পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউজে বসবেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর অফিসে প্রবেশ করেই তার প্রথম কাজ হবে চীন ও প্রতিবেশী দুই দেশ কানাডা এবং মেক্সিকোর ওপর নতুন ট্যারিফ আরোপ করা।
সোমবার (২৫ নভেম্বর) এই ঘোষণা দিয়ে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের এই ঘোষণার পরপরই তোলপাড় চলছে বিশ্বজুড়ে। পাশাপাশি অনুপ্রবেশ ও মাদক চোরাচালান রুখতে ব্যর্থতার জন্যও চীন ও প্রতিবেশী দেশ দুটিকে ধুয়ে দেন ট্রাম্প।
সোমবার নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোস্যালে দেয়া পোস্টে ট্রাম্প বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই কানাডা ও মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া সব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ ট্যারিফ আরোপের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করবেন তিনি। পাশাপাশি যতক্ষণ পর্যন্ত না বেইজিং ফেনটানিল মাদক চোরাচালান চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, ততক্ষণ চীনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত আরও ১০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষ আমদানিকারক। আর চীন, কানাডা ও মেক্সিকো থেকেই নিজেদের আমদানির ৪০ শতাংশ প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে মার্কিনীরা। যার পরিমাণ বছরে ৩ হাজার ২০০ বিলিয়ন ডলার।
অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণায় চীনের বিরুদ্ধে বহুবারই কঠোর ট্যারিফ আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ জন্য চীনের বিরুদ্ধে ট্যারিফ আরোপের ট্রাম্পের নতুন হুমকিতে তেমন কোনো বিস্ময় ছিল না। তবে ট্যারিফ প্রশ্নে কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই কঠোর বক্তব্যে বিস্মিত অনেকেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত লাগোয়া এই দেশ দুটিকে ওয়াশিংটনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে যুগ যুগ ধরে।
শুধু বাণিজ্যিকই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতেও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত অটোয়া এবং মেক্সিকো সিটি। এ রকম ঘনিষ্ঠ দুই প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কঠোর ট্যারিফ আরোপের হুমকির বিষয়টি তাই এ মুহূর্তে আলোচনার খোরাক যোগাচ্ছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে।
তবে কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ট্রাম্পের খেপে যাওয়ার কারণ মূলত এই দুটি দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন ও মাদক চোরাচালান। এ ব্যাপারে ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোস্যালে’ দেয়া পোস্টে বলেন, মেক্সিকো ও কানাডা উভয় দেশেরই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা ও অধিকার রয়েছে। আমরা তাদের কাছে এই ক্ষমতা প্রয়োগের দাবি জানাচ্ছি। এবং যতক্ষণ তারা তা করবে না, তাদের এজন্য বড় মূল্য দিতে হবে।
এরমধ্যেই ট্রাম্পের ঘোষণার প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে বিশ্ববাজারে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে দুর্বল হয়েছে কানাডা, মেক্সিকো ও চীনা মুদ্রার দর। অপরদিকে আরও তেজী অবস্থানে মার্কিন ডলার।
রয়টার্স জানিয়েছে, ট্রাম্পের বক্তব্যের পরপরই মেক্সিকোর মুদ্রা পেসোর বিপরীতে ডলারের উত্থান হয়েছে ২ শতাংশ। অপরদিকে কানাডীয় ডলারের বিপরীতে মার্কিন ডলারের বর্তমান অবস্থান গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া চীনা ইউয়ানের বিপরীতে গত ৩০ জুনের পর সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ডলারের দাম।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারেও পড়তে শুরু করেছে ট্রাম্পের হুমকির প্রভাব। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) দাম কমেছে ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম। জার্মানির ফোকসওয়াগন গ্রুপের শেয়ারের দাম হ্রাস পেয়েছে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ। অপরদিকে স্টেলান্টিসের শেয়ারের দর হ্রাস পেয়েছে ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
এদিকে ভোটের আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই চীনা পণ্য আমদানির ওপর ৬০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপের পাশাপাশি মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া গাড়ির ওপরও ১ হাজার শতাংশেরও বেশি ট্যারিফ আরোপের হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন ট্রাম্প। অবশ্য ট্রাম্পের এই হুমকির জবাবে মেক্সিকোর তরফে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে কানাডা সরকারের তরফে এ ব্যাপারে বিবৃতি দেয়া হলেও সেখানে সরাসরি ট্রাম্পের অভিযোগের কোনো জবাব দেয়া হয়নি। বরং ট্রাম্পকে না চটিয়ে দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককেই তুলে ধরার প্রয়াস দেখা গেছে কানাডার উপপ্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের দেয়া বিবৃতিতে।
একই সঙ্গে কানাডার অর্থমন্ত্রীরও দায়িত্ব পালন করা ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড তার বিবৃতিতে বলেন, কানাডা নিজের সীমান্তের সুরক্ষা এবং দুদেশের অভিন্ন সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ককে ভারসাম্যপূর্ণ এবং পারস্পরিক সুবিধাজনক বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র যে কানাডার প্রধান বাণিজ্য সহযোগী সেটাও মনে করিয়ে দেন কানাডার উপপ্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, চীন, জাপান, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এই সবগুলো দেশের থেকেও বেশি পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে কানাডা।
তবে ট্রাম্পের হুমকির কারণে যে কানাডার রাজনৈতিক মহলে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা বোঝা যায় দেশটির সবচেয়ে বড় প্রদেশ অন্টারিওর প্রধানমন্ত্রী ডগ ফোর্ডের বিবৃতিতে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে দেয়া পোস্টে তিনি বলেন, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত এই ট্যারিফ দুই দেশেরই কর্মীদের ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আরও জোরালো ভূমিকার আহ্বান জানিয়ে কানাডার সব প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসার জন্য ট্রুডোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে ট্রাম্প যদি কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে তার ট্যারিফ আরোপের হুমকি সত্যি সত্যিই বাস্তবায়ন করেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রে কানাডা ও মেক্সিকোর রফতানি করা পণ্য কিনতে আরও বেশি অর্থ খরচ করতে হবে মার্কিন ভোক্তাদের। বিশেষ করে ট্রাম্পের এই ট্যারিফের ধাক্কা সবচেয়ে বেশি পড়বে মেক্সিকোর অটোমোবাইল শিল্পের ওপর।
কারণ হোন্ডা, নিশান, টয়োটা, কিয়াসহ জাপান, কোরিয়ান এবং চীনের বিভিন্ন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্ল্যান্ট রয়েছে মেক্সিকোতে। যেখান থেকে উৎপাদিত গাড়ির প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি ফক্সকোন, এনভিডিয়া, লেনোভো, এলজিসহ এশীয় ইলেক্ট্রনিক্স নির্মাতা কোম্পানিগুলোরও প্রোডাকশন হাব হিসেবে পরিচিত মেক্সিকো। দেশটিতে থাকা এসব কোম্পানির প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যেরও প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রে কানাডার প্রধান রফতানি মূলত পেট্রোলিয়াম পণ্য, গ্যাস এবং অটোমোবাইল। কানাডার চেম্বার অব কমার্সের বরাত দিয়ে সেদেশের গণমাধ্যম জানিয়েছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ১০ শতাংশও ট্যারিফ আরোপ করে কানাডার পণ্যের ওপর; তবে এতে বছরে কানাডার অর্থনৈতিক ক্ষতি দাঁড়াবে ২১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।