- মুহাম্মাদ আইয়ুব
আমরা মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা প্রায়ই স্কুল কলেজ ভার্সিটির শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে সমালোচনা করি কিন্তু একটি বারও নিজেদের পায়ের দিকে তাকাই না। আমরা কী করছি? বড় বড় পাগড়ি জুব্বা দেখে সরলমনা মুসলমানরা আমাদের ফেরেশতা ভেবে তাদের কলিজার টুকরো আদরের দুলালদের পরম বিশ্বাসে পাঠিয়ে দিচ্ছে যে, হুজুররা আমার ছেলেটাকে মানুষ বানিয়ে দিবে। কিন্তু হচ্ছে তো রক্ষা তাদের সে নির্মল বিশ্বাসের? নাকি তা নষ্ট হচ্ছে আমাদের হেঁয়ালিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে? আজ এই লেখায় সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে।
এক. আমার মাদ্রাসায় শিক্ষক সংকট। তাই সরলমনে আশাভরা বুকে মকতবের এক অনাবাসিক উস্তাদকে বললাম, নতুন শিক্ষক রাখা পর্যন্ত আপনি একটু সময় বেশি দিন। অমুক বিভাগের ক্লাসটা নিয়েন। কথা শেষ না হতেই সহকারী শিক্ষক মহোদয় বলে উঠলেন, ‘কমিটিকে বলে আরেকজন উস্তাদ রাখার ব্যবস্থা করেন। আমার পক্ষে দুই বিভাগ সামলানো কষ্টকর’। অথচ দুই বিভাগ মিলিয়ে ছাত্র মাত্র ২৮ জন। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
দুই. আরেক শিক্ষককে অনুরোধ করার আগেই বলে ফেললেন, আমার পক্ষে এসব সম্ভব না। নতুন উস্তাদ দেখেন, নইলে আমাকে বিদায় দেন। আমরা মানুষ, যন্ত্র না যত মন চায় চাপিয়ে দিবেন। বললাম, ধৈর্য্য ধরেন দোয়া করেন। উত্তরঃ শুধু ধৈর্য্য ধরলে হয় না চেষ্টা ও করা লাগে। চুপ হয়ে গেলাম। বাচ্চাদের নিজে কষ্ট করে পড়াই। কারণ কুরআন তো! পড়ালেই লাভ হয়তোবা দুনিয়াতে আর নিশ্চিত আখেরাতে।
এবার আমি একটু অতীতে ফিরে যাচ্ছি। সালটা ২০০২। মালিবাগ মাদ্রাসার অনাবাসিক মক্তবে আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন।বড় ক্বারী সাহেব ও ছোট ক্বারী সাহেবের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মসজিদের বারান্দা প্রায় ভরপুর। ছাত্র ছাত্রী ৭০ জনের কম হবে না। সহাস্য বদনে আদর যত্ন আর পরম মমতায় কুরআন পড়াচ্ছেন মুরব্বি দুই শিক্ষক।ক্বারী ইয়াহইয়া সাহেব ও ক্বারী এমদাদুল হক্ব সাহেব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দুই উস্তায।
আমার শায়খ ও মুর্শিদ শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন (দাঃ বাঃ) তো এখনো বাহায়াত আছেন। তিনিও কোনদিন মাদ্রাসায় পড়িয়ে বেতন নেননি। ছাত্র গড়া, আদর্শ মানুষ তৈরি করাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য।
এবার ফিরে যাই আরেকটু পিছনে আমার আকাবিরদের জীবনীতে। মাওলানা আশেকে ইলাহী সাহেব তাযকিরাতুল খলীল গ্রন্থে শায়খুল হাদীস জাকারিয়া রহঃ এর আব্বাজান মাওলানা ইয়াহইয়া কান্ধলভী রহঃ সম্পর্কে লিখেন, ‘মাওলানা ইয়াহইয়া কান্ধলভী সাহেবের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল, তিনি কখনোই বেতন নেননি। দরসের বিনিময়ে কোনো ধরনের বিনিময় গ্রহণ করা তিনি পছন্দ করতেন না। শিশু তরুণদেরকে বলে কয়ে, বুঝিয়ে শুনিয়ে আরবি শিখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। আমার শায়খ ও মুর্শিদ শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন (দাঃ বাঃ) তো এখনো বাহায়াত আছেন। তিনিও কোনদিন মাদ্রাসায় পড়িয়ে বেতন নেননি। ছাত্র গড়া, আদর্শ মানুষ তৈরি করাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। দেওবন্দে পড়তে গিয়েও এমন ক্ষণজন্মা এক মনীষার দেখা পেয়েছিলাম। ভদ্রলোকের নাম মুফতি সাঈদ আহমাদ পালনপুরী (রহঃ) সোনালী যুগের আকাবিরদের জীবন্ত এক নমুনা হিসেবে পেয়েছিলাম। সারা জীবন ইলমে দ্বীনের খেদমত করে গিয়েছেন বিনামূল্যে। কাছ থেকে এমন মানুষদের দেখে হাল জমানার শিক্ষকদের আচার আচরণ তাই মানতে পারি না।
পাঠক!আপনি মাদ্রাসায় ফ্রী তে পড়ান আমি কিন্তু তা বলছি না। পরিবার পরিজন নিয়ে চলতে গেলে অবশ্যই আপনাকে সম্মানী নিতে হবে তাই বলে সম্মানী টা তো আর মুখ্য বানানো যাবে না। তাহলে এই উম্মতের কি হবে ভেবে দেখেছেন একবারও ?ত্যাগ তিতিক্ষা, কুরবানী সংগ্রাম সাধনা বলতে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান উলামায়ে কেরামের ঝুলিতে কিছুই থাকবে না আজ? ঝুলি এত দ্রুত শূন্য হয়ে যাবে?
আশেপাশে তাকিয়ে দেখি জীবন এখন কর্পোরেট। কেউ আর বোকা নেই সবাই আমরা লাভ লস বুঝে ফেলেছি। তবে কষ্টে লাগে ভীষণ কওমি মাদ্রাসার হুজুরদের দেখে। যারা পার্থিব লাভ লসের দাঁড়িপাল্লা কুরআন হাদিসকে মাপা শুরু করে দিয়েছেন! তাহলে নবীরা যে বলতেন, ‘ইন আজরিয়া ইল্লা আলাল্লাহ’এর কী উত্তর? বেতন নিতে হবে, সংসার চালাতে এটা দরকার মানি তবে মানসিকতা কেন তৈরী হয় না? বয়ানের সময় তো নবী রাসূলরা এই করেছেন সেই করেছেন কিন্তু আমলের বেলায় কেন তাঁদেরকে মানছি না? আমরা কি চাকুরীজীবি হিসেবে নাম লিখিয়েছি আল্লাহর খাতায় না কি দ্বীনের খাদেম? দশ পনেরো হাজার বেতনে দুনিয়া আর পরকাল আমার শূন্যতায় ভরা। একটি গল্প বলে লেখার ইতি টানছি। সেদিন বড্ড আশা নিয়ে গিয়েছিলাম ওয়াজ শুনতে পার্শ্ববর্তী এক ইউনিয়নে। বিখ্যাত ওয়ায়েজ। গতানুগতিক ধারার ওয়াজ ৪৫ মিনিট বয়ান করলেন সুর সার বেঁধে কিছু একটা বলে গেলেন হুবহু চর্বিত চর্বণ টাইপ। গাড়ি থেকে স্টেজ, স্টেজ টু গাড়ি ব্যস। হাদিয়া কত? ৬২ হাজার বাংলাদেশী টাকা। এবারের গন্তব্য খুলনা শহর। জানতে পেরেছি, ঐখানে ২ ঘণ্টা বয়ান করে বাগিয়েছেন ৮০ হাজার টাকা। তাহলে প্রায় ৩ ঘন্টায় কামায় নিয়েছেন একলক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। তাহলে বলুন তো এটা কোন ইসলাম? নিশ্চয়ই মদীনা ওয়ালার নয় কারণ তিনি এসেছিলেন ধরাধামে দিতে, নিতে নয়। লেনদেন হবে তো জান্নাতে।
লেখক: শিক্ষক, অনুবাদক ও মাদরাসা পরিচালক