- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
বৈচিত্রময় জীবন আমাদের। রঙবেরঙের মানুষের সাথে ওঠাবসা। এই দেশে বিভিন্ন ফেরকা, বিভিন্ন জাতি, নানান মতের মানুষ বাস করে। একটা ছোট দেশে এত মত ও পথের লোক দেখা যায় না। বিভিন্ন গোষ্ঠি এবং হরেকরকম চিন্তা- চেতনা নিয়ে চলে। কেউ হকের নিশান উড়ায়, কেউ বাতিলের ধ্বজাধারী। কেউ হক ও বাতিল গুলিয়ে ফেলছে। অনেকে হকের লেবাস পরে আছে অথচ সে বাতিল। তার চিন্তা- চেতনা গলদ। আবার কেউ কেউ বাতিল আকড়ে আছে কিন্তু তার কোন খবর নেই।
এভাবে বহু হকপন্থী আলেম উলামা বাতিলের রাহুগ্রাসে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তে বাতিলের করালগ্রাসে আহত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছে। তারা দিনে দিনে আকাবির-আছলাফের দর্শন থেকে ছিটকে পড়ছে। একারণে এসব আলেম-উলামাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। তাদেরকে ইসলাহ বা সংশোধনের দিকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। আত্মশুদ্ধির মারকাজ চালু করে তাদের ইসলাহ করা অতীব জরুরী। নতুবা বড় ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
ইসলাহ তথা সংশোধনের বিকল্প নেই। আত্মার ইসলাহ, চরিত্রের সংশোধন, চিন্তা-চেতনার সংশোধন, বাতিল সম্পর্কে স্বচ্চ ধারণা দেওয়া, আমলের প্রতি উৎসাহী বানানো। এসব ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের নবীন আলেম, মসজিদের ইমাম এবং বিভিন্ন স্হানে দায়িত্বরত ব্যক্তিগণকে নিয়ে প্রশিক্ষণ মজলিস হওয়া চাই।
এখন ফেরাকে বাতেলা সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই। অনেক বড় বড় মাদ্রাসার মোহতামিম, মুহাদ্দিস, মুদাররিস, ইমাম তাঁরা বাতিল ফেরকার রুপ জানা নেই। ফেরাকে বাতেলার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা নেই। শুধু মুখে মুখে কিছু জানা আছে।কিন্তু দালিলিক কোন জ্ঞান নেই। কোন কিতাব মুতালায়া নেই। শুধু মুরুব্বীদের বক্তব্য চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন মওদুদী, কাদিয়ানী, বাহায়ী, এসব বাতিল ফেরকা সম্পর্কে অনেকের গভীর জ্ঞান নেই। অনেকে তাদের সব কিতাব মুতালায়াও করেননি। এমনি ভাবে লা-মাজহাবীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এবং দলিল সম্পর্কে অনেকেই অজানা। এরকম বহু ফেরকা এবং ফেৎনা আমাদের দেশে রয়েছে। তাদের বিচিত্র ধরনের চরিত্র।তাদের ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। নচেৎ তাদের সাথে কথা বলে পারা যাবে না।
এক সময় আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে ফেরাকে বাতেলা সম্পর্কে ট্রেনিং দেওয়া হত। সে ব্যাপারে নিয়মিত কিতাবাদী পড়ানো হত। ছাত্রদেরকে তৈরী করা হত। বিভিন্ন তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে ছাত্ররা প্রশিক্ষণ নিয়ে বাতিল ফেরকা সম্পর্কে তাদের পুরোপুরি জ্ঞান চলে আসত। সে কারো সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক না করুক, অন্তত ভবিষ্যতে সে কখনো বাতিল ফেরকার রোষানলে পড়ত না। বাতিল তাকে গ্রাস করতে পারত না। কিন্তু আজকাল সেরকম ব্যবস্হা এখন সব মাদ্রাসাতে নেই। কোথাও কোথাও থাকলেও সেরকম গুরুত্ব দেওয়া হয়না। তাছাড়া আমাদের কিছু বর্ষীয়ান মুরুব্বীদের রাজনৈতিক সমাঝোতায় কিছু কিছু বাতিল ফেরকার ব্যাপারে আমরা নমনীয়। এর দ্বারা এখন বহু নবীন আলেম ও মসজিদের ইমাম হক ও বাতিলের পার্থক্য করতে পারেন না। তবে এই নমনীয়তায় আমাদের বড় ক্ষতি হচ্ছে, যেটা বর্ণনাতীত।
এক. বর্তমান আমাদের দেশের কিছু কিছু আলেমদের অবস্তা শোচনীয়। ওরা তো কোনটা বাতিল আর কোনটা হক সেটা এখনো তমিজ করতে পারে না। যার কারণে বাতিলের সংস্পর্শে থেকে এখন হককে অস্বীকার করতে চাচ্ছে এবং বাতিলকে হক মনে করে মানুষকে গোমরাহীর দিকে ধাবিত করছে।
দুই. ফেরাকে বাতেলার সংস্পর্শে আত্মার সংশোধন নেই। এ ব্যাপারে তাদের মাথা ব্যাথা নেই। তারা এটাকে প্রয়োজন মনে করছে না।
তিন. চারিত্রের অবনতি হচ্ছে ওদের সাথে মিশে আখলাক-আমলের চরম অবনতি। আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে এখন সেই সোনার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না।
চার. আত্মশুদ্ধির মেহনত কমে গেছে। আগে প্রতিটি মাদ্রাসা একটা খানকা ছিল। কিন্তু এখন সেটা নেই। ফেরাকে বাতেলার সোহবতে তারা আত্মশুদ্ধিকে অবহেলা করছে। নিজের সংশোধন না থাকার কারণে অন্ধকারে চলে যাচ্ছে তারা।
এখন উত্তরণের পথ একটাই। আগের মত আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে সেই ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রাখা দরকার। ফেরাকে বাতেলা সম্পর্কে প্রতিটি মাদ্রাসাতে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রত্যেক বাতিল ফেরকা সম্পর্কে প্রচুর কিতাব জোগাড় করা এবং সে বিষয়ে অধ্যয়ন জরুরী। দালিলিক জওয়াব সব সময় রেডী রাখা। যাতে বাতিলদের সঠিক জওয়াব দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন: ওয়াজ মাহফিল হোক রাজনীতি মুক্ত
এছাড়া আত্মশুদ্ধির ট্রেনিং চাই প্রতিটি মাদ্রাসার শিক্ষকদের। কোন বজুর্গ ব্যক্তির সোহবতে সময় কাটানো। আবার সেই প্রতিটি মাদ্রাসাকে খানকা বানাতে হবে। তাহলে আত্মার সংশোধন হবে। আত্মশুদ্ধির মারকাজ আবার চালু করতে হবে। এর জন্য আমাদের মাদ্রাসাগুলোর যত বোর্ড আছে তাদের পদক্ষেপ নেওয়া চাই। তাদের মাধ্যমে ইন্তেজাম হলে সহজতর হবে। বাধ্যতামুলক করলে ফায়দা পাবে সকলে। আল্লাহ তায়ালা সহজ করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট