হালাল পণ্য তৈরি-বিক্রিতে লাগবে ফাউন্ডেশনের সনদ

হালাল পণ্য তৈরি-বিক্রিতে লাগবে ফাউন্ডেশনের সনদ

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: দেশে এখন থেকে হালাল পণ্য উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানি করার ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ ও লোগো নিতে হবে। গত সপ্তাহে জারি করা হালাল সনদ নীতিমালা-২০২৩ অনুযায়ী এ নির্দেশনা কার্যকর করা হয়। এতে বলা হয়, কোরআন ও হাদিসের বিধান মতে হালাল সনদ ইস্যুর বিষয়ে ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা থাকায় হালাল সনদ ইস্যুর জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ।

মূলত ইসলামী মূল্যবোধ থেকে হালাল পণ্যের ধারণার উৎপত্তি।

কিন্তু কোনো পণ্যের হালাল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সনদ প্রয়োজন হয়। হালাল পণ্যের বিষয়টি ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা) এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ২০০৭ সাল থেকে সনদ দিয়ে আসছে। যদিও এ সনদ দেওয়ার জন্য সংস্থাটির সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে অন্য পণ্য পরীক্ষা ও মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সহযোগিতা নিয়েই সনদ দিচ্ছে।

এদিকে দেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মান, ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিতে জাতীয় মান সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হালাল সনদ দেওয়ার জন্য একটি প্রবিধানের গেজেট প্রকাশ করে সংস্থাটি। সেখানে বলা হয়, বিএসটিআই হালাল সনদ দেবে। এর পরই সনদ দেওয়া নিয়ে সরকারের সংস্থা দুটি মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য হলো ইসলামের মূল্যবোধ ও আদর্শভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা। এখন নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, হালাল সনদের একক কর্তৃপক্ষ হয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। আর শরিয়াসম্মত খাবার, ওষুধ ও কসমেটিকস পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে হালাল সনদ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জারি করা নীতিমালার উদ্দেশ্য ও কারণ হিসেবে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আ. হামিদ জমাদ্দার বলেছেন, দেশের মানুষ হালাল খাদ্যদ্রব্য, ভোগ্য পণ্য, প্রসাধনসামগ্রী ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা নীতিমালার অন্যতম উদ্দেশ্য। যাতে মানসম্মত পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত হয়।

এই নীতিমালা অনুযায়ী হালাল পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া হবে। হালাল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হালাল পণ্যের রপ্তানি ত্বরান্বিত করা হবে। হালাল পণ্য উৎপাদন দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখবে। এসব বিষয় বিবেচনা করেই এসংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়ন এবং হালাল পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে নীতিমালা করা হয়েছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগের উপপরিচালক মো. আবু সালেহ পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘ বছর ধরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন হালাল সনদ দিয়ে এলেও হঠাৎ করেই বিএসটিআই প্রবিধান জারি করে সনদ দেওয়া শুরু করেছে। এটি তাদের কাজ না হলেও গায়ের জোরে এ কাজ করছে। আগে থেকেই তারা এই সনদ দিতে পারে না। এখন নতুন নীতিমালা জারি হওয়ায় বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়েছে। তিনি বলেন, এখন থেকে হালাল সনদ দেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এই সনদ দেওয়ার আগে মান পরীক্ষার বিষয়ে বিএসটিআইসহ অন্যান্য সংস্থা সহযোগিতা করবে।

বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক মো. রিয়াজুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএসটিআই আইন অনুযায়ী প্রবিধান করেছে। ওই প্রবিধানের আলোকে হালাল সনদ দিচ্ছে। এই সনদ দেওয়ার জন্য শুধু ধর্ম নয়, মান ও নিরাপদ পণ্য নিশ্চিত করা জরুরি। এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের সক্ষমতা রয়েছে। তার ভিত্তিতে সনদ দিচ্ছে বিএসটিআই। তবে এই সনদ দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। স্বেচ্ছায় এই সনদ দেওয়া হচ্ছে।

রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে হালাল সনদ

দেশের পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হালাল সনদ নিয়ে খাদ্য, ভোগ্য পণ্য, প্রসাধনসামগ্রী, ফার্মাসিউটিক্যালসহ নানা পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। আগামী দিনে হালাল পণ্য রপ্তানি বাড়াতে চান ব্যবসায়ীরা।

মুসলিম ও অমুসলিম উভয় ধরনের দেশগুলোতে হালাল অর্থনীতির পরিধি ক্রমেই বড় হচ্ছে। হালাল পণ্যের বৈশ্বিক বাজার তিন ট্রিলিয়ন ডলারের। বিশ্বব্যাপী হালাল অর্থনীতির বাজারও আশাতীত সাফল্যের মুখ দেখবে বলেই আশা। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে হালাল অর্থনীতির পরিমাণ ৪.৯৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল ২.৩০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ১৭৯টি কম্পানি হালাল সনদ নিয়েছে। এসব কম্পানি এক হাজার ৮০০ পণ্য উৎপাদন করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০২টি প্রতিষ্ঠান হালাল সনদের জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে ৮৫টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়েছে। এবার ৭৮টি প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেওয়া হয়েছে। এই সনদ থেকে এক কোটি ৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৯৮ টাকা আয় করেছে সংস্থাটি। ২০০৭ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত হালাল সনদ দেওয়ার মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ছয় কোটি টাকার বেশি আয় হয়েছে।

এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক আবু সালেহ পাটোয়ারী বলেন, হালাল সনদ নিয়ে পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী ৬২টি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিন শতাধিক পণ্য রপ্তানি করেছে। এসব পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হালাল সনদ প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ তাদের সনদ গ্রহণ করছে। এই সনদ যাতে বিশ্বের সব দেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই হালাল সনদ নিয়ে যাতে রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়, তার সব পদক্ষেপই নেওয়া হবে।

হালাল সনদ দেওয়ার বিষয়ে বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক রিয়াজুল হক বলেন, বিএসটিআই ১০টি প্রতিষ্ঠানকে হালাল সনদ দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ৮২টি পণ্যের হালাল সনদ নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই সনদ দেওয়ার উদ্যোগ নেয় বিএসটিআই, যাতে হালাল পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হয়।

হালাল নীতিমালায় যা অনুসরণীয়

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হালাল সনদ নীতিমালায় বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে কম্পানিগুলোকে সনদ ও হালাল লোগো ইস্যু করবে। প্রতি বছর হারে এই সনদের জন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কারখানার মান বিবেচনায় মেয়াদ দুই-তিন বছর বাড়ানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে পুনরায় অডিট করে সনদ নবায়ন করতে হবে। নবায়নের জন্য আগের সনদের কপিসহ আবেদন করতে হবে।

নীতিমালা অনুযায়ী, হালাল সনদের মেয়াদকালে হালাল খাদ্য, পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, পরিবেশনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ আকস্মিক পরিদর্শন, পর্যালোচনা অব্যাহত রাখবে। প্রতিবছর একবার হলেও কারখানা পরিদর্শন করতে হবে।

এতে বলা হয়, খাদ্য, ভোগ্য পণ্য, প্রসাধনী ও ফার্মাসিউটিক্যালস তৈরি এবং মোড়কজাতে শরিয়তে হালাল নয় এমন কোনো কাঁচামাল, উপাদান, উপকরণ, এডিটিভস ব্যবহার করা যাবে না। খাদ্য বা তার উপাদান স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাকটিস ও স্ট্যান্ডার্ড স্যানিটেশন অপারেটিং প্রসিডিউর মানা নিশ্চিত করতে হবে।

নীতিমালা অনুযায়ী, খাদ্য প্রস্তুত, প্রক্রিয়াজাত, প্যাকেটজাত, মজুদ বা পরিবহনের সময় হারাম বস্তু থেকে আলাদা রাখতে হবে। সেসব খাদ্য শরিয়া অনুযায়ী হারাম, তার সঙ্গে হালাল খাদ্য ও ভোগ্য পণ্য রাখা যাবে না। ওষুধের ক্ষেত্রে উপাদান বিশ্লেষণ করে শুধু হালাল ও ঝুঁকিহীন হলে হালাল হিসেবে অনুমোদন করা হবে। হারবাল, ইউনানি এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধ হালাল সনদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হলে ও পরিশোধিতভাবে পরিবেশিত হলে তা হালাল হিসেবে গণ্য করা হবে। ওষুধের বাহন হিসেবে বা গুণগত মান ঠিক রাখতে সর্বোচ্চ ০.৫ শতাংশ অ্যালকোহল ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট ও পারফিউমের মতো প্রসাধনী তৈরিতে চর্বি বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ প্রাণীর অংশ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো কসমেটিকস দ্রব্য হালাল হিসেবে গণ্য হবে না।

হালাল সনদ ও লোগো ব্যবহারে ফি

শিল্পের কারখানা ও কসাইখানার আকারের ওপর নির্ভর করে হালাল সনদ ও লোগোর জন্য বার্ষিক ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

নীতিমালা অনুযায়ী, এক থেকে পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগে ছোট কারখানার ক্ষেত্রে হালাল সনদ ফি পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। পাঁচ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের কারখানার জন্য এই ফি দ্বিগুণ ১০ হাজার টাকা এবং ৫০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে করা বড় কারখানার ক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা ফি দিতে হবে।

এদিকে জবাইখানা বা কসাইখানার প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা এক থেকে পাঁচ টন মাংস হলে পাঁচ হাজার টাকা, ৫-১০ টন মাংস হলে ১০ হাজার টাকা ও ১০ টনের বেশি হলে ২০ হাজার টাকা ফি দিতে হবে।

দেশি হোটেল ও রেস্টুরেন্টের প্রতি ইউনিট রান্নার জন্য হালাল সনদ ফি এক হাজার টাকা এবং আন্তর্জাতিক হোটেলের প্রতি ইউনিট রান্নার জন্য দুই হাজার টাকা।

বিএসটিআইয়ের প্রবিধানে বলা হয়েছে, ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য, প্রসাধনসামগ্রী, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া বা সেবাকে ‘হালাল’ বলে। বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র শিল্পের হালাল সনদ বা নবায়ন ফি এক হাজার টাকা, মাঝারি শিল্পের তিন হাজার টাকা এবং বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত দ্রব্যের গায়ে বা লেবেলে অথবা প্রক্রিয়া বা সেবার অনুকূলে হালাল মার্ক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সনদের জন্য বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত ফরমে সংস্থাটির মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে হয়। সনদ দেওয়া হয় তিন বছরের জন্য। মেয়াদ শেষে নবায়নের আবেদন করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *