সিমলায় বাংলাদেশ ও ভারতের বৈঠকে থাকছে আরএসএস’ও

সিমলায় বাংলাদেশ ও ভারতের বৈঠকে থাকছে আরএসএস’ও

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ভারত ও বাংলাদেশ- উভয় দেশের এমপি, নীতিনির্ধারক ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোকে নিয়ে দুই দিনের একটি হাই-প্রোফাইল সংলাপ আজ (শুক্রবার) থেকে ভারতের হিমাচল প্রদেশের শৈল-শহর সিমলাতে শুরু হচ্ছে।

তাৎপর্যপূর্ণভাবে ‘ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ডায়ালগ’ নামে পরিচিত এ প্ল্যাটফর্মে আরএসএস নেতারাও এবার যোগ দিচ্ছেন- যে সংগঠনটি ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক হিসেবে পরিচিত।

শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি করেছেন শুভজ্যোতি ঘোষ।

এ সংলাপে ভারতের পক্ষ থেকে অংশ নেবেন, এমন একাধিক রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ জানান, সম্প্রতি যে সব বিষয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অস্বস্তি বয়ে এনেছে, সেগুলো কীভাবে আরও ভাল করে ‘অ্যাড্রেস’ করা যায়, তা নিয়েও সিমলাতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হবে।

ভারত-বাংলাদেশের এই মৈত্রী সংলাপটিকে আয়োজকদের অনেকেই অবশ্য পুরোপুরি ‘ট্র্যাক-টু’ বলতে রাজি নন। কারণ, উভয় দেশের মন্ত্রী-আমলারাও নিয়মিত এতে যোগ দিয়ে থাকেন।

এবারের বৈঠকেও থাকছেন বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীরা, যথাক্রমে শাহরিয়ার আলম ও রাজকুমার রঞ্জন সিং।

আমন্ত্রিত বক্তাদের মধ্যে আছেন দিল্লিতে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান ও তার পূর্বসূরী তারিক করিমও। দেখা যাবে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মোবিন চৌধুরীকেও।

গত সাত-আট বছর ধরে এই প্ল্যাটফর্মটি মূলত দুই দেশে ক্ষমতাসীন দুই দল- বিজেপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে মতবিনিময়ের মঞ্চ হিসেবেই কাজ করে এসেছে।

এবার যারা বিজেপির পক্ষ থেকে অংশ নিচ্ছেন, তাদেরই অন্যতম দলের সিনিয়র এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর।

আকবর বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এ উদ্যোগটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, বেশ কয়েক বছর ধরেই হয়ে আসছে। একবার ভারতে, আর অন্যবার বাংলাদেশে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হচ্ছে। আর বেশ উঁচু পর্যায়েরই প্রতিনিধিত্ব থাকছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে নতুন চ্যালেঞ্জগুলো আসে, যেগুলো আমাদের বিরক্ত করে- স্বভাবত সেগুলো নিয়েই এখানে কথাবার্তা হয়। সোজা কথায়, দুটো বন্ধু দেশ নিজেদের মধ্যে সেরা সম্পর্কের লক্ষ্যে সন্দেহের মেঘগুলো দূর করার চেষ্টা করে।’

গত বছর অক্টোবরে দুর্গাপুজার সময় বাংলাদেশে মণ্ডপ ভাঙচুর বা হিন্দু নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কে ঠিক এরকমই অস্বস্তি বয়ে এনেছিল।

সে সব নিয়েও সিমলাতে আলোচনা হবে কিনা এ প্রশ্নে এম জে আকবর বলেন, ‘আসলে যে কোনও ইভেন্ট বা ঘটনাই কন্ডিশনস বা শর্ত তৈরি করে। আমাদের দেশেও একই ব্যাপার হয়, কেউ একটা কিছু ভাষণ দিল বা কিছু বলল- অন্য পারে তার অভিঘাত হয়, বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।’

তিনি বলেন, ‘আর তাছাড়া আমরা দুটো কাছাকাছি ও ঘনিষ্ঠ দেশ- দুটোই স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। ফলে কিছু না কিছু (আলোচনা) হওয়াই তো স্বাভাবিক।’

কুমিল্লা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা নিয়ে গত বছর তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল আরএসএসের মুখপত্র ‘দ্য অর্গানাইজার।’

ওই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক প্রফুল্ল কেতকারও এই প্রথমবারের মতো ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংলাপে যোগ দিচ্ছেন।

এছাড়াও থাকছেন আরএসএস কর্মসমিতির প্রভাবশালী সদস্য রাম মাধবও, যিনি গত প্রায় আট বছর ধরে এই সংলাপ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

মাধব অবশ্য বিবিসি বাংলাকে পরিষ্কার জানিয়েছেন, এই প্ল্যাটফর্মে দুই দেশের একান্ত নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় না। কাজেই কুমিল্লার ঘটনা সিমলাতে কোনও ছায়াপাত করবে বলে তিনি মনে করেন না।

বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত সিমলা যাওয়ার পথে বিবিসিকে বলেন, সংলাপে আরএসএসের থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কিছু ঘটনার পটভূমিতে।

তার কথায়, ‘এই তো দেখলাম গতকালও বোধহয় বরিশালে একটি মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বিচ্ছিন্নভাবে এদিক-ওদিক এরকম ঘটেই চলেছে- যদিও আমাদের সবারই ধারণা বাইরে থেকে সরকার-বিরোধী শক্তিরাই এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে করাচ্ছে।’

কিন্তু এই পটভূমিতে একটা ডায়ালগের অবকাশ ও প্রয়োজন বোধহয় থেকেই যায়- যেখানে পরস্পরের মধ্যে খোলাখুলি কথা বলা যায়, সরকারি প্ল্যাটফর্মে যে কথাগুলো বলা যায় না, সেগুলো বলার জন্য আলাদা একটা স্পেস লাগে বলে মন্তব্য করেন শ্রীরাধা দত্ত।

তিনি বলেন, ‘মৈত্রী সংলাপের আগের প্রায় সবগুলো রাউন্ডে অংশ নেয়ার সুবাদে বলতে পারি, এই প্ল্যাটফর্মটা আমাদের ঠিক সেই সুযোগটাই করে দেয়। বিশেষ করে, যখন আমরা দুই পক্ষের সবাই সবাইকে খুব ভাল করেই চিনি।’

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘এই ক্রিটিক্যাল সময়ে একদিকে আরএসএস ও অন্য দিকে বাংলাদেশের একটা হেভিওয়েট টিম- সে দেশের মন্ত্রী, এমপিরাও যেখানে থাকছেন, তাতে মনে হচ্ছে দুই পক্ষই নিজেদের সমস্যাগুলো মেটানোর একটা আন্তরিক চেষ্টা চালাচ্ছেন।’

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক এবং সংসদ সদস্য মির্জা আজম ও অসীম কুমার উকিলও এই সংলাপে থাকছেন।

ঢাকার ‘বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর রিজিওনাল স্টাডিজ’ দিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই সংলাপের আয়োজন করছে।

এই আলোচনায় যে তিনটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা থিঙ্কট্যাঙ্ক ভারতের পক্ষ থেকে থাকছে, তার অন্যতম শিলংভিত্তিক এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স।

ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সব্যসাচী দত্ত বলছিলেন, বাণিজ্য বা কানেক্টিভিটি আরও বাড়াতে কিংবা দুই দেশের মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতেও তারা কাজ করার চেষ্টা করবেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এটা আসলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে পরবর্তী স্তরে উত্তরণের চেষ্টা।’

সম্প্রতি বাণিজ্য ও কানেক্টিভিটি বাড়াতে দুই দেশের সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে- বহু বন্দর, আইসিপি তৈরি হয়েছে বা রেল, নদী ও সড়কপথে নতুন নতুন রাস্তা খুলেছে।

এখন এগুলোকে ভিত্তি করে কীভাবে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও লগ্নি বাড়াতে পারি, এগুলোর ওপর ‘বিল্ড-আপ’ করতে পারি, তা নিয়েই আলোচনা হবে বলে জানান সব্যসাচী দত্ত।

এশিয়ান কনফ্লুয়েন্সের সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘পাশাপাশি গুরুত্ব পাবে পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্ট এবং দুই দেশের মানুষের মধ্যে যে জায়গাগুলোয় ভরসার অভাব আছে, আমি নিশ্চিত সে দিকেও দৃষ্টি দেবে এই সংলাপ।’

উদ্যোক্তারা বলছেন, নানা কারণে সীমান্তের দুই পারে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বেশ কিছু উপাদান রয়ে গেছে, সেই ইস্যুগুলোকেই মোকাবেলার চেষ্টা করবে সিমলার সংলাপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *