- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
কালজয়ী এক মহাপুরুষ ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী (রহ.)। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় যার জন্য। একজন ভিনদেশী নাগরিক বাংলাদেশের মজলুম মানুষের জন্য যার প্রাণ কেঁদে ওঠেছিল। পাক-হানাদার বাহিনীর জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে ওঠেছিলেন। নিরীহ বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে তাঁর প্রাণপণ চেষ্টা ছিল। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দুরে তাঁর বসবাস। কিন্তু বাঙালীদের প্রতি তাঁর প্রেম ভালোবাসার ছিল অন্তহীন। নির্যাতিত-নিপেড়ীত মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম ভুখন্ড না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিরাম-বিশ্রামহীন জীবন পার করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ত্যাগের শেষ নেই।
১৯৭১ সনে পাকিস্তানীদের জুলুমের কোন অন্ত ছিল না। মানুষ তো আশ্রহীন হয়ে পড়েছিল। একদিকে পাক বাহিনীর উপুর্যপরি নির্যাতন তথা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তারা। অন্যদিকে বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল তারা। মানুষ ছিল সহায়-সম্বলহীন। মাথা গোঁজার জায়গা ছিল না কারো। প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ। অন্ন- বস্ত্রের অভাবে রাস্তায় ঘুরেছে। কোথাও ঠায় পাবার আশায় দিকবিদিক হয়ে ছুটেছে। যারা ছিল ধন-বলের মালিক, বিত্ত- বৈভবে যাদের খ্যাতি ছিল সবখানে। কিন্তু হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ষ্টীম রোলারে পিষ্ট হয়ে তারা অসহায় হয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন পাড়ি জমায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে।
ফেদায় মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী (রহ.) তখন বাংলাদেশী স্মরণার্থী শিবিরে ত্রাতা হয়ে কাজ করেন। তিনি বাঙালীদের খেদমতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। সবসময় তাঁর সংগঠন জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের কর্মিগণ মজলুম বাংলাদেশীদের পাশে ছিলেন। তাদের খাদ্য-বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাছাড়া মজলুম ভাইদের সব সময় সাহস জুগিয়ে ছিলেন তারা। কেউ যেন সাহস হারিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে না পড়ে। কষ্ট-ক্লেশে আত্মহুতি না দেয়। বরং দেশ স্বাধীনের ব্যাপারে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় প্রাণবন্ত রাখার কোশেশ করতেন।
এরপর সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী বাংলাদের স্বাধীন সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য ভারত জুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। যিনি ভারতের একজন নাগরিক। কিন্তু বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের জন্য এমন অবদান রেখেছেন, যেটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মানবতার মুক্তির মোহনায় যেন তিনি অবতীর্ণ হয়ে বাঙালী জাতিকে বাঁচাতে তাঁর সীমাহীন প্রচেষ্টা। তিনি যেন পণ করে নিয়েছিলেন মজলুমকে রক্ষা করতেই হবে। সে কারণে তাঁর সংগ্রাম ছিল যথার্থ।
মূলত এমন একজন ব্যক্তির রক্ত তাঁর শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হত, যিনি এই ভারতবর্ষের মুক্তির মহানায়ক। ব্রিটিশ বাহিনীর নাগপাশ থেকে যেভাবে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার লাল সুর্য উপহার দিয়েছিলেন। সেই মহান ব্যক্তি আওলাদে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কুতবুল আলম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)। তাঁরই সাহেবজাদা ছিলেন ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)।
সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী তিনি দুইশত বছর ধরে গেঁড়ে বসা ব্রিটিশ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন। যখন ভারতবর্ষকে গিলেফেলেছিল ব্রিটিশগণ। হাজার হাজার আলেমের রক্তে রঞ্জিত ছিল ভারতবর্ষের মাটি। যে মাটি থেকে গন্ধ বের হত আলেমদের রক্তের। সারা দেশজুড়ে রক্তের হোলি খেলেছিল তারা। একদিন – দুদিন নয়। পুরো দুইশত বছর তারা অমানবিক নির্যাতনে পিষ্ট করেছিল এদেশের মানুষকে। সেই সংকটকালে বড় ভুমিকা রেখেছিলেন সাইয়্যেদ মাদানী। তাঁর পূর্বসূরীদের হাতে শপথ নিয়ে শুরু করেছিলেন সংগ্রাম। নিজ উস্তাদের সাথে মাল্টার কারাগার, এরপর ভারতের কারাগারে তাঁর জীবন কেটেছিল বছরের পর বছর। সীমাহীন-ত্যাগ আর কোরবানির বিনিময়ে স্বাধীনতার দ্বার উম্মোচন হয়েছিল।
বাপকা বেটা ছিলেন ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী। বাপের মত তাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠেছিল বাঙালী জাতির মুক্তির জন্য। তিনি ফুঁসে ওঠেন পাক-বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। সারা দেশে তিনি ৩০০ থেকে মিছিল-মিটিং করেন। পাকিস্তানীদের জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাঁর প্রতিবাদগুলো পৌছে যায় বিশ্ব দরবারে।
তাঁর প্রতিবাদগুলো ছিল যথার্থ। যুক্তি সংগত। কেননা, যে অন্যায় পাকিস্তানিরা করেছিল, যেভাবে লুটপাট এবং ধর্ষণের মহোৎসব ঘটিয়েছিল, তাতে বহির্বিশ্বের থেকে প্রতিবাদগুলো ফলাও হয়েছে। যেটা পৌছে বিশ্ববাসির কাছে। এবং পাকিস্তানিদের প্রতি মানুষের ঘৃনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হতে সহায়তা হয়েছে।
আরো বড় কর্মসূচি ছিল আসআদ মাদানী সাহেবের। আমেরিকা যখন সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেছিল পাকিদের সহায়তায় এবং বাঙালীদের কোণঠাসা করার জন্য। সেসময়ে তিনি পঞ্চাশ হাজারের অধিক মানুষ নিয়ে দিল্লিতে আমেরিকার দুতাবাস ঘেরাও করেন। এক বড় ধরনের প্রতিবাদ ছিল সেটা। যাতে টনক নড়ে ওঠেছিল তাদের।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। একটি স্বাধীন ভুখন্ডের আলো বাতাসে আমরা এখন ধন্য। দারুল দেওবন্দের সুর্যসন্তান এবং মাদানী পরিবারের অবদান আজো ইতিহাসের পাতায় জ্বল জ্বল করছে। তাঁর সেই ত্যাগ ও কোরবানি আজো স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। সেই মহান বীর, রণক্লান্ত মুজাহিদের কথা মনে পড়ছে বারবার। মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে ফরিয়াদ করি, জান্নাতের সুউচ্চ মাকামে তিনি অধিষ্টিত হোন। এই কামনা রইল। আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট