আত্মার কাছে দাঁড়ানো সরীসৃপ : কাউসার মাহমুদ

আত্মার কাছে দাঁড়ানো সরীসৃপ : কাউসার মাহমুদ

কাউসার মাহমুদ

এমন দুঃখবোধ, করুণ তৃষ্ণার মতো গভীর মমতাবোধের অভাব—জীবনে বহুবার উপলব্ধ করেছি আমি। তাই বলে নিঃস্ব প্রলেতারিয়াতের মতো এই অসহ্য হাহাকার হয়তো জাগেনি কখনো। মনে হয় কোনো অপরিচিত, অগ্রাহ্যের মতো পৃথিবীর বুকে হাঁটছি। স্বাদ-বিস্বাদের সমূহ আকাঙ্খা কোথা যে মিলিয়ে গেল আমায় ছেড়ে! জানি না। বুঝি জানবার তাড়াও নেই। শুধু ক্রমশই নিজের অস্তিত্বের ভেতর গুটিয়ে গিয়ে প্রবল দুঃখবোধের বুকে ধীর শুয়ে পড়া। তারপর দুঃস্বপ্নের অগুনতি দৃশ্যের ভেতর, অতি সন্তর্পণে হেঁটে হেঁটে বুনট অন্ধকারের কাছে এসে দাঁড়ানো। অচল, অচঞ্চল হয়ে বহুবিধ কিছু ভ্রমের সম্মুখে নত মুখ। যেন এরাই আমার বন্ধু। আমার একান্ত বীবর।

এই যেমন ঠিক এখনও। তেমনই নিঃসঙ্গ, তেমনই ব্যাকুল হয়ে আছে হৃদয়। চারপাশে গমগম নীরবতা মাঝে,বহুদূর কোথাও একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে। এ ছাড়া কেবলই কবরের অন্ধকার ছড়ানো জরাজীর্ণ, স্যাঁতস্যাঁতে একটা ঘরে পড়ে আছি। বিছানাটা এলেমেলো। পড়ার টেবিলটা বেজায় অগোছালো। এখানে-ওখানে পড়ে আছে ভাতের থাল, গ্লাস, জগ, চামচ—যেন এসবের কিছুতেই সামান্য বিকার নেই আমার। আগ্রহ নেই জীবনের স্বাভাবিক ধারাপাতে। যেন যা হচ্ছে, যেসব ঘটছে, যা-কিছুই করছি; এসবের নিয়ন্তা আমি নই। গোড়া, অথর্ব, মূক—কখনো এমন বহু বিশেষণের উপলব্ধি আমার হয় ঠিক, তখন নিজেকে কেবলই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বর্বর এক অস্তুিত্বপ্রাণ মনে হয়। তবুও কোনো বোধ জাগে না আমার। মাসের পর মাস, দিনের পর দিন, সমস্ত স্বাভাবিকতা থেকে ব্যবচ্ছেদ করে—বাহ্যত অল্প তবে আদতে প্রবল এক দুঃখবোধ ও অনীহার তলে নিজেকে নত করে দিয়েছি। কেন? এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পাইনি।

প্রকৃত এই পাওয়া না পাওয়ার হিসেবটা এতো গৌণ হয়েছে যে মনে হয় যদি তা ঠিকঠাক করতে পারতাম! তাহলে এ জীবন, এই অমনিবাস তুচ্ছ হলেও কিছুটা মধুর হতো। এমন ম্লান, বিষন্ন দগদগে দুপুরের মতো এতোটা তাপদহ আর বিধুর হতো না নিশ্চয়। যা হোক, জীবনের সমস্ত জরা, সংকীর্ণতা, প্রতিকূলতার পরও কখনো কখনো তা মনোহর হয়ে ওঠে। অপার সৌন্দর্যের মতো চারপাশে ফুটে থাকে মনোরম মায়াময়তা। তখন ক্ষণকাল, বিন্দুর শরীরে দাঁড়ানো একটি চিহ্নের মতো হলেও নিজেকে সুখী মনে হয়। বুঝিবা এ আনন্দ অপার্থিব। যখন দেখি, একটি পতঙ্গ কোনরূপ দ্বিধাবোধ ছাড়াই অনায়েসে তার পাখা মেলে উড়ে যায়। লতাবিতানের সার ছেড়ে কখনো ফুল কখনো মুকুলের ঠোঁটে গিয়ে ঠায় বসে পড়ে। স্বর্গের পথ থেকে কোটি ক্রোশ পথ মাড়িয়ে এসে আমার এই মলিন মুখটির ওপর, মুহুর্তকাল শোভাময়ী হয়ে আছে যা।

যেখানে আছি, বলছি বর্তমান বাসস্থানের কথা। এখানে বহু রাত বহু দিন ঘুরে কদাচিৎ কখনো হয়তো অমন প্রকৃতি বা পতঙ্গের দেখা মেলে। তাই কিনা ওই উপলব্ধি, ওই অনুভব তন্ময়তা এতোটা প্রবল আর গাঢ় হয়ে ছুঁয়ে যায় আমায়। নইলে দিনমান শুধু অতিকায় পাথরের বজ্র দেয়াল আর বৃহৎ রুক্ষ পর্বতশ্রেণীর কঠোরতার ভেতরই দু’চোখ আটকে থাকে। মাঝেসাঝে বিকেলে ছাদের কোণে এসে দাঁড়ালে, দূরে ওই পাহাড়র ভাঙা ভাঁজটার একপাশে গুটি কয় বাবলার ঝোঁপ চোখে পড়ে। এছাড়া কোনো সবুজ, বৃক্ষ বা গুল্মলতার কিঞ্চিৎ আবহও দৃষ্টিতে থামে না। তবু ওই…ওই কণ্টকাকীর্ণ বাবলার ডালেই তাকিয়ে থাকি অমলিন। কখনো ছোট্ট ক’খান আবাবিল পাখি পুচ্ছ দুলিয়ে উড়ে যায়। যেন কোথাও সুস্থির একদণ্ড বসার মন নেই তাদের। এ ডাল ছেড়ে ও ডাল—ছোট্ট সেই ঝোপের ভেতর অনবরত তাদের ওই উড়াউড়ি কী এক প্রবল বিষাদে যেন মনটা ভার করে তোলে। আহা! কোথাও দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের উদ্যান নেই বুঝি এ দেশে। চারপাশে খাঁখাঁ রুক্ষ্ম এই মরুভূমি মাঝে কোথায়বা যাবে এই ছোট্ট পাখির দল। কোথায় বা পাবে মধুকুঞ্জ, ফুলমল্লিকার গৃহাগত শোভা!

মূলত ‘আভা’ থেকে পূবে নেমে আসা ‘হারজাহ’ স্বাভাবিক আবহাওয়া ধরে রাখলেও এই পথ ক্রমাগত পাহাড়ের নীচেই নেমেছে

তারপর ধীরস্থির হয়ে একসময় নেমে আসে সমাগত সন্ধ্যা। রৌদ্রতেজে জ্বলজ্বলে কঠোর আকাশটি ক্রমশ নতভাব নিয়ে প্রচ্ছন্ন সাদা হয়ে ওঠে। দিনমান রুদ্রপ্রতাপের সেই প্রখরতা ক্রমশ নিস্তেজ, নিথর ও বিবর্ণ হয়ে যায়। যেন ঠিক জীবনের মতোই—নতজানু, পরাঙ্মুখ। সহসা নয় বরং নিয়তির মতোই এমন পাণ্ডুর হয়ে নুয়ে পড়ে অমল রাত্রির গর্ভে পিঁপড়ের মতো হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যায়। আমিও তখন দিনভর পড়ে থাকা পোকাটির মত হঠাৎ গুঙিয়ে উঠি। বলা যায় কিছুটা ধাতস্থ হতেই কোনোরকম একখানা জামা চাপিয়ে, পায়ে-পায়ে নীচে নেমে আসি। সমস্ত সময় নির্জনতার ভেতর ওভাবে জড়িয়ে থাকা স্তব্ধতা থেকে কিছুটা বেরোতে, কিছুটা ফাঁকা নিশ্বাস নিতে—কোলাহল বা জনারণ্যের দিকে এগিয়ে যাই।

পূর্বেও কোনো এক রচনায় বোধকরি বলেছি যে বিস্তৃত আরব দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় এ অঞ্চলটি সবচেয়ে ঠাণ্ডা। প্রকৃতি মোলায়েম, সহনীয় ও শীতার্ত। তাই বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময়জুড়ে সন্ধ্যার পর পুরো ‘আভা’ অঞ্চলে হীম-কালের একটা স্রোতধারা বয়ে যায়। যেখানে আছি এই জায়গার নাম ‘আল হারাজাহ।’ শহর থেকে গাড়িতে প্রায় একঘন্টার দুরত্ব পথ। মূলত ‘আভা’ থেকে পূবে নেমে আসা ‘হারজাহ’ স্বাভাবিক আবহাওয়া ধরে রাখলেও এই পথ ক্রমাগত পাহাড়ের নীচেই নেমেছে। ফলত পরবর্তী কয়েকশো কিলোমিটার অবধি একেবারে ইয়েমেনের বর্ডার পর্যন্ত নাজরান, জিযান, ফরশাহ—অঞ্চলগুলো বেশ প্রখর ও উত্তপ্ত আবহাওয়ার। শুনেছি সন্ধ্যার পর ও এর আগে বিকেল পড়তেই লোকজন রাস্তার ধারে বিভিন্ন পার্ক অথবা অবসর যাপনে নির্মিত কৃত্রিম উদ্যানগুলোতে এসে জড়ো হয়। কিন্তু হারজাহ বা রেজমায় এমন মচ্ছব দেখিনি খুব।

প্রকৃতি শীতল হওয়ায় এখানকার স্থানীয়রা তাদের ঘরেই থাকে। ছাদ বা প্রাসাদোপম অট্টালিকার চৌহদ্দির ভেতরও তাদের আছে পূর্ণব্যাদিত খোলা জায়গা। কিন্তু আমাদের মতো শ্রমজীবিদের, রাস্তার দু’পাশ ও সারি সরি দোকানগুলোর সম্মুখভাগই কিছুটা স্থিরচিত্তে দু’দণ্ড বসার নির্ধারিত জায়গা। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে, গা-গোসল দিয়ে, এক কাপ চা বা কফি নিয়ে ধীরে ওসব জায়গায় এসে বসে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আগত প্রবাসীরা। মিসর, ইয়েমেন, সুদান, আফ্রিকা, মরক্কো, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, তুরস্ক, নেপাল, ফিলিপিন, সিরিয়া কোথাকার লোক নেই এখানে! যেন পৃথিবীর মানুষেরা কি এক অপার্থিব ভাগ্যান্বেষণে কঠোর এই আরব অঞ্চলে যুগের পর যুগ প্রাচীন দাসদের মতোই পঙ্গপালের মতো ছুটে আসছে। দাস বলাটা মনে হয় অসমীচীন হয়নি। কারণ যেকোনো দেশের যেকোনো মানুষের সঙ্গেই কিছুটা অন্তরঙ্গ বা বন্ধুত্ব করে তাদের দুঃখের গল্প শুনতে পেরেছি।

প্রায় নিত্যকার এই সকরুণ অভ্যস্ত বাস্তবতা এতোটা জাপটে ধরে যে, দু-চোখে জলের বদলে শুধু এক দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে

এখানে প্রবাসীরা কফিল বা বলতে গেলে মনিবের আয়ত্বাধীন। মাসে মাসে তিনশো থেকে পাঁচশো রিয়াল খাজনা দিতে হয় তাদের। এছাড়া আরো কত রকমফের আছে আরবদের তা বলাই বাহুল্য! ফলত খুব কম মানুষই স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে। কোথাও বসলে, কারো সঙ্গে সাক্ষাত হলে প্রায়ই নানারকম বেদনাবিধুর গল্পে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আল্লাহ মাফ করুন! প্রায় সোয়া দু’বছর যাবৎ একেবারে ক্ষুদ্র, সামান্য এক চাকুরীর সুবাদে, গ্রাম্য, শহুরে সবধরনের আরবের সাক্ষাতই পেয়েছি—কিন্ত দুর্ভাগ্য হায়! এদের অধিকাংশকেই কর্কশ, রূঢ় মনে হয়েছে। শুনেছি মক্কা-মদিনার অধিবাসীরা এদের তুলনায় হাজার গুণ দয়াপরবশ। কোমল নরোম মনের। নিশ্চয় তা সত্যিই।

তবুও তো এ জীবনই বেছে নিতে হয়েছে আমাদের, আমার। জানি না হতভাগ্য এই জীবনের শেষ কোথায়! কবেই বা বিক্ষুব্দ, ঘৃণ্য এ সময় শেষ করে অনন্তকাল কোনো সরোদ সঙ্গীতের কাছে নিশ্চুপ বসতে পারবো। যার সুর, স্বর কখনো উচ্চগ্রামে ওঠে মৃদু বাতাসের ধ্বনি থেকে আবার মোলায়েম লয়ে নেমে আসবে। এমনই কল্পনার ভেতর দিনমান আবদ্ধ ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে যখন কোলাহলের দিকে এগিয়ে যাই, দেখি, শ্রমিকেরা কিছু দূরে দূরে তিন-চারজন জটলা বেঁধে বসে আছে। কারো হাতে কফি বা চায়ের কাপ কারো হাতে অর্ধ্বজ্বলা চুরুটের ভগ্নাংশ। খুব অমনোযোগী হয়েও তাদের দেখলে মনে হয়,একেকজন শ্রমজীবী মানুষ যেন তার সমস্ত জীবনের ক্লান্তির বোঝা কোন সুদূরের উদ্দ্যেশ্যে বয়ে নিয়ে চলছে। তাদের চোখেমুখে ফুটে আছে পরিশ্রান্তি, ক্লান্তিতে নুহ্যভার বাহু দুটো যেন চলতেই চায় না। বিচিত্র পোষাকে আধো অন্ধকার, আধো আলোর ভেতর স্থানুর মতো ভিনদেশীদের সেই নীরব বসে থাকা বড়ো বিমর্ষ জাগানিয়া। যেন করুণ কোন নাটিকার মর্মন্তূদ শেষ দৃশ্যপট। খুব কাছ দিয়ে গেলেও ঠোঁটের মৃদু কম্পনটুকু ছাড়া কোনো শব্দই উপলব্ধ হয় না।

এমন বহুবিধ নিদারুণ দৃশ্যপাট পাশ কাটিয়ে একসময় পুনরায় নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়াই। বিচূর্ণ হৃদয়ের আয়নায় প্রতিবিম্বত আমার মুখটা যেন করুণ সুরে কেঁদে ওঠে। সমস্ত বিষাদ প্রচণ্ড মেঘের মতো মন ছুঁয়ে যায়। কাঁদতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু প্রায় নিত্যকার এই সকরুণ অভ্যস্ত বাস্তবতা এতোটা জাপটে ধরে যে, দু-চোখে জলের বদলে শুধু এক দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে। উজ্জ্বল রাতের শরীরে লেগে থাকা প্রোথিত গন্ধ ভেদ করে আমার ওই একান্ত নিবাস আর জরাজীর্ণ যাপনের মুখচ্ছবিটাই ভেসে ওঠে শুধু। যেন কোথাও যাওয়ার নেই আমার। কোথাও পালাবার তাড়াবার নেই। শুধু ওই গন্ধকূট পর্দার আড়াল থেকে একবার উঁকি মেরে জীবনকে ছুঁয়ে দেওয়া। যেন নিজেরই আত্মার কাছে দাঁড়ানো এক ক্লান্ত সরীসৃপ।

লেখক: কবি ও অনুবাদক

 

আরও পড়ুনঃ ঘুষ : সা’দত হাসান মান্টো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *