- ফাহমিদা মুন্নী
আমি ওদের মানবাধিকারের বুলিতে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
তাই, আমার বয়োবৃদ্ধ বাবার সাথে তর্ক জুড়ে দিয়ে বলেছিলাম, “দেখ বাবা! একেই তো বলে মানবতা!!!
কিন্তু, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় যখন জীবন বাঁচানোর জন্য নূন্যতম সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হল, তখন আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম – ওরা কেউ মানবাধিকারের আওয়াজ তুলল না!
আমি ওদের নারী অধিকারের শ্লোগানেও মুগ্ধ হয়েছিলাম।
আর তাই, আমার মাকে উচ্ছসিত কন্ঠে বলেছিলাম, “এইবার তোমার সকল চাওয়া পূর্ণ হবে মা!!”
কিন্তু, যুদ্ধবিদ্ধস্ত গাজায় দশ হাজার গর্ভবতী নারী থাকা সত্ত্বেও যখন হাসপাতালগুলোকে উড়িয়ে দেয়া হল, তখন আমি দেখলাম – ওরা কেউ নারী অধিকারের আওয়াজ তুলল না!
আমি ওদের প্রযুক্তিগত উন্নয়নেও মুগ্ধ হয়েছিলাম।
তাই, আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে বলেছিলাম, “দেখ, দেখ, একেই তো বলে সভ্যতা !
কিন্তু, ওদের সেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিই যখন মারনাস্ত্র হিসেবে গাজায় ব্যবহৃত হল, তখন আমি দেখলাম যে, অধিকার বঞ্চিত এক জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় এই প্রযুক্তি আসলে কোন কাজে আসলো না।
আমি ওদের গণতন্ত্রের শ্লোগানেও মুগ্ধ হয়েছিলাম।
আর তাই, খাবার টেবিল চাপড়িয়ে আমার সন্তানদের জোরগলায় বলেছিলাম, “বলো, ওদের এই গণতন্ত্র ছাড়া আমাদের মুক্তির আর কোন পথ আছে কি?”
কিন্তু, ফিলিস্তিনিদের নিজভূমি থেকে উৎখাত করে, সেখানে যখন একটি অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হল, তখন, আমি অবাক হয়ে দেখলাম – এ বিষয়ে ওরা কোন গণতান্ত্রিক আইনকানুনের ধার ধারলো না।
আমি ওদের বাকস্বাধীনতার শ্লোগানেও মুগ্ধ হয়েছিলাম।
আর তাই, আমার সহকর্মীকে দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে বলেছিলাম, “বাকস্বাধীনতার নমুনা দেখতে চান? তবে, পশ্চিমাদের দেখুন।”
কিন্তু, যখন আমি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে সরব হলাম, গত ৭৫ বছর যাবত তাদের উপর চলমান পৈশাচিক নির্যাতন আর ঘৃণ্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিলাম – তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেগুলোতে আমি নিষিদ্ধ হলাম।
আমি তো আসলে ভুল বুঝেছিলাম।
আমি তো আসলে বোকার মত ভয়াবহ এক ভুলের মধ্যে ছিলাম।
অনেক দেরীতে হলেও বুঝেছিলাম যে, ওদের মানবাধিকারের সংজ্ঞায় মানুষের আকৃতি থাকা সত্ত্বেও সবাই মানুষ বলে বিবেচিত হয় না।
অনেক দেরীতে হলেও আমি বুঝেছিলাম যে, নারী অধিকারের স্লোগানে ওদের স্বার্থসিদ্ধি না হলে, নারীর অধিকার পদতলে পিষ্ট হলেও ওরা কেউ রা করে না।
অনেক দেরীতে হলেও আমি বুঝেছিলাম যে, ওদের স্বার্থরক্ষা না হলে, ওদের হাইটেক মিডিয়ায় সত্যভাষণকে কখনো স্বাগত জানানো হয় না।
অনেক দেরীতে হলেও আমি বুঝেছিলাম যে, ওদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উদ্দেশ্য নয় মানুষের জীবন বাচাঁনো।
বরং, ওদের স্বার্থরক্ষায় এই ধরণীর একের পর এক ভূখন্ডে অসহায় আর নিরপরাধ জনগোষ্ঠীর শুধু লাল টকটকে রক্ত ঝরানো।
অনেক দেরীতে হলেও আমি বুঝেছিলাম, এই পৃথিবীতে গণতন্ত্র বলে আসলে কিছু নেই।
আছে শুধু ব্যক্তি আর দলীয় স্বার্থরক্ষায় মানুষের মনগড়া কিছু তন্ত্র-মন্ত্র।
“শুধু স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহৃত হবে সকল চমকপ্রদ শ্লোগান” – এটাই ওদের ডাবলস্ট্যান্ডার্ড জীবনাদর্শের আসল মূলমন্ত্র।
২৭ শে অক্টোবর, ২০২৩ ইং
লেখক, আরবী ভাষা শিক্ষক ও সৌধশিল্পী