নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা

নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা

সেলিনা আক্তার: আরাফাতের বয়স ১৩ দিন। মায়ের গর্ভ থেকে ৩২ সপ্তাহ পূর্ণ না হতেই তার জন্ম হয়। জন্মের পর সে কান্নাকাটি করছিল না। শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা ছিল। ওজন কম ছিল। চাঁদপুর জেলা শহরের রহমতপুর আবাসিক এলাকার ভূঁইয়া বাড়ির জয়নাল ভ্ূঁইয়ার ছেলে আরাফাত। জয়নাল ভূঁইয়া জানান, আরাফাতের মার ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয়, আর সতের বছরে সে মা হয়। তার স্ত্রী সবসময় অপুষ্টিতে ভুগতো। এজন্য তার ছেলেটাও সমস্যা নিয়ে জন্ম নিলো। অপুষ্টির পাশাপাশি তার ছিল ভয় – শুধু শুধু ভয় আর দুশ্চিন্তা।

শুধু আরাফাতের মা একা নয়। প্রায় সকল নতুন মায়েরা সন্তান জন্মের আগে ও পরে বিভিন্ন রকম দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন। ভয় পেতে থাকেন বিভিন্নভাবে। সঠিক পদ্ধতি না জানার ফলে নবজাতককে লালন পালন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। নবজাতকের যত্ন, পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত জন্মের পর থেকে ৪ সপ্তাহ বয়সী বাচ্চাকে নবজাতক বলা হয়। জন্মের সময় মায়ের গর্ভে বাচ্চার যদি পুরোপুরি ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক থাকে, কান্না করে ও যদি কোনো জন্মগত ত্রুটি না থাকে, তাহলে নবজাতককে সুস্থ বাচ্চা বলা হয়। আর যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, তবেই নবজাতক অসুস্থ।

নবজাতকের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, নবজাতকের পরিচর্যা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে হওয়া উচিত। তবে এর আগে থেকেই বিষয়টি অনেকটাই শুরু হয়ে যায়। ফলে শিশু মায়ের গর্ভে থাকতেই মাকে অ্যান্টিনেটাল পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন। মার উচিত চেকআপে থাকা। মূলত: তখন থেকেই বাচ্চার যতœ শুরু হয়। মাকে জানতে হবে বাচ্চার জন্মের পর পর তার শিশুকে কী খাওয়াবেন। মা বাচ্চার জন্য কী করতে পারেন। প্রথম থেকে শিশুর পরিচর্যার জন্য দরকার পুষ্টি, আর তা হলো মায়ের বুকের দুধ। দুধটা যেন বাইরের না হয়। বাচ্চা হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা দুধ খাওয়াতে বলি। মায়ের যে শালদুধ বের হয়, সেটি কোনোভাবেই ফেলে দেয়া উচিত না। শালদুধ বাচ্চার জন্য প্রথম টিকা। যেহেতু শাল দুধে প্রোটিন বেশি থাকে তা রোগ প্রতিরোধক্ষমতার জন্য খুবই জরুরি।

নবজাতকের রোগ ব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা বিষয়ে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, নবজাতকের নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। জন্মের পরপরই নবজাতকের বেশ কিছু অসুখ হওয়ারও আশংঙ্কা থাকে। ছোট শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বলে কিছু অসুখে তারা বেশি আক্রান্ত হয়। এ ধরনের অনেক অসুখ অল্প যত্নেই ভালো হয়ে যায়। কিছু অসুখের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় চিকিৎসকের পরামর্শ।

জন্মের পর অনেক শিশুর জন্ডিস দেখা দিতে পারে। এটা খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণত নবজাতকের জন্মের দুই দিন থেকে ছয় দিনের মধ্যে এই জন্ডিস দেখা দিতে পারে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে তা সেরেও যায়। এইসময় মায়ের দুধ শিশুকে বেশি করে খাওয়াতে হয় এবং সেই সঙ্গে সকালের হালকা রোদে শিশুকে খালি গায়ে কিছুক্ষণ রাখতে হয়। তাহলে শিশু দ্রুত জন্ডিসমুক্ত হয়। তবে শিশুর মাথায় যেন সূর্যের আলো সরাসরি না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুর জন্ডিসের আলাদা কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যদি জন্ডিস দেখা দেয় অথবা সাত দিন বয়সের পর জন্ডিস দেখা দেয় বা জন্ডিসের কারণে গায়ের হলদেটে ভাব যদি দিন দিন গাঢ় হতে থাকে, তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

কোনো কোনো নবজাতকের চোখ দিয়ে পানি ঝরতে পারে। তার জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। শিশুর নাকের গোড়ায় চোখের কোনা বরাবর আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করলে চোখ দিয়ে পানি পড়া সেরে যায়। তবে চোখের পানি যদি পুঁজ মেশানো হয় বা পুঁজের মতো হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই প্রয়োজন।

জন্মের পর অনেক শিশুর (ছেলে বা মেয়ে) স্তন ফুলে যায় এবং অনেক সময় নবজাতক মেয়েদের যোনিপথে রক্তক্ষরণ হতে পারে। সাধারণত চার দিন থেকে ১০ দিনের মাথায় রক্তক্ষরণ হতে পারে যা মায়ের হরমোনের প্রভাবে হতে পারে। রক্তক্ষরণের অন্যান্য কারণ যদি না থাকে, এই রক্তক্ষরণ নিজেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। এ ধরনের রক্তপাতে সাধারণত ভয়ের কিছু নেই। শুধু পরিষ্কার-পরিছন্নতা বজায় রাখা জরুরি। তবে প্রয়োজন মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

অনেকেই শিশুকে জন্মের পর গরম কাপড়, ভারি তোয়ালে ইত্যাদি দিয়ে পেঁচিয়ে রাখেন। অতিরিক্ত কাপড় পরানোর ফলে গরমে শিশুর গায়ে লাল দানা বা ফুসঁকুড়ি দেখা দেয়। এরকম হলে শিশুর শরীর ঘন ঘন কুসুম গরম পানি দিয়ে মুছে দিতে হয়। গায়ে বেবি পাউডারও মাখানো যেতে পারে। শিশুকে অতিরিক্ত কাপড় বাদ দিয়ে হালকা পাতলা আরামদায়ক সুতি কাপড় পরাতে হবে।

অনেক সময় শিশুর নাভি শুকিয়ে যাওয়ার পর নাভিমুখের নিচের মাংসপেশিতে ফাঁকের সৃষ্টি হয় এবং শিশু কাঁদলে বা কোঁত দিলে নাভি বেলুনের মতো ফুলে ওঠে। প্রথম কয়েক মাসে ফোলা বৃদ্ধি পেতে পারে, তবে পরে ফোলা সংকুচিত হতে হতে স্বাভাবিক হয়ে যায়। নাভি স্ফীতি কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে নাভি স্ফীতি খুব অস্বাভাবিক মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।

শিশুদের চোখের সাদা অংশ বা কনজাংটিভায় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। এ রোগে শিশুর চোখে পিঁচুটি বা পুঁজ দেখা যায় এবং চোখ লাল হয়ে যেতে পারে। কনজাংটিভাইটিস হলে চোখ বারবার পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হয় অথবা নরম কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। অনেক সময় এই প্রদাহ শিশুর অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।

নবজাতককে ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কোনো দুধ খাওয়ানো ঠিক নয়। ছয় মাসের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি নরম খাবার যেমন- বিভিন্ন ফলের জুস, কলা, আধা সিদ্ধ ডিম খাওয়ানো যেতে পারে। একসাথেই শিশুকে সবকিছু খাওয়ানো যাবে না। ধীরে ধীরে একটার পর একটা খাওয়ানো প্রয়োজন। চাল, ডাল, তেল মিলে খিঁচুড়ি খেতে দিতে হবে শিশুকে। পাশাপাশি শিশু হজম করতে পারে এমন পুষ্টিসম্পন্ন ঘরে তৈরি খাবার শিশুকে দিতে হবে।

জন্মের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মায়ের শালদুধ নবজাতকের খাওয়াতে হবে। দুধ খাওয়ানোর পদ্ধতি একজন ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। শিশু জন্মের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত একবার, ৭ দিন পর ও ৬ সপ্তাহ বয়সে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক পরীক্ষা করানো উচিত। প্রথম সপ্তাহে নবজাতককে গোসল করানো ঠিক না পরবর্তীতে গোসল করানোর জন্য স্বাভাবিক কিছু নিয়ম মেনে চললে শিশুর জন্য তা সহজ হয়। গোসলের আগে টাওয়েল রেডি করে, দরজা-জানালা বন্ধ ও ফ্যান বন্ধ করে, কুসুম গরম পানিতে বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি গোসল করিয়ে দ্রুত গা হাত পা মাথা মুছিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ঠান্ডা যেন না লাগে সেদিকে নজর রাখা জরুরি, আবার গরমও যেন না লাগে সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার।

মনে রাখা প্রয়োজন নবজাতক শিশুরা তাদের সমস্যা বলতে পারে না। তাদের একটাই ভাষা, আর তা হলো কান্না। তাই মাকেই বুঝার চেষ্টা করতে হবে, নবজাতকের কী সমস্যা এবং সে কী চাচ্ছে। তার কান্নার শব্দ শুনেই মাকে বুঝতে হবে বাচ্চার প্রয়োজন। আর সে অনুযায়ী মা নবজাতকের যত্ন নিতে পারলে মা-শিশু দুজনেই ভালো থাকবে। বিভ্রান্ত না হয়ে এবং ভয় না পেয়ে সহজভাবে নবজাতকের যত্ন নিলে নবজাতক ভালো থাকে আর শিশুর ভালো থাকার অর্থ মা’রও ভালো থাকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *