কুরবানির পূর্বতন পৃষ্ঠা

কুরবানির পূর্বতন পৃষ্ঠা

  • আব্দুল্লাহ বিন গোলামুল রহমান

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তবে সেক্ষেত্রে তিনি কিছু ইবাদত ফরজ করেছেন, আর কিছুকে ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছেন। মুসলমানদরে উচিত একনিষ্ঠভাবে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সেগুলো সম্পন্ন করা। কুরবানী সে ধরনের একটি ইবাদত যার বিধান আদম আ. এর যুগ থেকেই চলে আসছে। এর ইতিহাস সম্পর্কে কিছু আলোচনা তুলে ধরা হলো-

পৃথিবীর সর্বপ্রথম কুরবানী

কুরবানী এমন একটি ইবাদত, যার সূচনা হয়েছে আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর যুগ থেকে। আদম আ. এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ

অর্থ- “আদমের দুই পুত্রের (হাবিল,কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হল এবং অপরজনের কুরবানী কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করবো। অপরজন বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন।” (সূরা মায়েদা-২৭)

মূল ঘটনা হলো:

যখন হযরত আদম ও হাওয়া আ. পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাদের সন্তান প্রজনন ও বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়। তখন হাওয়া আ. এর প্রতি গর্ভ থেকে জোড়া জোড়া অর্থাৎ একসাথে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ জমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। (কেবল শীশ আ. ব্যতিরেকে। কারণ, তিনি একা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।) তখন ভাই-বোন ছাড়া আদম আ. এর আর কোন সন্তান ছিল না। অথচ ভাই-বোন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই আল্লাহ তা‘আলা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম আ. এর শরীয়াতে বিশেষভাবে এ বিধান জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে জমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গন্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম।

কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারীনী কন্যা সহোদরা বোন হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। সুতরাং সে সময় আদম আ. একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন।

ঘটনক্রমে কাবীলের সাথে যে সহদরা জন্ম নিয়েছিল, সে ছিল পরমা সুন্দরী। কিন্তু হাবীলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল, সে দেখতে অতটা সুন্দরী ছিল না। বিবাহের সময় হলে শরয়ী নিয়মানুযায়ী হাবীলের সহোদরা কম সুন্দর বোন কাবীলের ভাগে পড়ল। কিন্তু কাবীল তাকে বিবাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজের সহোদরা সুন্দরী বোনকে বিবাহের আবদার জানাল। ফলে আদম আ. তৎকালীন শরীয়াতের আইন অনুযায়ী কাবীলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে তাঁর নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানল না। এবার তিনি তাকে বকাঝকা করলেন; তবুও সে ঐ বকাঝকায় কান দিল না।

সে সময় কুরবানী কবুল হওয়ার একটা সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আসমান থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানীর বস্তুকে ভষ্ম করে ফেলত। আর যার কুরবানী কবুল হতো না. তারটা পড়ে থাকত।

অবশেষে হযরত আদম আ. তার এই দুই সন্তান হাবীল ও কাবীলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ কর, যার কুরবানী কবুল হবে, তার সাথেই আকলিমার (আদম আ. এর সেই সুন্দরী কন্যার) বিবাহ দেয়া হবে।’

সে সময় কুরবানী কবুল হওয়ার একটা সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আসমান থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানীর বস্তুকে ভষ্ম করে ফেলত। আর যার কুরবানী কবুল হতো না. তারটা পড়ে থাকত।

এরপর তারা উভয়েই কুরবানী করল। নিয়ম অনুযায়ী আসমান থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবীলের কুরবানীর বস্তু ভষ্ম করে দিল। আর কাবীলের কুরবানীর বস্তু যথাস্থানেই পড়ে থাকল। অর্থাৎ হাবীলের কুরবানী কবুল হলো আর কাবীলেরটা হলো না। কিন্তু কাবীল এ আসমানী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না। এ অকৃতকার্যতায় কাবীলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে আতœসংবরণ করতে না পেরে তার ভাই হাবীলকে প্রকাশ্যে বলল যে, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। হাবীল তার জবাবে বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন।’ কিন্তু কাবীল তার ভাই হাবীলের কথায় কান না দিয়ে এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করে ফেলল। (ইবনে কাসীর-২/৫৪-৫৭ “সারসংক্ষেপ”)

কুরআনে বর্ণিত হাবীল ও কাবীল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানীর এ ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, কুরবানীদাতা ‘হাবীল’ যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরবানী করেছেন, ফলে তার কুরবানী কবুল হয়েছে। পক্ষান্তরে কাবীল নিজ সার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কুরবানী করেছে, ফলে তার কুরবানী কবুল হয়নি। সুতরাং বুঝা গেল যে, একমাত্র আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে কুরবানী করাটা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রত্যেক নবীর যুগেই কুরবানীর বিধান ছিল:

প্রত্যেক নবীর যুগেই কুরবানীর বিধান ছিল তবে তার পদ্ধতি ও ধরণ এক ছিল না। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ

অর্থ-“প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা উক্ত পশু যবেহ করার সময় অল্লাহর নাম স্মরণ করে এজন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন।” (সূরা হজ্জ-৩৪)

হে ইবরাহীম! স্বপ্নে দেয়া আদেশ তুমি সত্যে পরিণত করেছ। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

বর্তমান কুরবানীর ইতিহাস:

বর্তমান প্রচলিত কুরবানীর ধারার সূচনা হয়েছে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর যুগ থেকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ (১০০) فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ (১০১) فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَابُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَاأَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ (১০২) فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ (১০৩) وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَاإِبْرَاهِيمُ (১০৪) قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (১০৫) إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ (১০৬) وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ (১০৭) وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ (১০৮) سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ (১০৯) كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (১১০) إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ (১১১)

অর্থ- “(ইবরাহীম আ. যখন বললেন) হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে সৎকর্মশীল একটি পুত্র সন্তান দান কর, অতঃপর আমি তাকে অতি ধৈর্যশীল একটি পুত্র সন্তানের (ইসমাঈল আ. এর) সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর যখন সে (ইসমাঈল আ.) তার পিতার (ইবরাহীম আ. এর) সাথে চলফেরা করার বয়সে পৌঁছাল, তখন ইবরাহীম আ. তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন বল, তোমার কী অভিমত? সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। ইনশা আল্লাহ ( আল্লাহ চাইলে) আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের দলভুক্ত পাবেন।

তারা উভয়েই যখন (আল্লাহর আদেশের) আনুগত্য প্রকাশ করলেন আর ইবরাহীম আ. তাকে কাত করে শুইয়ে দিলেন, তখন আমি (আল্লাহ) তাকে (ইবরাহীম আ. কে) ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম! স্বপ্নে দেয়া আদেশ তুমি সত্যে পরিণত করেছ। (অর্থাৎ ইবরাহীম আ. স্বপ্নে শুধু এতটুকু দেখেছিলেন যে, তিনি তার পুত্রকে জবাই করতে উদ্যত হয়েছেন, কিন্তু জবাই হয়েছে কিনা তা তিনি দেখেননি, সুতরাং তিনি যতটুকু স্বপ্নে দেখেছিলেন, তা তিনি বাস্তবায়ন করেছেন।) (আল্লাহ বলেন,) এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে পুত্রটিকে ছাড়িয়ে দিলাম। (অর্থাৎ ইসমাঈল আ. এর পরিবর্তে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন এবং ইসমাঈল আ. এর পরিবর্তে সেটিই কুরবানী করা হলো।) আর আমি তাকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। সৎকর্মশীলদেরকে আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত। (সূরা সাফ্ফাত-১০০-১১১)

হাদীস শরীফে এসেছে- 

عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ، قَالَ: قَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ؟ قَالَ: ্রسُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَগ্ধ قَالُوا: فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: ্রبِكُلِّ شَعَرَةٍ، حَسَنَةٌ قَالُوا: ” فَالصُّوفُ؟ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ: ্রبِكُلِّ شَعَرَةٍ مِنَ الصُّوفِ، حَسَنَةٌ

অর্থ- “যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, এই কুরবানী কী? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নাত। তারা বললেন, এতে আমাদের কী লাভ? তিনি বললেন, প্রতিটা চুলের বিনিময় এক নেকী। তারা আবার বললেন, ইয়া রাসূল্লাহ! পশমের বিনিময় (কি কিছু নেই)? তিনি জবাবে বললেন, প্রতিটা পশমের বিনিময়ে এক নেকী।” (ইবনে মাজাহ-৩১২৭)

আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের মত সহীহ নিয়তে কুরবানি করার তাওফিক দান করুক। আমিন!

লেখক, তরুণ আলেম,মুহাদ্দিস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *