অপসংস্কৃতির বেড়াজালে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান

অপসংস্কৃতির বেড়াজালে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

মিলাদুন্নবী তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম। এটাতো কারো অস্বীকার করার কায়দা নেই। পেয়ারা নবীর আগমনে কুল-কায়েনাত খুশি হয়েছিল। সকল অপশক্তির যবনিকাপাত ঘটেছিল। অমানিশার কালো অন্ধকার ঘোচায়ে পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার পেরিয়ে আলোর মশাল জ্বলে ওঠেছিল পৃথিবীজুড়ে। সেই মহামানবের সীরাত-জীবনী বারবার আলোচনা হওয়া দরকার। প্রতিটি দিন প্রতিটি ক্ষণ আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত। নির্দিষ্ট কোনো দিন- ক্ষণ নয়। সারা জীবনই তাঁর আদর্শের উপর জীবন পরিচালিত করতে হবে। তাঁর আদর্শের উপর থাকতে হবে অটল-অবিচল।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন। আবার তাঁর ওফাতও এ মাসে। তবে কিছু মানুষ রবিউল আউয়াল মাস আসলে নবীজীর জন্মদিবস পালন করে থাকেন। এটা নিয়ে বাগাড়ম্বরও আছে তাদের। একদম অপরিহার্য আমল হিসেবে এদিবস বেছে নিয়েছে। অন্যান্য ইবাদতের মতো এদিবস পালন করাও তারা জরুরী মনে করে। তাই তো এখন অনেক কিছু দেখা যায় রবিউল আউয়ালের চাঁদ উদিত হলে। বিশেষ করে এমাসের ১২ তারিখে তাদের যেন আর খাওয়া- ঘুম নেই। যার যেভাবে খুশি জন্মদিবস পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআন-হাদীসের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দলান্ধতা কাজ করে এবং অন্যের দেখাদেখি আমলে জোর দেন সবাই।

আমরা যখন ছোট্ট। তখনও রবিউল আউয়াল মাসে অনুষ্ঠান দেখতাম। অবশ্য তখন নবীজীর সীরাত নিয়ে আলোচনা হতে দেখেছি। কেউ কিছুটা বাড়াবাড়িও করেছে। তখন বিষয়টা শুধু মীলাদ মাহফিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। (প্রচলিত পদ্ধতিতে মীলাদ মাহফিল নিয়ে আলেমদের আপত্তি রয়েছে) কোনো কোনো এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে, কোথাও মসজিদে মসজিদে মীলাদ মাহফিল করে ক্ষান্ত থাকত। মীলাদের শেষে কিছু মিষ্টান্নের ব্যবস্থা হতো। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত গুড়ের ক্ষীর বা রসের ক্ষীর, ব্যস এতটুকু আয়োজন। শহরের মসজিদে জিলাপি এর ব্যবস্থা দেখেছি।

মূলতঃ তৎকালিন মীলাদ মাহফিলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন-কথা আলোচনা বেশী হয়েছে। পরিশেষে কয়েকবার দরুদ পড়ে দুআ পরিচালনা হয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে।

আমাদের ছোটবেলা সেটা আর কতদিনের কথা। হয়তো আশির দশক বা সত্তর দশকের শেষের দিকের কথা। বর্তমান সময় থেকে ৩৫/৪০ বছর আগের সময়ের ঘটনা এসব। কিন্তু এই তিন যুগের ব্যবধানে যেভাবে সংস্কৃতি বদল হয়ে গেল। পাল্টে গেল সেই ধারা। তাহলে ৫০/১০০ বছর পরে কোথায় যাবে আমাদের সংস্কৃতি। কোথায় গিয়ে ঠেকবে রবিউল আউয়াল মাসের অনুষ্ঠানমালা। মনে হচ্ছে দিনে দিনে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে যাচ্ছে আমাদের সুস্থ সংস্কৃতি।

কেননা ইদানিংকালে রবিউল আউয়াল মাস আসলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। বিকৃত আমাদের সংস্কৃতি। বিকৃত হচ্ছে ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুন। এখন আর সেই বাড়িতে বাড়িতে মিলাদ হয় না। নবীজীর সীরাত নিয়ে আলোচনা নেই। ভিন্ন অপরিচিত কৃষ্টি-কালচার মেধা-মননশীলতা দখল করে নিয়েছে। সেই সামান্য জিনিস বিকৃত হয়ে বিশাল আকারে তথা জসনে জুলুস, বর্নাঢ্য রেলী ইত্যাদী বিষয়ে রূপ নিয়েছে।

আল্লামা তকি উসমানী (দা.বা) এর ইসলাহী খুতুবাত পড়েছিলাম। সেখানে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা স্মরণ হলে আমার কলিজা কেঁপে ওঠে। তিনি বলেছেন, ঈসায়ীগণ তাদের নবী ঈসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম বার্ষিকী পালন শুরু করেছিল। মূলতঃ ঈসা আলাইহিস সালামের উর্ধআকাশে যাওয়ার ৩০০ বছরপরে কিছু ভক্ত-অনুরক্ত তাঁর জন্মদিন পালন করা শুরু করে দেয়। কিছু বিজ্ঞ আলেম সেসময়ে জন্মদিন পালনে বাঁধা দিয়েছিল। কিন্তু যারা জন্মদিন পালনকারী তারা যুক্তি দেখালো, আমরা খারাপ তো কিছু করছি না। ঈসার জন্মদিনে তাঁর গুণকীর্তন বর্ণানা করবো। এর দ্বারা ঈসা এর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হবে। মানুষ আবেগ-ভালবাসা দিয়ে ঈসার আদর্শগ্রহণ করবে।

ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিন পালন শুরু হলো। নির্দিষ্ট দিনে চার্চে গিয়ে সবাই জমা হতো। আর পাদ্রীরা ঈসার জীবনী আলোচনা করে শোনাতে লাগলো। কিন্তু সমস্যা হলো, সকলেই চার্চে আসে না। কেমন যেন নিষকষ অনুষ্ঠান। কোনো রসবোধ নেই তাতে। তাই অনুষ্ঠানকে রসালো এবং আকর্ষণীয় করার মানসে ঈসার জীবনী আলোচনার পাশাপাশি গানের আসর বসানো হলো। পাদ্রীগণ সীরাতের আলোচনা করে আবার গানও পরিবেশন করে।

কালক্রমে খ্রীষ্টানদের সেই চার্চে গানের সাথে শুরু হলো নাচের আসর। আস্তে আস্তে বিকৃত হয়ে গেল তাদের জন্মদিনের সেই অনুষ্ঠান। প্রথমে কিন্তু ভালো নিয়তে শুরু হয়েছিল। সওয়াবের আশায় তারা ঈসার জন্মদিন পালনের উৎসব আনলো, কিন্তু কালের আবর্তে বিলীন হয়ে তার মধ্যে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ঢুকে পড়লো।

এখন খ্রীষ্টানদের সেই ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন নামে যেটা পরিচিত। সেটাতো ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠান। এখন কী হয় সেখানে? দুনিয়ার যতো শরীয়ত গর্হিত কাজ তার মধ্যে। যতো অশ্লীলতা আছে সব এখন ২৫ ডিসেম্বরের বড়দিনে।

তদ্রুপ মিলাদুন্নবী পালন শুরু হয়েছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিরোধানের কয়েকশত বছর পরে। কোনো এক বাদশাহ খ্রীষ্টানদের ঈসা নবীর জন্মদিন পালন করা দেখে আমাদের নবীর জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নেন। সে বাদশাহ কিন্তু ভালো নিয়তে শুরু করেছিলেন, কিন্তু বর্তমান এর অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

আমরা যখন নব্বই দশকে ঢাকা এলাম, তখন দেখতাম, মওদুদী সাহেবের অনুসারী জামাতে ইসলামের লোকেরা রবিউল আওয়াল মাসকে স্বাগত জানিয়ে বর্নাঢ্য রেলী বের করতো। অনেক বছরধরে তারা এটা করেছিল। অবশ্য এখন তারা বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর চট্রগ্রামের কিছুলোক শুরু করলো। তারা নাকি পাকিস্তান থেকে আবিস্কার করেছে। সেখানকার পীরের মুরিদ তারা। সে পীর সাহেবও এদেশে আসেন। সে জসনে জুলুস চট্রগ্রাম থেকে ঢাকাতেও সাপ্লাই করেছে। এখন তো অনেক সাজ-সজ্বা এবং বড়সড় করে আয়োজন করে। এর বদআছর ঢাকার বাইরে গিয়েও আছড়ে পড়েছে। আগে শুধু বর্নাঢ্য রেলী ছিল। এখন মিউজিক সাথে আছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও চলছে এই অনুষ্ঠান। নামাজরত মুসল্লির বিশাল মূর্তি বানায়ে যুবকেরা ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে গাওয়া হচ্ছে “ইয়া নবী সালামু আলাইকা…’। এবার চিন্তু করুন, কীভাবে বিকৃত হচ্ছে মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান।

মোটকথা সেই খ্রীষ্টানদের রাস্তায় অগ্রসর হচ্ছে আমাদের মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠানগুলো। সঠিকধারা, সুস্থধারা বাকি থাকছে না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে অনুপ্রাণিত না হয়ে বিজাতীয় ধারায় চলা হচ্ছে। সীরাত আলোচনা নেই। ওদিকে রেলী চলছে। আবার কিছুলোক খোড়া যুক্তি দিয়ে মীলাদুন্নবীর অহেতুক অনুষ্ঠান জায়েজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেটা খুবই দুঃখজনক।

মুফতী শফি সাহেব (রহ.) বলতেন, ‘বানিয়া থেকে সেয়ানা কেউ নয়’। সমাজের বানিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা কিন্তু সবচেয়ে ব্যবসা ভালো বোঝে। কেউ যদি বলে আমি বানিয়াদের থেকে ব্যবসা ভালো বুঝি, মনে করতে হবে সে বেকুব। তদ্রুপ সাহাবায়ে কেরাম থেকে কেউ ইসলাম বেশী বোঝার চেষ্টা করলে মনে করতে হবে সে গর্দভ।

কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাগণের নবীর প্রতি বেশী দরদ-ব্যাথা ছিল। তারা পুঙ্খাপুঙ্খু রুপে ইসলাম পালন করেছেন। ইসলামের কোনো জিনিস ছেড়ে দেননি। যদি মিলাদুন্নবী তথা নবীর জন্মদিন পালনে কোনো সওয়াব থাকতো, তাহলে তারাই আগে পালন করে যেতেন, কিন্তু কোনো সাহাবী থেকে এসব আমল প্রমাণিত নয়। সুতরাং যেআমলগুলো সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন সোনালী যুগের কেউ করেনি, সেটা নিয়ে মাতামাতি করা বোকামী। এধরনের শরীয়ত বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহীহ বুঝ দান করেন। আমিন।

  • লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট

মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় লেখকের

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *