পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সরকারের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সরকারি ক্রয় নীতিমালার দ্রুত সংস্কার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও খাত বিশ্লেষকরা। ডলারসংকট নিরসনে প্রণোদনার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধা দেওয়া ও আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারেরও সুপারিশ করেছেন তাঁরা।
রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক ইন সেন্টারে গতকাল শনিবার ‘সংকটে অর্থনীতি : কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সংলাপে এসব সুপারিশ করেন অর্থনীতিবিদ ও খাত বিশ্লেষকরা।
সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কভিড কিংবা রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নয়। এই খাত দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতার ঝুঁকিতে ছিল। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, মূলত দুর্বল সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যাংকগুলোতে মূলধনের ঘাটতি রয়েই যাবে।
ফাহমিদা খাতুন ব্যাংকিং খাতে পরিচালকদের দায়িত্বে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের না দেওয়ার পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের বারবার ঋণ না দেওয়ার পরামর্শ দেন।
রেহমান সোবহান বলেন, বিভিন্ন সময় অর্থনীতির নানা সংকট নিয়ে সমালোচনা এবং পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সিপিডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে এগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। এ কারণে অর্থনৈতিক সংকটের উপসর্গ এখন ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। কেন এত সংকট, তা খুঁজে বের করতে হবে। কী সমাধান, তা-ও বের করতে হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, ‘সরকারের অর্জনও দেখছি। বিশেষ করে অবকাঠামো এবং জীবনযাত্রার মানে উন্নয়ন হয়েছে। তবে এই সংলাপে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকট নিয়ে ওঠা পর্যবেক্ষণকে অবহেলা করা যাবে না।’ সমালোচনার প্রতি ইতিবাচক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই সমালোচনা গঠনমূলকভাবে নিতে পারে সরকার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের অর্থনীতির সংকটে মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি একসঙ্গে দেখলে হবে না। দুটিকে আলাদা করে দেখতে হবে। দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে দুটি কারণে—একটি আন্তর্জাতিক, আরেকটি অভ্যন্তরীণ বাজারের অনিয়ম। তিনি বলেন, পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি দেশের মূল্যস্ফীতি কমতে সাহায্য করবে। ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির সমাধান সম্ভব নয়।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ভারতকে দেখছি তারা নানা ধরনের পণ্য আমদানি করছে রুশ মুদ্রা রুবলের মাধ্যমে। এখন আমরা যদি ডলার থেকে বের হতে চাই, তাহলে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করতে ইউয়ান দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কি ভবিষ্যতের বাণিজ্যের কথা চিন্তা করে এখন থেকে বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়টি ভাবতে পারে না?’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ঝড়ের আগে পরিবেশ খুব ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু যখন প্রলয় এসে যায়, করার কিছুই থাকে না। দেশের অর্থনীতিরও একই অবস্থা। অনেকে বলেন, জানুয়ারির মধ্যে ডলারসংকট কেটে যাবে, আমি বলি আগামী ছয় মাসেও ডলারসংকট কাটবে না। আরো বেশি সময় লাগতে পারে। তবে সরকারকে ধন্যবাদ, ঋণের বিষয়ে আইএমএফের সঙ্গে খুব দ্রুত সমাধান করতে পেরেছে।’
সংলাপের বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘এক দশক ধরে মনে হয় আমরা নীতিহীন অর্থনীতির মধ্য দিয়ে চলছি। আগেও ছিল, তবে সেখানে কিছু ভারসাম্য ছিল। সংসদেও সেই প্রতিচ্ছবি ছিল। টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, তদন্ত হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, ‘২৫ বিলিয়ন তো অনেক টাকা। রিজার্ভে যদি ২৫ বিলিয়ন টাকা থাকে, তাহলে আমরা এত শঙ্কিত কেন? তার অন্যতম কারণ রিজার্ভ কমছে এবং কমবেই। কারণ প্রবাস আয় কম আসছে।’
সংলাপে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির মূল সংকটের একটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতা। তারা বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। অথচ ভারতের মতো রাষ্ট্রে চারবার মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়। এটা তো বাজেট না যে বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, দেশের আর্থিক খাতে মূলত স্বচ্ছতার অভাব।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমাদের সুধীসমাজে ভয়ংকর মিসম্যাচ আছে। এটা সাংঘাতিক সমস্যা। আপনারা অর্থনীতিতে কালো মেঘ দেখছেন, আমি দেখছি সিলভার রেখা। আমাদের ঘাটতি আছে স্বীকার করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘অর্থনীতি অর্থমন্ত্রী চালান না, অর্থনীতি পরিকল্পনামন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চালান না। অর্থনীতি বাই রুল বাই অর্ডার চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাই আইন, কারণ উনি (প্রধানমন্ত্রী) সরকারপ্রধান। …আমি হয়তো আজ অসুস্থ বা অন্য কেউ অসুস্থ হলেন, আমি হয়তো অফিসে গেলাম না। তাই বলে কাজ তো আর পড়ে থাকবে না। আমি বলতে চাই, আমরা জেনেশুনেই অর্থনীতি চালাচ্ছি। আমরা কিছু পণ্ডিতের সঙ্গে কাজ করে এগুলো শিখেছি।’