আবার যাবো তাড়াইলে

আবার যাবো তাড়াইলে

  • মুহাম্মাদ আইয়ুব

শান্তি ও প্রাপ্তি শব্দ দুটির সমার্থ্যক আয়োজন হচ্ছে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের ঐতিহ্যবাহী বেলংকার ইসলাহী ইজতেমা। প্রথম গিয়েছিলাম আজ থেকে আরো তেরো বছর আগে ঠিক ২০১০ সালের এক মাঘে। গ্রামের মেঠোপথের ধারে নিরিবিলি প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে মোড়ানো এক গল্পের মতন গ্রাম। আমি গ্রামেরই ছেলে,  কিন্তু গ্রাম যে এতো সুন্দর নির্ঝঞ্ঝাট তা বেলংকায় না গেলে কোনদিন বুঝতাম না। সেবার ঢাকা থেকে চড়ে তাড়াইল স্টেশনে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম রাত ১ টায়। চাঁদনী রাতে হৈ হল্লা করে হাঁটার ঐ একটা স্মৃতি হৃদয়ের মনিকোঠা দখল করে আছে। জামিয়াতুল ইসলাহ ময়দানের প্যান্ডেল দেখে ধরে নিলাম গাঁও- গ্রামের ওয়াজ মাহফিলই হবে, আকারে একটু বড় এই আর কি।

কিন্তু পর দিনই আমার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। বিশাল সামিয়ানা ভরে উঠল সন্ধ্যা গড়াতেই। দূর দূরান্ত থেকে মুসল্লীরা আসছিল বড় হুজুরের বড় সভায়। ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, সিলেট,হবিগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, ঢাকা ও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন থানা থেকে আগত মুসল্লী দিয়ে জমে উঠল বড় সভা।

বিশ্ব ইজতেমার জৌলুস নিয়ে যিকির আযকার, ইবাদাত, মুরাকাবা মুজাহাদা, ইলম ও আমলের মশকে যেন পুরো ময়দান এক টুকরো আসহাবে সুফফার নমুনা হয়ে নেমে এলো বেলংকার এই ইছাপশরে। ইসলাহী ইজতেমাকে কেন্দ্র করে পুরো অঞ্চল জুড়ে সাজ সাজ রব। জামিয়া ইকরা থেকে তো আমরা জামাতবদ্ধ হয়ে সবান্ধবে উপস্থিত হয়েছি ময়দানে। বড় সভাকে ঘিরে এলাকার মানুষজনের যে আবেগ উদ্দীপনা আকাঙ্ক্ষা অভিব্যক্তি তাতে আমরা গলা ছেড়ে গাইলাম, আজকে খুশীর ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।

বেলংকার এই রূহানী শাহী আয়োজন হয় মূলত, বাঙালী জাতির আধ্যাত্মিক রাহবার, শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা.বা. এর আহবানে। হুজুরকে এক নজর দেখতে, তাঁর বয়ান জিকির, নসীহত, দোয়া শুনতে আবেগপ্রবণ হয়ে মুসাফাহা করতে হুজুরের এলাকার প্রত্যেকটি মানুষ পাগলপ্রায়। যখনই জানতে পারে যে পীর সাহেব এসে গেছেন অমনি দেখি ছুটছে সব পঙ্গপালের মতো পাগল হয়ে।

নিজ এলাকার মানুষের কাছে এমন বিরল ভালোবাসা পাওয়া বাঙালি হুজুরদের বেলায় খুব কম চোখে পড়ে । কাকডাকা ভোর পেরিয়ে যখন বেলা বাড়ে অমনি ক্ষেতের আইল ভেঙে, গ্রামের মেঠোপথ মাড়িয়ে কালো বোরকায় আবৃত হয়ে মহিলাদের ঢল নামে চারিদিক থেকে। গন্তব্য সবার মহিলা প্যান্ডেলের দিকে।

নিজ এলাকার মানুষের কাছে এমন বিরল ভালোবাসা পাওয়া বাঙালি হুজুরদের বেলায় খুব কম চোখে পড়ে

এখানে সবাই পেতে চায় আত্মার খোরাক, জীবন চলার পাথেয়। এই তো মাত্র তিন দিন, মা -বোনদের কাছে সময়টা বড্ড দামী, গণিমত। একবার চলে গেলে আবার সুদীর্ঘ বারো মাসের অপেক্ষা। সালেকীনদের জন্য বেলংকার তিনদিন যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়।

বিদায়ের পালা শুরু হয়ে যাবে এই তো কিছুক্ষণ পর। চারিদিকে নিরব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায়। প্রাপ্তির তালিকাটাই দীর্ঘ হয় ইসলাহী এ ময়দানে। সবশেষে সবার শ্রদ্ধেয় পীর সাহেব আসেন সফেদ শুভ্র বসনে, আত্মার খোরাক নিয়ে। আল্লাহর পথের যাত্রীদের সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাত কিভাবে কাটবে সেই দিক নির্দেশনা দেন কুরআনের আলোকে নববী তা’লিমের মাধ্যমে।

তারপর শুরু হয় সবার কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ। শুরু হয় উথাল পাথাল ঢেউ, ‘ও গো মালিক মাফ করে দাও’ তওবার সাগরে উঠে প্রবল ঝড় সঙ্গে কান্নার ঢেউ।আসছে ২৬, ২৭, ২৮ জানুয়ারী আবার যাবো তাড়াইলে, আল্লাহ পাগলদের ভিড়ে একটু আশ্রয় পেতে। মাবুদ তুমি কবূল করো। আমীন।

লেখক: শিক্ষক, অনুবাদক ও মাদরাসা পরিচালক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *