাহেবরা। তারা সময়ের জন্য অপেক্ষা করতেও রাজী নয় ধৈর্যও ধরতে রাজী নয়।

পাথেয় : হযরত এ বিষয়ে আরেকটি প্রশ্ন, তা হলো আমাদের পল্লীগ্রামে যারা নতুন তাবলীগ করছে বা পাড়াগাঁয়ের একদম নতুন ছেলেটা যখন তাবলীগে সম্পৃক্ত হচ্ছে সে তো ‘তাবলীগ বিভ্রান্ত অবস্থায়’ দেখছে। তার জন্য আপনার বক্তব্য কী?

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : এটা আল্লাহ তায়ালার এক মেহেরবানি যে হযরত ইলিয়াস রহ.-এর মাধ্যমে তাবলীগের এমন একটা শেকেল আল্লাহ তায়ালা চালু করেছেন, যেটা যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো দেশে, যেকোনভাবে এটা করা সম্ভব। আরো বলবো এ কথা যে, ছয় উসুল ভিত্তিক যে তাবলীগ চলছে ওটা সে করুক। এ জন্য কাউকে আমীর মানা বা আমীর না মানলে তাবলীগ হবে না, বা শুরা মানা, এটা জরুরি না ওই বাচ্চার জন্য। এটা হলো কেন্দ্রীয় কোনও সিদ্ধান্ত না গেলে। কিন্তু তাবলীগের কাজকে তৃণমূল পর্যায়ে চালু করতে ছয় উসুলই যথেষ্ট।

পাথেয় : অনেক ধন্যবাদ হযরত, পাথেয়টোয়েন্টিফোর ডকটম এবং ইকরা মাল্টিমিডিয়ার পক্ষ থেকে। অনেক সময় দিলেন আজকে।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ : আপনাকে ও আপানাদেরকেও ধন্যবাদ।

02
সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়…ছবি : ইকরা মাল্টিমিডিয়া, শেখ মুহাম্মদ। বৃহস্পতিবার ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

এ সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তির ভিডিওটি দেখুন


এ সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় কিস্তির ভিডিওটি দেখুন



এ সাক্ষাৎকারের শেষ কিস্তির ভিডিওটি দেখুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *