- আশরাফ উদ্দীন রায়হান
আবদুল্লাহ শাকির নামের মানুষটির সাথে অতটা সখ্যতা না থাকলেও তাঁকে বিলক্ষণ দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি গভীর রাতের কনকনে ঠাণ্ডায় পূর্ণায়ত কৈশোরে যখন ঢাকার চৌধুরীপাড়া ইকরা কমপ্লেক্সে হাজির হই, তখন এই মানুষটিই আমাকে ইসতিকবাল করেছিলেন। বোর্ডিং থেকে তাৎক্ষণিক খাবার-দাবারের ইনতিযামও হয়েছিল তাঁর কল্যাণেই। একই অঙ্গনে থাকার সুবাদে তাঁর সাথে ওঠাবসা, চলাফেরা এবং মেলামেশা হয়েছে নিয়মিতই।
মাওলানা আবদুল্লাহ শাকিরকে আমরা বিবেচনা করতাম শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাত বারাকাতুহুমের জ্যেষ্ঠ তনয় ও জানেশীন, ‘মিঞাভাই’ খ্যাত হাফেয মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন সাহেবের একান্ত সচিব হিসেবে। এজন্যে তাঁকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিম্মাদারিও আঞ্জাম দিতে হতো। বিশেষত, মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়ার জন্য মাওলানা শাকিরের নিরলস পরিশ্রম চোখের সামনেই দেখেছি। আমি নিজেও তাঁর পরিশ্রমকে লাঘব করার জন্য অনেকবার সম্পৃক্ত হয়েছিলাম সে সময়।
বড় হুযূরের বিভিন্ন খাছ খাছ দায়িত্বেও তাঁকে নিয়োজিত থাকতে দেখেছি। সাত বছর আগে কক্সবাজারের উখিয়ায় আশ্রিত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শিবিরেও নিজের কর্মনিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন বলে শুনেছিলাম। এছাড়াও ইকরা কমপ্লেক্সের বড় বড় প্রোগ্রামগুলোতে অত্যন্ত সক্রিয় থেকে কাজ করার ঘটনাও উল্লেখ করার মতো বিষয়। এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, মাওলানা আবদুল্লাহ শাকির ‘অর্গানাইজিং ক্যাপাসিটিতে ইউনিক’ একজন মানুষ।
নিয়তির ঘূর্ণিপাকে আমরা পরস্পর আলাদা হয়ে গেছি তাও বছর চারেক আগে। যোগাযোগ না-ই বললেই চলে। গত বছরের জানুয়ারিতে তাঁর ফেসবুকের একটা পোস্টে আমি কমেন্ট করেছিলাম। সেই পোস্টে কী লেখা ছিল আর আমি কী মন্তব্য করেছিলাম তা আর আজ মনে করতে পারছি না। তবে সে দিন রাতেই আনুমানিক এগারোটার পরে আমাকে কল দিয়েছিলেন। আমি তাঁর ফোন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম! তিনি তাহলে আমার মতো অভাজনের ফোন নম্বর নিজের সংগ্রহে রেখেছেন? আমি তো রাখতে পারিনি। ফোনে কমবেশি কথা হলো। আমার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম আদরস্নেহের কথা কানে মধুবর্ষণ শুরু করেছিল। তাঁর সে দিনকার প্রেরণামূলক ও উৎসাহব্যঞ্জক কথাবার্তা আমার স্বপ্নছোঁয়ার পারদটাকে ঊর্ধ্বগামী করে তুলেছিল।
এরপর থেকে অদ্যাবধিই আর কোনো রকম যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। আমার নিজের পড়ালেখা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজকাম ঠিক রাখতে গিয়ে ইদানিং অনেকের সাথেই যোগাযোগবিচ্ছিন্নই হয়ে গেছি। গণমাধ্যমের বরাতে জানতে পারছি যে, উজান থেকে আসা ঢলে সিলেট জেলা ইতোমধ্যেই বন্যাকবলিত হয়েছে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়াকালীন সিলেটে এক চিল্লার জন্য চল্লিশ দিন সময় অতিবাহিত করেছিলাম। সে কারণে ওখানকার মানুষজনের সাথে আমার ভীষণ মায়াময় একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেখানকার কৃষ্টি-সভ্যতা আমাকে দারুণভাবে আপ্লুত করেছিল। খুব ভালো সময় কাটিয়েছিলাম সিলেটে।
আজকে বেশ কিছু দিন পর ফেসবুকে ঢুকতেই মাওলানা আবদুল্লাহ শাকিরের টাইমলাইনে নজর আটকে যায়। নাতিদীর্ঘ একটা লেখা; অত্যন্ত আবেদনময়। কিন্তু এর চেয়েও বেশি হৃদয়বিদারক একটি ছবি। বন্যার পানি চলে আসা ডাঙায় একটি নৌকা। সেখানে পাঞ্জাবি-টুপি পরা জনাপাঁচেক মধ্যবয়সী লোক। ত্রাণ তৎপরতায় নিমগ্ন তাঁরা। এঁদের মধ্যে সবার সামনের মানুষটির পাঞ্জাবির সামনের ও পেছনের অংশ জোড়া লাগিয়ে বেঁধে রাখা, পায়জামা আজানু ভিজে গিয়ে জবজবে হয়ে আছে। ত্রাণভর্তি ব্যাগের ঘষায় টুপিটাও সরে গেছে খানিকটা। বাম কাঁধে ত্রাণের ব্যাগ বাম হাত দিয়ে সজোরে চেপে ধরে বাঁধভাঙা পানি ভেঙে কাউকে দিতে যাচ্ছেন। এই লোকটিই আবদুল্লাহ শাকির। সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আবদুল্লাহ শাকির, আপনার প্রতি আমাদের সবিনয় নিবেদন, একজন জনবান্ধব জনপ্রতিনিধি হিসেবেই নিজেকে জনগণের খেদমতে উজার করে দিবেন। আর এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য যা করার সবই করবেন, ইনশাআল্লাহ। সিলেটের বন্যাকবলিত সকল মানুষের জন্য কায়মনোবাক্যে দুআ করছি।
- লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী