আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ২৩

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ২৩

  • কাউসার মাহমুদ

فديتك زائراً في كل عام 
  تحيا بالسلامة والسلامِ
وتُقْبِلُ كالغمام يفيض حيناً 
  ويبقى بعده أثرُ الغمامِ
وكم في الناس من كلفٍ مشوقٍ
إليك وكم شجيٍ مُستهامِ

(مصطفي صادق الرافعي)

আজ থেকে রমজান শুরু। রাতে সেহরি করে প্রথম রোজা রাখলাম। তারাবীহ পড়তে গিয়েছিলাম জামে মসজিদে। সেই থেকে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে আছি, দিনলিপিতে কি লেখা যায়? কোন আঙ্গিকে আজকের বর্ণনাটা দেয়া যায়? কেননা সবকিছু ছাপিয়ে অনির্বাণ এক আনন্দই উপলব্ধি হচ্ছে শুধু। এ আনন্দ নিশ্চয় রমজানের। মহিমান্বিত এ মাসের। মনে মনে কত পরিকল্পনা যে তৈরি করে রেখেছি এ মাসকে ঘিরে। সারাটাক্ষন সেই ছবি ভাসে চোখে। কারও চোখ আর হৃদয় যখন এক হয়ে যায় তখন কল্পনার তাৎপর্য বোঝা যায়। শরীর ও মস্তিষ্কে একইসাথে সেই কল্পনার বিকিরণ ঘটে। মনে হয়, আজ আমারও হয়েছে তাই। নানাভাবে এই মাসটি উদযাপনের সূচি তৈরি করে নিয়েছি। বিশেষত কুরআন পাঠ, অন্যান্য পুণ্যকর্ম ও নিজের লেখালেখি ঘিরে। যদিও সারা বছর যে নিয়মে আমার জীবন চলে, এই মাসে তাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। যেমন, আগে সকালে কাজে যেতাম রাতে ফিরতাম। এখন দুপুরে যাই সন্ধ্যায় ফিরি। তারপর আবার তারাবীহর নামাজের পর গিয়ে, শেষ রাতে আসি৷ এতে সবকিছু মিলিয়ে পূর্বের তুলনায় দুটি ঘন্টা বেশি ফাঁকা পাচ্ছি। সারা বছর যে ফাঁকা সময়টুকুরই অপেক্ষা করি থাকি। ফলে সবকিছু মিলিয়ে ইবাদত, পড়াশোনা ও লেখালেখিতে এ মাস আমার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণই বটে।

এ-সময় কেবলই আমার সংযমের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, ধৈর্য, সাধনা আর সংযমের বাণী। ভাবি, মানুষের এইটুকু বিরূপ আচরণ যদি সইতে না পারি, তাহলে সারাটাদিন কিসের উপোস রইলাম? আমার সংযম তো কেবল অনাহারের নয়, বরং সংবেদরও। নিজের হৃদয়কে নিয়ন্ত্রণেরও। 

যদিও দেশের কথা মনে হয় এ মাসে অত্যধিক। বাবা-মা’র সাথে রোজার আনন্দের কথা কদাচিৎ মনে পড়ে। কদাচিৎ বললাম কারণ, এ দূরত্বে যে অভ্যস্থই হয়ে গেছি। হিসেব করে দেখি, হতে হতে প্রায় পাঁচটা রমজান কেটে গেল দেশের বাইরে। প্রতি বার সে একই নিয়মের যাপন চলছে। এ ব্যাপারে একটু বিস্তারিত বলা যায়। এ মাসে মূলত আমরা কাজেই থাকি। রোজকার মত সপ্তাহের প্রতিদিনই কাজ করি। তবে সেই কাজে বিরতি থাকে। দু’বারের বিরতিতে বেশ কিছু সময়ের ফুরসত মেলে। এ মাসে আমাদের ভোজনে খুব যে ব্যত্যয় ঘটে, তা কিন্ত নয়। স্বাভাবিক খানাখাদ্যই থাকে আহারে। কিন্তু সন্ধ্যা অবধি যেহেতু কাজ করি,তাই ইফতার তৈরির বিড়ম্বনা এড়াতে সোজা জামে মসজিদে চলে যাই। যেখানে ঢুকতেই দিবসের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে তনু মনে এক সুস্থির আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। এই দেশে প্রায় প্রতিটি জামে মসজিদেই বাহারি ইফতারের আয়োজন থাকে। যে কেউ চাইলে সেখানে বসতে পারে। তৃপ্তি নিয়ে পেট ভরে খেতে পারে। পথচারী, মুসাফির অসহায় কারোরই দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সন্ধ্যার আগে মসজিদে চলে গেলেই হলো। প্লেটে সাজানো কয়েক পদের উপাদেয় খাদ্য দিয়ে সহজেই ইফতার সেরে নিতে পারে।

নির্ধারিত মসজিদে এ আয়োজনগুলো করে মূলত স্থানীয় সৌদিরাই। ধনাঢ্য পরিবার কিংবা পুরো একটি গোত্রের সদস্যরাই। আমরা যে মসজিদে যাই, শুনেছি কয়েক যুগ ধরে এখানে একটি গোত্রই ইফতার প্রদান করে। যতকিছুই হোক এই সৌভাগ্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত হতে দেবে না তারা। ফলে কেউ দান করতে চাইলে, অর্থ, খেজুর, স্যুপ, চাল, আটা কিংবা ফলমূল গ্রহন করবে ঠিক—কিন্ত পুরো দায়িত্ব কারো ওপরই ন্যস্ত করবে না। গোত্রটির নাম ‘আল সুফরান।’ সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মত ওদের আচরণ। দীর্ঘদিন ধরে এই গোত্রের বেশকিছু তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ ও শিশুদের দেখছি। যাদের প্রত্যেকেই অতি ভদ্র, শান্ত আর মার্জিত। অন্যান্য সৌদিদের মধ্যে সাধারণ যে রূঢ় ও দম্ভপূর্ণ মনোভাবটি দেখা যায়, এঁদের মাঝে এর ছিটেফোঁটাও দেখিনি। যখন কোনো প্রয়োজনে আসে, বেশ সম্মান দিয়ে কথাবার্তা বলে। আহবান কিংবা অনুরোধে বড় মোলায়েম স্বর তাদের। কোনোদিন কর্মরত কোনো শ্রমিকের সঙ্গে ওদের বনিবনা হয়নি এমন দেখিনি। যেন শান্ত, সৌম্যতা তাদের পারিবারিক শিক্ষারই বৈশিষ্ট্য। এমনকি যথেষ্ট ধনবান হওয়া সত্বেও অন্যান্যদের মত গরিমাও নেই। এঁদের যুবক ছেলেরা কোনোপ্রকার নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে না। গাড়ি নিয়ে অন্য অনেকের মত শাঁ শাঁ করে উচ্ছৃঙ্খলতা ছড়ায় না। বরং পোশাক-আশাক, চলনবলনে সর্বত্রই মার্জিত ভাবটা বজায় রাখে। ফলে, এ অঞ্চলের তাহামা, শুরুম, গ্রামের যেমন বদনাম আছে, বিপরীতে আল-সুফরানের আছে অগাধ সুনাম।

বিশেষত রোজা এলেই এঁদের কর্মক্ষম পুরুষদের দেখা মেলে। একেকদিন পাঁচ’ছজন করে রোজাদারদের সেবায় নিযুক্ত হয়। কেউ আমাদের খেজুর দিল তো কেউ নিয়ে এলো জুস। কেউ স্যুপের বর্তনগুলো সাজিয়ে দিচ্ছে তো, কেউ বড় পেয়ালায় করে নিয়ে আসছে পাস্তা। তাই আমরা যারা ক্লান্তি নিয়ে মাগরিবের আগে আগে মসজিদে যাই, তাঁদের সৌজন্যবোধে চিত্ত বিগলিত হয়। যেন কোনো তাড়া নেই। রাজ্যের ব্যস্ততা নেই। কিছু গোছগাছও করতে হবে না। বরং নিশ্চুপ মনে ইফতার সম্মুখে রেখে কেবলই মুয়াজ্জিনের মনোহর কণ্ঠের অপেক্ষা। তাই সব দেশের সকল প্রবাসীই সাধারণত মসজিদে যায়। যাদের কাজের তাড়া নেই, যাদের দিবসের শ্রান্তি নেই, কেবল তাদেরই কেউ কেউ ঘরে ইফতার করে। নতুবা, আফগান, ইয়েমেনি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, নেপালি, বাঙালি যারাই আছি, সন্ধ্যার পূর্বে আমাদের সকলেরই গন্তব্য থাকে মসজিদ।

মসজিদে প্রশস্ত দস্তরখান বিছানো থাকে। প্রতি দস্তরখানে আটজন মানুষের খাবার। বৃহৎ পেয়ালাায় থাকে পর্যাপ্ত চাল আর আস্ত একটি ভাজা মুরগী। আরবরা যেটিক ‘শোয়াইয়া’ বলে। সাথে খেজুর, জুস, সুপ আর পাসতা তো থাকেই। ফলে পেটপুরে খেয়ে দেয়ে কেউ চাইলে ফ্লাক্স ভর্তি গাহওয়াও পান করতে পারে। অনেকে তো পানির বোতলে করে রাতে পানের জন্য সেই গাহওয়া নিয়েও যায়। এতে কারোরই কোনো বাঁধা নেই৷ আপত্তি নেই, ক্ষোভ নেই। বরং সকলেই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সেই ইফতার ভক্ষণ করে মহান খোদাতায়ালার শুকরিয়া আদায় করে। তবে হ্যাঁ! এসব জায়গায় মাঝেসাঝে বিব্রত হতে হয় বিশেষ কিছু মানুষের আচরণের কারণে। যারা শুরুতেই নিজের অংশটুকু আলাদা করে নেয়। যারা একসঙ্গে বসা তার অপর ভাইদের দিকে কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ করে না। বরং আজান পড়তেই, মুঠো-মুঠো চাল থালা থেকে আলাদা করে ফেলে। মুরগির সুস্বাদু অংশটুকু ছিঁড়ে পাতের কাছে রাখে। এজাতীয় লোকদের সংখ্যা কম হলেও, তারা যে কেবল নির্দিষ্ট কোনো দেশের তা নয়। বরং ওখানে বসা প্রায় সকল দেশেরই কেউ না কেউ এমন থাকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোনো কোনোদিন সেসব লোকদের সঙ্গে বসা হয় না। অন্যথা সে উদ্ভট ব্যবহার সয়ে নিয়েই ইফতার সম্পন্ন করতে হয়।

এ-সময় কেবলই আমার সংযমের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, ধৈর্য, সাধনা আর সংযমের বাণী। ভাবি, মানুষের এইটুকু বিরূপ আচরণ যদি সইতে না পারি, তাহলে সারাটাদিন কিসের উপোস রইলাম? আমার সংযম তো কেবল অনাহারের নয়, বরং সংবেদরও। নিজের হৃদয়কে নিয়ন্ত্রণেরও। সেইসব পূণ্যের কথা ভাবতে ভাবতে কোরান পড়ছিলাম। এরমাঝে মাগরিবের আযান হলে আল্লাহর নাম নিয়ে প্রথম ইফতার সম্পন্ন করলাম।
এরপর নামাজান্তে ধীর পায়ে কামরার দিকে রওয়ানা হই। পথে পরিচিত লোকদের সঙ্গে দেখা হয়। সকলেই প্রশান্তচিত্তে আপন নিবাসের দিকে যাচ্ছে। মিসরিয় ধূমপায়ীরা রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। নীচু স্বরে পরস্পর কথা বলছে। পথে যানবাহন অতি অল্প। যেন দিনের সমস্ত ব্যস্ততারা কিছু সময়ের জন্য স্থবির হয়ে গেছে। কোথাও কোনো চাঞ্চল্য নেই। কেবলই সুনসান বিছিয়ে রয়েছে সর্বত্র। এর মাঝে যদি কেউ পথ চলছেও, কথা বলছেও, তবু সকলের ভাবটা এমন যে, স্বর উঁচু করা যাবে না। এতে করে ঘিরে ধরা প্রিয় আলস্য ভঙ্গিটা কেটে যেতে পারে। বিশ্রামের প্রতি যে শরীরটা ব্যকুল হয়ে আছে, তা চাঙা হয়ে উঠতে পারে।

ক্রমশ..

১১ মার্চ সোমবার, ২০২৪

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *