- ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
কেমন করে আঁকা যায় সেই রূপময় কান্তি যা অনুভবময় হয়েও অনুভবের ঊর্ধ্বে, স্পর্শময় হওয়ার পরও পরশ করা যায় না যাঁকে, অঙ্গময় হওয়ার পরও আঙ্গিক কাঠামো যার বর্ণনার ঊর্ধ্বে, স্নিগ্ধ বর্ণময়তার শোভায় পিছলে যায় চোখ যাকে দর্শনে! সমস্ত উপমা যেখানে হারায় তাঁর উপমেয়তা। তুলনা যেখানে অতুলনীয় বলেও হয় না বলার শেষ। না, আঁকা যায় না। অক্ষমতাই নেয় সেখানে চূড়ান্তরূপ।
বল, কেমন করে আঁকা যাবে সেই কান্তিময় নাসিকাগ্রের নূর, দর্শকের যেখানে ঘটত দৃষ্টি বিভ্রম, যাতে তাঁর নূরময় নাসিকা আরো, আরো একটু উঁচু মনে হত! বাণী নির্ঝরনীর সময় সেই শিশির-পিছল স্ফটিক দন্তরাজির ফাঁকে ফাঁকে অঙ্গহীন গড়িয়ে পড়ত পবিত্র মুখগহ্বরের স্ফুলিঙ্গ, আভাময় দীপ্তি, কেমন করে আঁকবে তাঁকে!
তোমাকে সুধাই বল, ঈষৎ বঙ্কিম ঘন চুলবিশিষ্ট চিকন সেই দুই ভ্রুর মাঝে প্রশস্ত ললাটের শেষে প্রবল দীপ্তিতে নীলাভা ছড়াত যেই মনোহর শিরাখানি দৃশ্যমান হত কেবল একান্ত প্রেমাস্পদের জন্য ক্রোধে উজ্জ্বল হলে, তাঁকে আঁকবে সে কোন শিল্পী? কপোল এসে টোল খেত চিবুকের দু’পাশের সে কি দৃশ্যমান করা যায় কোন রেখায়? শুভ্রতার মায়া ছড়ানো চন্দ্র মেখলার মাঝে ঘন কালো আঁখিতারা কী জ্যোতির্ময়মতায় ছিল আপ্লুত, আর এর মাঝে ইতস্তবিস্তৃত রগগুলোর রক্তিম রশ্মির বর্ণনার ভাষা কোথায়? পদ বিক্ষেপের বিনয়ী ঋজুময় দার্ঢ্যভঙ্গি, আর একটু সুন্দর টোল খাওয়া সেই পদতলটির বর্ণনার সেই কলম কই?
যে মুকুল গন্ধ সৌরভ ছড়াত সেই দেহ, তা কি মৃগনাভির মত? আরে না, তা কি আগরের? চৌদিক আমোদিত হয়ে যেত সেই আবহে। অনুপম কান্তির রূপময়তায় রুক্ষ্মতা ছিল না কোথাও; রুক্ষ্ম সৌন্দর্য নয়, অপরূপ লাবণ্য মায়া ঝরে পড়ত সারা দেহপল্লব থেকে। কী যে স্নিগ্ধতা, কী যে মায়া বেয়ে বেয়ে গলে গলে পড়ত সারা দেহসৌষ্ঠব থেকে।
যাঁরা অণুক্ষণ কাছে থেকেছেন, আহারে-বিহারে, সুখে-দুঃখে সঙ্গী হয়েছেন, সঙ্গ লাভে ধন্য হয়েছেন অহর্নিশ তাঁরা বর্ণনা করতে করতেও নিজেই অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন, ‘কি হেরেছি, কি দেখেছি ছাড়া’ প্রকাশ করতে পারেন নি আর কিছু। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত তাদের একজনকে, কেমন ছিল সেই রূপময় আনন? চাঁদের মত গোল? বলেছেন, না তা নয়। তরবারীর মত লম্বাকৃতির? বলেছেন, তা নয়। গোলও নয়, লম্বাও নয়। তিনি কি ছিলেন দীর্ঘদেহী? বলেছেন, না তা-ও নয়। তাহলে কি বেঁটে? বলেছেন, তা-ও নয়। তাঁর কেশদাম কি ছিল কোঁকড়ানো? বলেছেন, না তা-ও নয়। তবে কি সোজা? বলেছেন, তা-ও নয়। তাবৎ উপমাকে নয় নয় বলে বর্ণনারহিত হয়ে যেতেন তাঁরা। তিনি তো উপমারহিত। বলা শেষ করেও তাঁরা বলতেন, ‘না হল না, হল না।’
মহান রাব্বুল আলামীন একান্তভাবে যাকে বানিয়েছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন কি চরিত্র মাধুরীতে, কি আদর্শে সর্বত্র তিনি ছিলেন খাতম- মোহরাঙ্কিত, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। তেমনি শারিরীক গঠনশৈলীতেও ছিলেন তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর দেহ-কান্তিরও কোন উপমা রাখেন নি কুল মাখলুকাতে। তাঁর মত চুল আর কাউকে দেননি, তাঁর মত ললাট আর কাউকে নয়, তাঁর মত নাসিকা আর কারো নয়, তাঁর মত আঁখিপল্লবও আর কারো নেই, সেই যে মনোহর কপোল শোভা আর কারো নেই, সেই স্ফটিক গ্রীবা, সেই প্রশস্ত ভরাট বক্ষ, সেই সুদৃঢ় বাহু, সেই রেশম কোমল হস্ততালু, সেই পিঠ, সেই কোমর, সেই পদদ্বয়, সেই পদতল, তেমনটি আর কারো নেই। একটা একটা অঙ্গ আলাদা আলাদা করে যদিও নাও তবু নেই, আবার সব মিলিয়ে দেহকান্তির সুপবিত্র মনোহারিত্ব বা ছন্দময় সৌন্দর্য তা কারো নেই। শত ইউসুফ সেই লাবণ্যের সমক্ষে ম্লান। কবির ভাষায়, “রহা জামাল পে তেরে হিজাবে বশরিয়্যত না জানা কৌন হায় কুচভী কিসীনে জুযে সাত্তার।”
মানবিকতার আচরণে আচ্ছাদিত ছিল তোমার মনোহর লাবণ্যমায়া। তাই জাননা কেউ কিছুই কী ছিলে তুমি মহান সৃষ্টিকৌশলী আল্লাহ ছাড়া। না বলার মাঝেও সেই মহান সত্তার বিবরণ অলংকারে সার্বক্ষণিক সঙ্গীরা যা বলেছেন, তাই একে যাই আলোর ছায়ায়।
ফাতিমা রা. তনয় হযরত হাসান রা. বলেন, হযরত খাদীজা রা. এর পুত্র হিন্দ ইবনে আবী হালা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুলিয়া মুবারাক, আকৃতি এবং অঙ্গগঠন সম্পর্কে খুবই বর্ণনা করতেন। আমার বাসনা ছিল, তাঁর কাছ থেকে শোনে আমার মনন ও চেতনা-চিন্তায় সেই অপরূপ কান্তি ভাল করে বসিয়ে নিব। তাই একদিন আবদার করলাম, কেমন ছিলেন তিনি?
বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ছিলেন মহান এবং লোকদের চোখেও তিনি ছিলেন মহান। তাঁর চারু আনন পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় ছিল স্নিগ্ধ উজ্জ্বল। মধ্যম আকৃতির লোকদের তুলনায় কিছুটা দীর্ঘ ছিলেন, কিন্তু অত্যাধিক লম্বাও ছিলেন না তিনি। তাঁর মাথা মুবারক দৃষ্টিনন্দন বড় ছিল। মাথার চুল ছিল ঈষৎ কোঁকড়ানো। ঢেউ খেলানো। চিরুনী করার সময় সিঁথি বের হলে তা সেভাবেই রেখে দিতেন। নইলে ইচ্ছা করে সেটি কাটতেন না। (এ ছিল প্রথম যুগের কথা। পরবর্তীতে তিনি ইচ্ছা করেই সিথি কাটতেন।) অনেক সময় কানের লতি অতিক্রান্ত হয়ে যেত তাঁর চুল । উজ্জ্বল দীপ্তিময় ছিল তাঁর গায়ের বরণ। কপাল ছিল প্রশস্ত । ‘ভ্রু’ ছিল কিছুটা বাঁকান ঘন চুলে আবৃত। একটা আরেকটার সঙ্গে জোড়া লাগানো ছিল না। এ দু’য়ের মাঝে একটি নীলাভ শিরা ছিল, ক্রোধ মাধুর্যের সময় যা দৃশ্যমান হয়ে উঠত। উচ্চ নাসিকা মুবারক। নাসিকাগ্রে উজ্জ্বল এক নূর দীপ্তিমান ছিল। গভীরভাবে না দেখলে এতে নাসিকা মুবারককে একটু উঁচু বলে দৃশ্যমান হত। শশ্রুমণ্ডল ছিল ঘনকৃষ্ণ। কপোল ছিল চিকন চারু। মুখের ফাঁক ছিল দৃষ্টিনন্দন প্রশস্ত। দন্তরাজি ছিল শিশিরভেজা স্ফটিক-শুভ্র। মাঝে মাঝে কিছুটা চিকন ফাঁক ছিল বাণী নির্ঝরণের সময় সেই ফাঁক দিয়ে মুখগহ্বরের রক্তিমাভার স্ফুলিঙ্গের ন্যায় অপরূপ দ্যুতি বিচ্ছুরিত হত।
বুক থেকে নাভি পর্যন্ত লোমের এক চিকন ধারা ছিল। ছবির ন্যায় গ্রীবা মুবারক, রৌপ্য-উজ্জ্বল স্ফটিক ছিল এর বর্ণ। শরীর মুবারক ছিল টান টান পেশী সুঢৌল। প্রশস্ত ভরাট বক্ষ ছিল পেট থেকে কিছুটা উঁচু, দুই স্কন্ধের মাঝে ছিল নান্দনিক বিস্তৃতি। অস্থিসমূহের হাড় ছিল কিছুটা মোটা। শরীর মুবারক থেকে কাপড় খোলার সময় ভেতর থেকে উজ্জ্বল দীপ্তি বিচ্ছুরিত হত। সীনা মুবারক থেকে নাভি পর্যন্ত ঘন চুলের একটা সরু রেখা বিস্তৃত ছিল। এছাড়া পেট বা বুকে আর কোন চুল ছিল না। তবে বাহু, স্কন্ধ এবং বক্ষের উপরিভাগে সঙ্গত পরিমাণ লোম ছিল। দীর্ঘ বাহু এবং হস্ততালু ছিল প্রশস্ত। হস্ততালু এবং পদতালু ছিল ভরাট। আঙ্গুলগুলো ছিল নান্দনিক প্রলম্ব। পায়ের তালুর মাঝামাঝি স্থানটি ছিল সডৌল গহ্বরাকৃতির। পায়ের উপরিভাগ ছিল টানটান। এত সুপরিচ্ছন্ন যে, পানি তৎক্ষণাত গড়িয়ে পড়ত। চলার জন্য যখন পা উঠাতেন সজোরে উঠাতেন। পা যখন মাটিতে রাখতেন সামনের দিকে ছান্দিকভাবে ঝুঁকে যেতেন। একান্ত বিনয়-আপ্লুত ভাবে সামনে এগুতেন। চলার সময় মনে হত উপর থেকে যেন নীচে নামছেন।
পাশের কিছু দেখতে চাইলে পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে দেখতেন। দৃষ্টি থ াকত আনত । উপরের দিকে দৃষ্টি বীক্ষণের তুলনায় নীচের দিকেই নয়নপাত করতেন সাধারণত বেশী। (অধিক লজ্জার দরুণ পূর্ণ দৃষ্টিভরে কোন দিকে তাকাতেন না।) অক্ষিকোণাবলোকন হত সাধারণত। চলার সময় সঙ্গীদেরকে সামনে এগিয়ে দিতেন। কারো সঙ্গে সাক্ষাত হলে নিজেই অগ্রে সালাম করতেন।
আমি মামাকে বললাম, তাঁর কথাবার্তার আচার সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা চিন্তানিমগ্ন থাকতেন। (উম্মতের চিন্তায়) অস্থির থাকতেন দিবানিশি-অহর্নিশ। একান্ত প্রয়োজন ব্যতিরেকে কথা বলতেন না তিনি। সুদীর্ঘক্ষণ নিরব থাকতেন। কথার শুরু এবং শেষ করতেন ভরাট মুখে স্পষ্ট ও ধীরে। ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করতেন। তাঁর কথা হত অকাট্য, ফয়সালাকুন, অতিরিক্ত ভাষণ-দোষমুক্ত এবং সংকীর্ণতা-রহিত।
তাঁর মিজাজ ছিল কোমল, নরম। তিনি রূঢ় ও কঠোর প্রকৃতির ছিলেন না। হেয় প্রতিপন্ন করতেন না নেয়ামতের। নেয়ামত, সে যত কমই হোক এর সম্মান করতেন। দোষ বর্ণনা করতেন না কোন নেয়ামতের। খাওয়ার জিনিস হলে এর দোষ-গুণ কিছুই বলতেন না। হক ও ন্যায়ের বিষয়ে কেউ বিরোধিতা করলে তাঁর ক্রোধবহ্নির তাপ সহ্য করতে পারত না কেউ, যতক্ষণ না সত্যের বিজয় ঘটেছে। নিজের জন্য কোনদিন ক্রোধান্বিত হতে দেখা যায়নি তাঁকে। নিজের জন্য তিনি প্রতিশোধ নেননি কখনও। কোন দিকে ইশারা করার সময় পূর্ণভাবে করতেন তা। কোন বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করার সময় হাত ওলট-পালট করতেন। কথা বলার সময় কখনও কখনও ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলটি বাম হাতের তালুতে লাগাতেন। কোন বিষয়ে বিরক্ত হলে মুখ ঘুরিয়ে নিতেন, পাশ ফিরিয়ে নিতেন। যখন আনন্দিত হতেন দৃষ্টি আনত করে ফেলতেন। হাসি ছিল মৃদু, তখন দন্তরাজি দৃশ্যমান হলে মনে হত যেন শিশির-বিন্দু।
হযরত হুসাইন রা. বলেন, আমি আমার পিতা হযরত আলী রা. কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাড়ির অভ্যন্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান কিরূপ ছিল?
তিনি বললেন, নিজস্ব মানবিক প্রয়োজনে বাড়ির অভ্যন্তরে তশরীফ নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন। ঘরে আসার পর তিনি সেখানকার অবস্থানকে তিন ভাগে ভাগ করতেন। এক ভাগ আল্লাহর ইবাদত-রিয়াযাতের জন্য, এক ভাগ পরিবার-পরিজনদের জন্য, আর একভাগ একান্ত নিজের জন্য। কিন্তু তাঁর নিজের ভাগটিও উম্মতের কল্যাণে ছিল নিবেদিত। এ সময় খাস খাস সাহাবীগণ আসতেন। তাঁদের মাধ্যমে তিনি আম উম্মতের জন্য উপকারী বিষয়াদির সমাধান দিতেন। দ্বীনি কোন বিষয় তিনি গোপন করতেন না।
যারা ইলম ও আমলে, উম্মতের কল্যাণ কামনায় বেশী অগ্রণী তাদেরকে এই মজলিসে অনুমতিদানে প্রাধান্য দিতেন। দ্বীনি ফযীলত অনুসারে এই সময়টা তিনি ভাগ করে দিতেন। কারো একটা, কারো দুইটা, কারো বহু প্রয়োজন হত, সে অনুসারে তাদের তিনি সময় দিতেন। বাকী উম্মাহর জন্য কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক হয় এমন কাজে তাদের লাগাতেন। তিনি বলতেন, যারা উপস্থিত রয়েছে তারা অনুপস্থিতজনদের কাছে পৌঁছে দিবে। যে ব্যক্তি আমার পর্যন্ত স্বীয় প্রয়োজনের কথা নিয়ে আসতে পারে না, তাদের প্রয়োজনের কথা আমার কাছে পৌছে দেবে। কারণ যে ব্যক্তি কারো প্রয়োজনের কথা এমনজনের কাছে পৌঁছে দেবে, যে সেই প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। সেই ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা কেয়ামতের দিন পুলসীরাতের উপর দৃঢ়পদ রাখবেন ।
জনহিতকর কোন কথা ব্যতীত অন্য কোন বেহুদা আলাপ-আলোচনা তাঁর মজলিসে গ্রাহ্য ছিল না। এক বর্ণনায় আছে, হযরত আলী রা. বলেন, যে ব্যক্তিই অন্বেষু হয়ে তাঁর খেদমতে আসত কিছু না কিছু নিয়ে ফিরত সে। হাদী ও পথ প্রদর্শক এবং ফকীহ ও প্রাজ্ঞ হয়ে সে সেখান হতে বের হত। হযরত ইমাম হুসাইন রা. বলেন, আমি পিতাজীকে জিজ্ঞেস করলাম, ঘরের বাইরে যখন অবস্থান করতেন তখন কিভাবে চলতেন তিনি?
তিনি বললেন, বেহুদা কথা থেকে তিনি তাঁর যবানকে বিরত রাখতেন। সাধারণ লোকদের মন জোগাতেন, ব্যবধান সৃষ্টি হতে দিতেন না। প্রতিটি কওমের সম্মানী ব্যক্তিদের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, তাদেরকে স্বীয় কওমের নেতা বানাতেন। মানুষের জন্য ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকতে তাগিদ দিতেন। লোকদের ক্ষতিকর আচরণ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতেন। কারো সাথে সদ্ভাব এবং সদব্যবহারে কোন ত্রুটি করতেন না। সঙ্গীদের অবস্থার খোঁজ-খবর রাখতেন। সকালে যা ঘটত তদসম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে অবহিত থাকতেন। ভাল কাজের প্রশংসা এবং খারাপ কর্মের নিন্দা করতেন।
প্রতিটি কাজ ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। কোন কাজ তাঁর অগোছাল হত না। লোকদের সম্পর্কে উদাসীন থাকতেন না। তাদেরকে নিজেদের উপর ছেড়ে দিলে সম্ভাবনা ছিল যে কতক দীনের বিষয়েই উদাসীন হয়ে পড়বে কিংবা দ্বীনি বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে নিজেই একদিন ত্যক্ত হয়ে পড়বে।
প্রতিটি বিষয়েই এক একটা বিশেষ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ছিল তাঁর। সত্য ও ন্যায়ের ক্ষেত্রে কখনও ত্রুটি প্রদর্শন করতেন না। অন্যায়ের দিকে কখনও যেতেন না। সর্বোৎকৃষ্ট লোকজনই তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারত। সাধারণ লোকদের প্রতি সর্বাধিক হিতকামী ব্যক্তি তাঁর নিকট বেশী মর্যাদা পেত। মানুষের প্রতি সহমর্মী ব্যক্তিই ছিল তাঁর নিকট অধিক মর্যাদাবান।
হযরত ইমাম হুসাইন রা. বলেন, পিতাজী রা. এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিস সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
তিনি বললেন, তাঁর উঠা-বসা সবকিছুই ছিল আল্লাহর যিকিরের সঙ্গে। নিজের জন্য আলাদা কোন স্থান নির্ধারণ করে রাখতেন না। অন্য কারো জন্যেও এরূপ করা পছন্দ করতেন না। কোন সমাবেশে গেলে মজলিসের শেষপ্রান্তেই বসে যেতেন। লোকজনদের ডিঙ্গিয়ে সরিয়ে আগে যেতেন না। অন্যদেরকেও এরূপ করতে বলতেন। তাঁর কাছে যারা বসত সকলেরই তিনি
পূর্ণ খেয়াল রাখতেন। প্রত্যেকেই মনে করত আমাকেই তিনি বুঝি সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। কোন প্রয়োজনে যদি কেউ তাঁকে নিয়ে বসত বা দাঁড়াত প্রয়োজন সমাধা করে সে নিজে না সরা পর্যন্ত তিনি সরতেন না। কেউ কিছু চাইলে তিনি তা পূরণ না করে বা অতি বিনয়ের সঙ্গে অপরাগতা প্রকাশ না করে ফেরত দিতেন না।
তাঁর সদ্ভাব ও সদ্ব্যবহার সকলের জন্যই ব্যাপক ছিল। সকলের জন্য তিনি পিতার মত স্বহৃদয় ছিলেন। অধিকারের ক্ষেত্রে সকলেই তাঁর নিকট সমান ছিল। তাকওয়া অনুসারে মর্যাদার তারতম্য হত। তাঁর দরবার ছিল জ্ঞান, সহিষ্ণুতা, লজ্জা, ধৈর্য্য ও আমানতদারীর। এখানে স্বর উচ্ছ করত না কেউ, কারো সম্মানে আঘাত দেয়া হত না, কারো ভুল-ত্রুটি প্রকাশ করা হত না। মজলিসে উপস্থিতজনেরা বিনয় হেতু অন্যের সামনে নিজেকে আনত রাখতেন। বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হত, ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শিত হত। প্রত্যেকের প্রয়োজনের সময় সহায়তা দান করা হত। পরদেশীদের দয়া করা হত ।
মজলিসে উপস্থিত লোকদের প্রতি তাঁর আচরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পিতাজী রা. বললেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা মুবারকে স্মিত হাসি ছড়িয়ে থাকত সবসময়। বড় কোমল ছিলেন তিনি। সহজেই একজনের কথা মেনে নিতেন। জেদ করতেন না তিনি। কঠোর প্রকৃতির ছিলেন না, কর্কশভাষীও ছিলেন না। চিৎকারের স্বরে কথা বলতেন না। অসঙ্গত কোন কথা বলতেন না। কারো দোষ বর্ণনা করতেন না। অতিরিক্ত প্রশংসা করতেন না। মেজাজ-বিরুদ্ধ কিছু হলে এড়িয়ে যেতেন। কাউকে নিরাশ করতেন না।
তিনটি বিষয় থেকে তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেন- রিয়া, অতিরিক্ত কথা এবং বেহুদা কথাবার্তা। তিনটি বিষয় থেকে অন্যকে বাঁচিয়ে রাখতেন- নিন্দাবাদ, কাউকে লজ্জা দেওয়া, কারো ছিদ্রান্বেষণ করা। যে কথায় সওয়াবের আশা বিদ্যমান সে ধরনের কথাই তিনি বলতেন। তিনি যখন কথা বলতেন তখন শ্রোতারা এত মনোযোগী হয়ে শুনতেন, মনে হত তাদের মাথায় যেন পাখি বসে আছে। তিনি যখন কথা বলে শেষ করতেন তখন অন্যরা কথা বলত। তাঁর সামনে কেউ কোনরূপ বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন না। কেউ কথা বলা শুরু করলে তিনি চুপ না করা পর্যন্ত অন্যজন কথা বলত না। উপস্থিত লোকজনদের প্রত্যেকের কথাই এত আগ্রহ নিয়ে শোনা হত যেমন প্রথম লোকটির কথা শোনা হয়।
যে কথায় অন্যরা হাসত সেই হাসিতে তিনিও যোগ দিতেন। যে কথায় অন্যরা বিস্ময় প্রকাশ করত তাতে তিনিও বিস্ময় প্রকাশ করতেন। আগন্তুকদের রূঢ় কথাবার্তাও তিনি সহ্য করতেন। তিনি বলতেন, প্রয়োজন- প্রত্যাশী মানুষের প্রয়োজন পূরণে সাহায্য করবে। কেউ তাঁর প্রশংসা করলে তিনি তা পছন্দ করতেন না। তবে কোন এহসানের বিপরীতে করলে সহ্য করে নিতেন। কারো কথা তিনি কাটতেন না। তবে সীমা ছাড়িয়ে গেলে থামিয়ে দিতেন বা নিজে উঠে চলে যেতেন।
এক বর্ণনায় আছে, হযরত ইমাম হুসাইন রা. বলেন, আমি আব্বাজানের নিকট নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চুপ থাকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, সে সময় চার অবস্থা ছিল তাঁর; সহিষ্ণুতা, সজাগ প্রজ্ঞা, পরিমাণের প্রতি লক্ষ্যদান আর চিন্তা ও ধ্যান। পরিমাণের প্রতি লক্ষ্য রাখার মর্ম হল উপস্থিত লোকদের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন এবং তাদের আর্জী-আবেদন শোনার ক্ষেত্রে সাম্য প্রদর্শন করতেন। ধ্যান ও চিন্তা ছিল তাঁর নশ্বর ও অবিনশ্বর বিষয়ে। সহিষ্ণুতা ছিল তাঁর ধৈর্যের সঙ্গে সমন্বিত। কোন সময় তিনি ক্রোধে সম্বিতহারা হতেন না। সজাগ প্রজ্ঞা ও সচেতনতা ছিল চার বিষয়ে: ভাল ও সৎ বিষয় গ্রহণের ক্ষেত্রে, যাতে অন্যরা তাতে তাঁর অনুকরণ করতে পারে; মন্দ বিষয় পরিত্যাগের ক্ষেত্রে, যাতে লোকেরা এসব থেকে বিরত থাকতে পারে; উম্মতের জন্য যা কল্যাণকর সে বিষয়ে তিনি তাঁর মতামত প্রদানে নিজেকে নিবদ্ধ রাখতেন; উম্মতের দুনিয়া ও আখিরাতে ভাল হয় সে বিষয়টি তিনি গ্রহণ করতেন।
আঁকা গেল কি? তিনি তো ছিলেন খালকান ও খিলকাতান শারীরিক গঠন ও স্বভাব চরিত্র উভয় সৌন্দর্যেরই পরিপূর্ণতায় পূর্ণময়, সৃষ্ট সৌন্দর্যের সব দিক চূড়ান্ত হয়েছে এখানে, শেষ এখানেই। তাই যে যেখানেই এবং যখনই তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়েছে, সব কথার শেষ কথা বলে শেষ করেছে এখানেই,
লা ইউমকিনুস সানাও কামা কানা হাক্কহু
বাদ আয় খোদা বুযুর্গ তুঈ কিসসা মুখতাসার।
সম্ভব নয় বলা তাঁর সানা ও সিফাত, খোদার পরে তুমিই শ্রেষ্ঠ সংক্ষেপে মোরা এই তো জানি।
কী যে ছিলেন সেই অনুপম, রূপময় রঙ্গময়রূপম।
আরও পড়ুন:বালাগাল উ’লা বি-কামালিহী, কাশাফাদ্দুজা বি-জামালিহী
নবীজির শানে গাওয়া জুনায়েদ জামশেদের বিখ্যাত ‘মেরে নাবী, পেয়াের নাবী’ নাতটি শুনুন।