সৃষ্টির অপার বিষ্ময়; ফেরেশতা (পর্ব-৩)

সৃষ্টির অপার বিষ্ময়; ফেরেশতা (পর্ব-৩)

  • মুফতি মাহতাব উদ্দীন নোমান

গত পর্বের পর

উপরোক্ত আয়াতগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় জানতে পারি–

এক. আল্লাহ তা’আলা মানব সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেশতাদের সাথে পরামর্শ না করলেও পারতেন। তিনি পরামর্শ ছাড়া মানুষ সৃষ্টি করলে কোন ফেরেশতার আপত্তি করার কোনো অধিকার বা সাহস ছিলো না। তারপরও মহান আল্লাহ তা’আলা তার অধিনস্ত ফেরেশতাদের সাথে পরামর্শ করে মুমিনদেরকে এই বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন যে, কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের ব্যাপারে অধীনস্থদের সাথে পরামর্শ করাই উত্তম।
আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ও সাহাবীদের সাথে পরামর্শের নির্দেশ দেন। এরশাদ করেন–

এবং কাজেকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ কর (সূরা আল ইমরান, আয়াত-১৫৯)

এইজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বদা আবু বকর রা. ওমর রা. ও নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করছেন। এটি অনেকগুলো সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
এছাড়াও আল্লাহ তাআলা মুমিনদের ব্যাপারে বলেন-

যারা তাদের প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দেয়, সালাত কায়েম করে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে এবং তাদেরকে আমি যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। (সুরা শুরা, আয়াত ৩৮)

সুতরাং আমাদেরও সকল বিষয়ে নিজেদের উর্দ্ধতন ও অধীনস্থদের সাথে পরামর্শ করা একান্ত জরুরী।

দুই. আল্লাহ তাআলা পরামর্শ চাওয়ার পর ফেরেশতাগণ আমানতদারিতার সাথেই পরামর্শ দিয়েছেন। মানব সৃষ্টির ক্ষতিকারক বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম, যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়, সে আমানতদারিতা ও বিশ্বস্ততার সাথে ন্যায়সঙ্গত পরামর্শ দিবে। তার দৃষ্টিতে কল্যাণকর ও অকল্যাণকর বিষয়গুলো স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস লক্ষণীয়।

তিনি বলেন, নিশ্চয়ই পরামর্শদাতাকে হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য। (তিরমিযি হাদীস ২৩৬৯)

অর্থাৎ পরামর্শদাতা অত্যন্ত আমানতদারিতার সাথে পরামর্শ দিবে। আমানত যেমন বিশ্বস্ততার সাথে আদায় করা হয়, ঠিক পরামর্শটাও বিশ্বস্ততার সাথে দেওয়া উচিত।

তিন. ফেরেশতারা যথাযথ পরামর্শ দেওয়ার পরেও আল্লাহ তা’আলা তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এর দ্বারা বুঝা যায়, যে পরামর্শ চায় তার জন্য পরামর্শদাতার পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করার সুযোগ আছে। তার নিকট পরামর্শটি কল্যাণকর হলে গ্রহণ করবে আর অকল্যাণকর মনে হলে পরামর্শ গ্রহণ করবে না। পরামর্শ গ্রহণ না করার ক্ষেত্রে পরামর্শদাতার কোন অভিযোগ করার অধিকার নেই। এই বিষয়টিও একটি হাদীস দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়। হযরত বারীরা রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পূর্বের স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলে ও তিনি রাসূলের পরামর্শ গ্রহণ করেননি।

হাদীসের ভাষ্যটি এমন,

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ (বারীরা) তুমি যদি তার কাছে আবার ফিরে যেতে! সে বললঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেনঃ আমি পরামর্শ দিচ্ছি মাত্র। সে বললঃ আমার তার কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারি, হাদীস ৫২৮৩)

চার. আয়াতের মধ্যে আমরা জানতে পারলাম জ্ঞান আল্লাহ তাআলার দেওয়া এক মহান নিয়ামত। তিনি যাকে ইচ্ছা জ্ঞান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা অজ্ঞ বানান। সুতরাং জ্ঞানীর উচিত তার জ্ঞানকে খোদা প্রদত্ত নিয়ামত মনে করে বিনয়ী হওয়া। জ্ঞান নিয়ে অহংকার করা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। এইজন্যই ফেরেশতারা নিজেদের জ্ঞান নিয়ে বড়াই করেন না। সোজাসাপ্টা বিনয়ের সাথে উত্তর দিয়েছেন ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’।

এ বিষয়ে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত একটি ঘটনা আলোচনাযোগ্য–

একবার মূসা (আঃ) বনী ইসরাঈলের কোন এক মজলিসে হাজির ছিলেন। তখন তাঁর কাছে এক ব্যাক্তি এসে বলল, ‘আপনি কাউকে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী বলে জানেন কি?’ মূসা (আঃ) বললেন, না। তখন আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (আঃ) এর কাছে ওহী পাঠালেনঃ হ্যাঁ, আমার বান্দা খিযির।

(বুখারি, হাদীস ৭৪, মুসলিম হাদিস ২৩৮০)

যদিও ওই সময় হযরত মুসা আঃ শরীয়তের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু এভাবে বর্ণনা করাটা আল্লাহ তাআলার নিকট অপছন্দনীয় ছিল। তাই তিনি মূসা আ.কে হযরত খিজির আ. এর অনুসরণ করতে বলেন। হযরত মুসা আঃ সর্বোচ্চ বিনয় প্রদর্শন করে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পালনার্থে নিঃসঙ্কোচ ভাবে হযরত খিজির আ. এর অনুসরণ করেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও এর থেকে উপদেশ গ্রহণ তৌফিক দান করুন।

পাঁচ. এই আয়াতগুলোর মধ্যে মূল যে পয়েন্ট আমাদের আলোচ্য বিষয় তা হল, ফেরেশতাগণ নূরের সৃষ্টি, নিষ্কলুষ, নিষ্পাপ, আল্লাহ তাআলার অত্যন্ত নিকটবর্তী ও সম্মানিত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ কর্তৃক মাটির তৈরি আদমকে সিজদাহ করার নির্দেশ আসার সাথে সাথেই বিনা বাক্যে আদমের সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। কোন যুক্তি নেই, কোন অহংকার নেই। এইজন্যই তারা আল্লাহ তাআলার সম্মানিত বান্দা হতে পেরেছেন। এর বিপরীতে ইবলিশ, সে যুক্তি ও অহংকারবশত আল্লাহর নির্দেশকে উপেক্ষা করলো। এই কারণে সে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত ও লা’নতপ্রাপ্ত হয়ে গেল। আল্লাহ তা’আলা ইবলিসকে সিজদাহ না করার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন–

‘আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কীসে তোমাকে নিবৃত্ত করল যে, তুমি সিজদা করলে না ?’

সে বলল, ‘আমি তার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; তুমি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছো এবং তাকে কাদামাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছ।’ (সূরা আরাফ, আয়াত ১২)

এখন আমরাই সিদ্ধান্ত নেই, ফেরেশতাদের গুণে গুণান্বিত হয়ে আল্লাহর নিকটবর্তী ও সম্মানিত বান্দা হবো, নাকি ইবলিশের চিরাচরিত বদ অভ্যাস অনুসরণ করে বিতাড়িত, লা’নতপ্রাপ্ত ও জাহান্নামী হবো।

আমরা যখন এই ফেরেশতাসুলভ আচরণ গ্রহণ করতে পারব, তখন খারাপ কামনা বাসনা বা পাপেচ্ছা থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত হতে পারব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুন।

ফিরা যাক ফেরেশতাদের গুণাবলীর আলোচনায়। তাদের তিনটি গুণ নিয়ে আমরা বিগত পর্বগুলোতে ধারাবাহিক আলোচনা করেছি। আজ চতুর্থ পর্ব-

ছয়. ফেরেশতাদের আরেকটি গুণ হলো তারা পানাহার করেন না। কোরআনে বর্ণিত ইব্রাহিম আঃ এর মেহমানদের ঘটনা দ্বারাই এই বিষয়টি প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন–
আপনার নিকট কি ইব্রাহীমের সম্মানিত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে? (সুরা যারিয়াত ২৪)

মেহমান বা অতিথিরা ফেরেশতা ছিলেন, যারা মানুষের বেশে আগমন করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আঃ), হযরত মীকাঈল (আঃ) এবং হযরত ইসরাফীল (আঃ)। তাঁরা সুশ্রী যুবকের রূপ ধারণ করে এসেছিলেন। তাদের চেহারায় মর্যাদা ও ভীতির লক্ষণ প্রকাশমান ছিল। হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁদের আতিথেয়তার জন্য খাবার তৈরীর কাজে মগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি নিঃশব্দে অতি তাড়াতাড়ি স্বীয় স্ত্রীর নিকট গমন করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই গো-বৎসের ভোনা মাংস নিয়ে তাদের সামনে হাযির হয়ে যান। তিনি ঐ গোশত তাঁদের নিকটে রেখে দেন এবং বলেনঃ ‘আপনারা খাচ্ছেন না যে?’ ফেরেশতাগণ সেই খাবার ভক্ষণ করেননি। এ ঘটনাটি সূরায়ে হূদ (আয়াত ৬৮-৭০) ও সূরায়ে হিজরেও (আয়াত ৫১-৫২) বর্ণিত হয়েছে।

এই গুণটি থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হলো, দুনিয়াতে শুধু মানুষ ও জিন ছাড়া সকল পশুপাখি খাওয়ার জন্যই বাঁচে। তাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হলো খাবার গ্রহণ করা। নিজের খাদ্যের জন্য অন্যের ক্ষতি করতেও তারা পরোয়া করে না। সুতরাং নিজের আহার যোগার করার জন্য সকল প্রকার অন্যায় ও অন্যের ক্ষতি করাটা পশুসুলভ আচরণ।

খাবার গ্রহণের সময়টুকুতে ফেরেশতারা আল্লাহ তাআলার ইবাদতে কাটান। এটি তাদের অত্যন্ত মহৎ গুণ। এখন আমাদের সামনে পশুসুলভ আচরণ ও ফেরেশতাদের মহৎ গুণ স্পষ্ট। পশুসুলভ আচরণ গ্রহণ করলে আমরা পশুর থেকেও আরও নিকৃষ্ট হয়ে যাব, আর ফেরেশতার মহৎ গুণ অবলম্বন করলে ফেরেশতাগণের মত সম্মানিত ও মর্যাদাবান হব।

প্রশ্ন হতে পারে, আমরাতো খাবার গ্রহণ করা ছাড়া বাঁচতে পারব না। এর সহজ সমাধান আল্লাহ তায়ালাই দিয়ে দিয়েছেন। আমরা যদি খাদ্য উপার্জন ও খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে শরীয়তের নিয়ম-নীতি ও বিধি নিষেধ পরিপূর্ণভাবে পালন করি, তাহলে এই খাদ্যগ্রহণটাও আমাদের ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। তবে শুধু খাদ্য উপার্জন ও খাদ্য গ্রহণকেই জীবনের মূল উদ্দেশ্য বানানো বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

হযরত আদম (আ.)- কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইলো।’ (সূরা বাকারা আয়াত ৩৬)

এরপরে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন–

আমরা বললাম, তোমরা সকলে এখান থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট কোন হিদায়াত আসবে তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।
(সূরা বাকারা, আয়াত ৩৮-৩৯)

এছাড়াও মানুষকে পশুসুলভ আচরণ থেকে মুক্ত করে ফেরেশতাগুণে অভ্যস্ত করার জন্য আল্লাহ তাআলা রোযার বিধানও দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন–

হে মু’মিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিলো, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)

আল্লাহ তা’আলা এই বিষয়গুলো আমাদেরকে বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন।

লেখক, মুফতি ও সিনিয়র শিক্ষক, আল জামি’আ দারুল উলুম মাদরাসা, হাড়িনাল, গাজীপুর।  

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়ুন:

হযরত ঈসা আলাইহিস সালামঃ আমাদের নবী

সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা

মহাররম ও আশুরা সম্পর্কিত আয়াত এবং হাদিস

ঈদ ও কোরবানি; ইতিহাস ও শিক্ষা 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *