ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা সৃষ্টির পেছনে

ভারত উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা সৃষ্টির পেছনে

 

  •  আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

পর্ব-১

মুহাম্মদ বিন কাশিম থেকে শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল ধরে হিন্দু মুসলমান একই সঙ্গে এই উপমহাদেশে বসবাস করে এসেছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা আতিপাতি করেও এমন একটি ঘটনা পাওয়া যায় না যাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে অভিহিত করা যায়। তখন সকল ক্ষেত্রেই এ দেশের অধিবাসীদের মধ্যে সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল। শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি সবখানেই সকল সম্প্রদায় সমান সুযোগ পেত। সহ অবস্থান ও সহযোগিতা, সম্প্রীতি ও সহনশীলতার সে এক আশ্চর্য পরিবেশ ছিল। রাজা থেকে নিয়ে প্রজা সাধারণ পর্যন্ত কারো মনে সাম্প্রদায়িক কলূষতার লেশমাত্র ছিল না। সকলেই আপন আপন ধর্মবিশ্বাস নিয়ে নিরাপদে দিন কাটাতে পারত । শুধু আপন ধর্ম বিশ্বাসের জন্য কারো হাতে নিগ্রহ হওয়ার কারো কোন ভয় ছিল না।

সুপ্রসিদ্ধ রাজনীতিক ঐতিহাসিক পণ্ডিত সুন্দর লাল ‘ভারতে ইংরেজ রাজ’ নামক গ্রন্থে   লিখেন, “আকবর থেকে আওরঙ্গজেব সকল সম্রাটের আমলে হিন্দু মুসলমান উভয়েই ছিলেন সম-মর্যাদা সম্পন্ন। উভয়ের ধর্মকেই সমান ভাবে সম্মান করা হত। ধর্ম বিষয়ে কারো প্রতি কোন প্রকার পক্ষপাতিত্ব ছিল না। সকল বাদশাহর তরফ হতেই অসংখ্য  হিন্দু মন্দিরের নামে জায়গীর ও দেবোত্তর সম্পত্তি দান করা হয়েছিল।”

সপ্তদশ শতাব্দীতে ক্যাপটেন হেমিলটন ভারতে আসেন । তখনকার ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উল্লেখ করে সিন্ধুর থাট্টা শহর সম্পর্কে ইনি লিখেন, “এখানকার রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম, জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলমান শতকরা দশ। এতদসত্ত্বেও এখানে পুরোপুরি ধর্মীয় সম্প্রীতি বিদ্যমান। হিন্দু ও অন্যদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। হিন্দুরা নিজেদের ব্রত ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি ঠিক এমনি ভাবে পালন করেন যেমনিভাবে হিন্দু রাজাদের আমলে করতেন । এখানে অনেক পার্সিক ও খৃস্টানও রয়েছেন। সকলেরই আপন উপাসনালয় বানানোর স্বাধীনতা রয়েছে।” অপর একটি শহর সুরাট সম্পর্কে লিখেন, “এই শহরে প্রায় শ’খানেক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক  বাস করে। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস ও উপাসনা নিয়ে এদের মধ্যে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ নেই। প্রত্যেকেই নিজস্ব পদ্ধতিতে আপন আপন দেব-দেবীর উপাসনা করতে পারেন”। – হুকুমত খোদ ইখতেয়ারী

জুলুম ও অত্যাচারের চেয়ে দয়া ও অনুগ্রহের তলওয়ার দিয়েই ইসলাম প্রসার লাভ করে বেশী।

তখন রাজ্যশাসন পদ্ধতিই ছিল পারষ্পরিক সমঝোতা, সহানুভূতি এবং অসাম্প্রদায়িকতার উপর। মহামতি মোঘল সম্রাট বাবর যুবরাজ হুমায়ূনের নামে যে অছিয়াত করে গিয়েছিলেন এর প্রতিটি ছত্রই এর জ্বলন্ত সাক্ষ্যে উজ্জ্বল। তিনি বলেছিলেন, “প্রিয় পুত্র আমার! ভারত একটি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর দেশ। আল্লাহর সকল  প্রশংসা, তিনি এর বাদশাহী তোমাকে দিয়েছেন। সাম্প্রদায়ীকতার সকল আবিলতা হতে তোমার মন ধুয়ে মুছে নিয়ে ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসনের খেয়াল রাখবে। এছাড়া কখনো তুমি ভারতবাসীর হৃদয় অধিকার করতে পারবে না। এদের মন্দির, মঠ ও মাযারের কোন ক্ষতি করো না। এমন ইনসাফ করবে যেন সকলেই সম্রাটের উপর খুশি হয়ে যায়। জুলুম ও অত্যাচারের চেয়ে দয়া ও অনুগ্রহের তলওয়ার দিয়েই ইসলাম প্রসার লাভ করে বেশী। মানুষের গঠনে যেমন চারটি মৌল উপাদানের সামঞ্জস্য থাকা অতীব প্রয়োজন, তেমনি দেশকে ঠিক রাখতে  যেয়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রজাদেরকে পরস্পরে মিলিয়ে রাখা অত্যন্ত দরকারী। এদিকে খেয়াল রাখবে এবং এদের মধ্যে কাজের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করবে। এতেই শুধু রাজ্যরূপ শরীরকে সকল প্রকার রোগ থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব।” –ড. বালকৃষ্ণ: খেলাফত পত্রিকা, বোম্বাই ।

মুসলিম বিজয়ীগণ এদেশকে মনে-প্রাণে নিজের দেশ হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং এদেশের ভাল মন্দের সঙ্গেই নিজেদের ভাগ্যকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাই এদেশের সকল কিছুই ছিল তাদের একান্ত আপনার। লর্ড বেন্টিংক ১৮৮২ তে এক কমিটির সামনে প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেছিলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিম শাসন ইংরেজ শাসন থেকে ভাল ছিল। এরা ভারতকে নিজের দেশ বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। ভারতীয় অমুসলমানদেরকে সকল প্রকার অধিকার দিয়েছিলেন। বিজয়ী ও বিজেতার মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না। সকল ব্যাপারেই তাদের মধ্যে তখন সমঝোতার ভাব বিদ্যমান ছিল।” মুহাম্মদ মিয়া: ওলামা-ই-হক।

ইউরোপই হিংস্র ধর্মীয় উন্মাদনার জনক ।

ভারতে অঞ্চলে অঞ্চলে, গোত্রে গোত্রে রাজনৈতিক ও বৈষয়িক কোন কলহ- বিবাদ ছিল না, সে কথা নয়। তবে সাম্প্রদায়িকতা বলতে আমরা যা বুঝি তা ছিল না। আর্য জাতি দ্বারা অনার্যদের হনন, সে তো সাম্প্রদায়িকতার জন্য ছিল না। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা একান্ত করেই ইউরোপীয় মানসিকতার সৃষ্টি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রচণ্ড রূপ ইউরোপেই আমরা পাই। ইউরোপই হিংস্র ধর্মীয় উন্মাদনার জনক।  ক্রুসেডের শতাব্দীকাল যুদ্ধের ইতিহাসে ঐ উন্মাদনারই সাক্ষাৎ আমরা পাই। ভীষণ এক অন্ধ আবেগ ও ধর্মীয় উন্মাদনাই তৎকালীন ইউরোপকে বারবার টেনে এনেছিল ফিলিস্তিনের প্রান্তরে, পশ্চিম এশিয়ার পথে ঘাটে। তৎকালীন ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উল্লেখ করে মি. ডবলু এম. টার্নস ইউরোপের ঐ মানসিকতার দিকে ইঙ্গিত করে লিখেন, “ইংল্যান্ড ও ইউরোপের প্রায় সবখানে তখন ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নির্বিচারে হত্যা চলছিল। আয়ারল্যান্ডে রোমান ক্যাথলিকদের পুরুষদেরকে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করা হত। সেনাবাহিনীতে কোন যোগ্য মর্যাদা তারা পেত না। সুইডেনে লুথার কিং- এর অনুসারী ছাড়া অন্য কেউ চাকুরী-বাকুরী পেত না। অন্য সম্প্রদায়ের নাবালক শিশুদেরকে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা পর্যন্তও ঘটতে দেখা গিয়েছে। —হুকুমত খুদ ইখতেয়ারী।

ইংরেজরা যখন এদেশে আসে, ঐ মানসিকতাকেও তখন সঙ্গে করে নিয়ে আসে। নিজের দেশে তারা দেখেছিল, এক ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও শুধু ফেরকাগত পার্থক্যের দরুন তারা পরস্পরে দাঙ্গা করে আসছে। তাই এখানকার ধর্মীয় সমম্প্রীতি তাদের কাছে বড় আশ্চর্য ঠেকত।

বৃটিশ এদেশের অধিকারী হয়েছিল অসির জোড়ে নয়, বাহুর পরাক্রম দেখিয়ে নয়, বরং ছল-চাতুর্যের খেয়ালীপনায়, ধীরে ধীরে, ক্রমে ক্রমে।

যুদ্ধ জয়ের পর ইংজেরা দেখল বিরাট এক দেশ তাদের পদানত আর তখন থেকেই তাদের পাকা চুলওয়ালা মাথাগুলো চিন্তিত হয়ে উঠেছিল, কি করে একে দীর্ঘকাল পদানত করে রাখা যায়। তারা বিলক্ষণ জানত, কোন ক্রমে এরা জেগে উঠলে সারাটা গ্রেট বৃটেনকেউ যদি অস্ত্রসজ্জিত করে নিয়ে আসা যায়, তবুও এদের এক গ্রাসও হবে না। বৃটিশ এদেশের অধিকারী হয়েছিল অসির জোড়ে নয়, বাহুর পরাক্রম দেখিয়ে নয়, বরং ছল-চাতুর্যের খেয়ালীপনায়, ধীরে ধীরে, ক্রমে ক্রমে। সাধারণ লোকতো তখন বুঝতেই পারেনি যে তারা ইংরেজের অধীন হয়ে গেছে। তারা ভেবেছিল, সিরাজের পর মীরজাফর এসেছে, এ-ই মাত্র। বাংলার লোক দিয়েই তারা বাঙ্গালীকে পদানত করেছিল। দিয়েই তারা ভারতবাসীকে শাসন করেছিল। যুদ্ধ ও রাজ্য শাসন উভয়ের মধ্যেই ছিল বৃটিশের সেই মোক্ষম রাজনৈতিক দর্শন, ‘ডিভাইড এন্ড রোল’ – বিভেদ সৃষ্টি কর আর শাসন কর। এ রাজাকে ঐ রাজার বিরুদ্ধে লাগিয়ে রেখে নিজেদের  আখের গোছানোর যে প্রতিযোগিতা তৎসময়ে ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে তীব্র হয়ে  হয়ে চলছিল, তা ইতিহাস পাঠক মাত্রই জানেন।

ইংরেজরা ভারতকে নিজেদের তলওয়ারের জোরে জয় করতে পারেনি। ভারতবাসীর তলওয়ার দিয়েই তারা তা করেছিল।

ইংরেজ শাসনের মূল ভিত্তিই ছিল এই। নিজেদের শাসন ও শোষণ চালিয়ে রাখার নিমিত্তে এই পলিসিই তারা নিয়েছিল যে, ভারতীয়দেরকে পরস্পরে এতটুকু বিদ্বিষ্ট ও আশংকিত করে রাখা উচিৎ যাতে তারা বৃটিশ শাসনের স্থায়িত্বের মধ্যেই শুধু নিজেদের নিরাপত্তা দেখতে পায়। এই জঘণ্য মানসিকতার উপর ভিত্তি করেই এরা ভারতের নির্মল আকাশ নির্মম সাম্প্রদায়িক হিংস্রতায় এমন বিষাক্ত করে তোলে যার চিন্তাও একদিন ভারতীয়রা করতে পারত না। এই দিকে ইঙ্গিত করেই মিস্ এ্যানি বেসাল্ট লিখেন, “ভারতবাসীর বিরুদ্ধে কোম্পানীর যুদ্ধ, এ কোন সৈনিকের যুদ্ধ ছিল না, বরং এ বণিকের লড়াই ছিল। ইংরেজরা ভারতকে নিজেদের তলওয়ারের জোরে জয় করতে পারেনি। ভারতবাসীর তলওয়ার দিয়েই তারা তা করেছিল। রাজনৈতিক ঘুষ, ষড়যন্ত্র, মুনাফেকী, দু’মুখানীতি এবং একদলকে আরেক দলের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে-লেলিয়ে তারা এতবড় একটি দেশকে নিজেদের অধীন করতে সক্ষম হয়েছিল।” -তোফায়েল আহমদ: রওশন মুস্তাকবিল

ক্রমশ..

(ইসলাম, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা গ্রন্থ থেকে চয়িত)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *