রেলওয়েতে এখনও কেন এমন ভোগান্তি?

রেলওয়েতে এখনও কেন এমন ভোগান্তি?

  • আশরাফ উদ্দীন রায়হান

নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও স্বস্তিদায়ক ভ্রমণের জন্য প্রায় অধিকাংশ ভ্রমণকারীরই প্রথম পছন্দ রেলওয়ে। রেলের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমাদের দেশে ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়’ নামে সরকারের পৃথক একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে, যার দায়িত্বই হলো রেলের যাবতীয় দেখভাল করা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে ২০১১ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই রেলওয়ে খাতকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে পারা দূরের কথা, গণমাধ্যমের বহুল চর্চিত শব্দবন্ধ ‘রেলের কালো বিড়াল’ই অদ্যাবধি তাড়ানো যায়নি। বলাই বাহুল্য যে, এই রেলওয়ের সাথে এ দেশের গণমানুষের আবেগ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা সরাসরি ও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা আর জনস্বার্থবাদী উদ্যোগসমূহ ভেস্তে যেতে চলেছে শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত হর্তাকর্তাদের যাচ্ছেতাই ধরনের কাজ করার কারণেই।

বর্তমান সরকারের আমলে দেশের সর্বোত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রেলওয়ে খাতেও ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বৈকি। বিভিন্ন রুটে নতুন নতুন ট্রেন চালু করা থেকে নিয়ে রেলপথ ও রেলসেতু বিনির্মাণ, বিদেশ থেকে উন্নত ও আধুনিক ইঞ্জিন-কোচ আমদানি করাসহ অনেকগুলো যুগান্তকারী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা আর জনস্বার্থবাদী উদ্যোগসমূহ ভেস্তে যেতে চলেছে শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত হর্তাকর্তাদের যাচ্ছেতাই ধরনের কাজ করার কারণেই।

প্রসঙ্গক্রমে রাজধানী ঢাকায় অধুনা চালু হওয়া মেট্রো রেলের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। চাহিদার তুলনায় যদিও মেট্রো রেলের সংখ্যা ও অবকাঠামো বেশ অপ্রতুল; কিন্তু এর সার্ভিস ও শিডিউল নিয়ে এখন পর্যন্ত যাত্রীসাধারণের অসন্তোষের কথা শোনা যায়নি। প্রণিধানযোগ্য ব্যাপার হলো যে, এই মেট্রো রেলের তদারকিতে নিযুক্ত আছে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়। তাহলে কি এটা ধরে নেওয়া যায় যে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আর দায়সারা গোছের কর্মকারের কারণেই প্রায় একই রকমের দুটি পরিবহনের চিত্র ভিন্ন ভিন্ন?


রেলে নিয়মিত চলাচলকারী একজন ভুক্তভোগী যাত্রী হিসেবে কয়েকটি বিষয় আমাকে নিদারুণ পীড়িত করে। সবার আগে যে সমস্যার কথা বলতে হয় সেটি হলো শিডিউল বিপর্যয়। আর এটি সবচেয়ে বেশি ঘটে ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে। প্রতিনিয়তই দেখা যায় যে, প্ল্যাটফর্মের ডিজিটালাইজড স্ক্রিনে ট্রেনের পৌঁছা ও ছাড়ার যে সময় প্রদর্শন করা হয় সেগুলো অনুযায়ী ট্রেন আসা-যাওয়া করছে না। আবার কখনো-বা ধারাবাহিকতা বজায় না রেখেই এক ট্রেনের জায়গায় অন্য ট্রেন চলে আসে।

ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিবো কোথা’র মতো।

অবস্থাদৃষ্টে তখন অন্দরমহলে স্পিকার নিয়ে বসে থাকা ঘোষকের ঘোষণার দিকেই কায়মনোবাক্যে খেয়াল রাখতে হয়। উপরন্তু যে মাইকগুলো এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলোকে মান্ধাতার আমলের বলাটাই বোধ করি সংগত হবে। ফলশ্রুতিতে, ঘোষকের কথাগুলোও রেলওয়ে স্টেশনের মতো জনাকীর্ণ ও উচ্চশব্দের দূষিত জায়গায় পরিষ্কারভাবে শোনা মুশকিলই বটে। ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিবো কোথা’র মতো।

দেশের যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময়েই রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে এবং সেজন্য সংযুক্ত রেললাইনে অবধারিতভাবেই রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও ব্যাহত হবে―এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি যদি স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীসাধারণকে তাৎক্ষণিক জানিয়ে ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানানো হয়, তাহলে কিন্তু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিরসনে অনেকটা সহায়ক হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এমন কোনো দায়িত্ববোধেরও দেখা পাওয়া যায় না।

আর এর প্রমাণ হিসেবে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে রাজশাহী অভিমুখী পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দুই ঘণ্টারও অধিক সময় পরে ট্রেন ছাড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে পারি। উল্লেখ্য যে পরবর্তীতে খবর নিয়ে জানা গিয়েছিল, সেদিন জয়দেবপুর জংশনের অদূরে রেললাইনে চলন্ত ট্রেনের সাথে অটো বা ভ্যানগাড়ির সংঘর্ষ হওয়ার দরুন সাময়িকভাবে (২ ঘণ্টার জন্য) ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। কিন্তু সে খবরটি প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমাণ শত শত যাত্রী সাধারণকে জানানো হয়নি!

রেলের একটা অসংলগ্নতা খুবই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। সেটি হলো এক ট্রেনের বগিতে অন্য ট্রেনের নাম ও প্রারম্ভিক ও গন্তব্যের নাম লেখা; যেমন―কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটির কয়েকটি বগিতে ‘ঢাকা―কিশোরগঞ্জ’-এর জায়গায় ‘ঢাকা―লালমনিরহাট লেখা। এটি কিন্তু অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর একটি অব্যবস্থাপনা। কর্তৃপক্ষের উচিৎ এ ধরনের অব্যবস্থাপনা দূর করে বিভ্রান্তির অবসান ঘটানো।

সবশেষে সাম্প্রতিকতম একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে লেখা শেষ করছি। গত ১৯ মার্চে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জ অভিমুখী কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে ছাড়ার কথা ছিল। প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল স্ক্রিনেও অনুরূপ সময়ই দেখানো হচ্ছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও চার-পাঁচটি ট্রেন চলে গেল আর এদিকে কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসের কোনো হদিস নেই। দীর্ঘ এক ঘণ্টা পরে কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসলো কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস।

এই হলো নির্ধারিত সময় অনুসরণ করে রেল পরিচালনা করতে ব্যর্থ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা। এর পরিণাম হিসেবে যে আস্তে আস্তে রেলের প্রতি মানুষের আস্থা ও নির্ভরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, সে ব্যাপারে রেলের হর্তাকর্তাদের বোধোদয় হওয়া কাম্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles