আমাদের কাশ্মীরে তোমাদের নিমন্ত্রণ
মুহাম্মাদ আইয়ুব ❑ এখনো প্রায় এগারো ঘন্টা বাকি ট্রেন আসতে। শীতকালে ভারতীয় ট্রেনের এই একটা সমস্যা। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে তিন চার ঘন্টা লেটে আসবে। অবশ্য অকারণে যে এমনটা হয় তা-না। ঘন কুয়াশা এর প্রধান কারণ। আমাদের দিল্লিগামী ট্রেনের শিডিউল সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিট হলেও এখন সেটা প্লাটফর্মে আসবে রাত দশটায়। লও ঠেলা। মালদা স্টেশনের এক বেঞ্চি দখল করে শুয়ে বসে আছি।গভীরভাবে ভারতীয়দের হাঁটা-চলা, উঠা-বাসা পর্যবেক্ষণ করছি। মালদা আর কমলাপুর একই কথা। শুধু রাষ্ট্র ভিন্ন। তাতে কিছু যায় আসেনা। গায়ে গতরে ভাষায় সবই এক। ভুল বললাম, ওদের যে গা গতর তাতে আমাদের অবস্থা বেশ ভাল ইদানীং।
আধঘন্টা যাবত খেয়াল করছি যে, কাবলিওয়ালাদের সাতজনের একটা দল (চারজন পুরুষ,একজন তরুণ আর দুইজন বালক)। ভাবেসাবে কাশ্মিরী মনে হচ্ছে;স্টেশনে ঢুকছে আর বাহির হচ্ছে। মিনিমাম চার পাঁচ বার তো হবেই। কৌতূহলী হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি?
বলল, হালাল খাবারের দোকান খুঁজছে। অত্র এলাকায় কোন হালাল খাবারের দোকানই মিলছে না। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দক্ষিণ সাইডের সবচাইতে বড় স্টেশন এই মালদা অথচ হালাল খাবারের দোকানের অভাব ভাবা যায়?!
তাদের কথায় আমি কিছুটা আহত হলাম। আমরা দেশ থেকে তিনদিনের পথের পাথেয় হিসেবে মুরগির মাংস কড়া করে ফ্রাই করে এনেছি সাথে রুটি। মায়ের হাতে বানানো নানা স্বাদের পিঠাও আছে সাথে। আমি তাদেরকে প্রস্তাব করলাম আমাদের আতিথেয়তা গ্রহণের। তারা সানন্দে রাজি হল।স্টেশনে ছোটখাটো একটি ঈদানন্দ শুরু হলো। ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই’অনেক দামী কথা। মালদার সান্ধ্যকালীন সেই বরকতময় বৈঠকে টের পেলাম কিছুটা। আমি আর ইমরান প্রতিবার সফরেই খাবারের জন্য আলাদা ব্যাগ বানাতাম। তাই তাদের সামনে খাবার এগিয়ে দিতে বেগ পেতে হল না। খাবার পেলাম আর গিললাম এটা তো হবেনা, বিশেষকরে কাশ্মীরীরা! আলাপ আলোচনা হবে, একে অপরের ঘনিষ্ঠ হবে। সেই ধারাবাহিকতা এখানেও শুরু হলো।
: তোমরা কোত্থেকে এসেছে?
: বাংলাদেশ থেকে
: কোথায় যাবে?
: দেওবন্দে পড়াশোনা করি
: ও -আচ্ছা!
: তোমরা?
: আমাদের বাড়ি কাশ্মীরে,থাকি বিহারে ঐখানে আমাদের ব্যবসা বানিজ্য।
: আমাদের ঐখানে তো তোমাদের পক্ষে সবাই কথা বলে, তোমাদের উপর যখন ভারত সরকার অত্যাচার করে তখন আমাদের সবচাইতে বড় মসজিদের সামনে তোমাদের পক্ষে আন্দোলন হয়,মিছিল হয়।
: সাচ কাহা?!!! সত্য বলেছ?
: হান্ড্রেড পারসেন্ট!
: মুসলমান মুসলমানের ভাই।
: অবশ্যই অবশ্যই
: তোমাদের কাছে কি কোন রুপি আছে তোমাদের দেশের?
: সব রুপি তো বর্ডারে বদল করে এসেছি।
: (তরুণ ছেলেটা বলল) দেখনা একটু।
আমি আর ইমরান তল্লাশি শুরু করলাম যার যার খাজানায়।
অবশেষে আমি মানিব্যাগের এক কোণে দশটা টাকা পেলাম। দশ টাকা দেখেই কাড়াকাড়ির দশা। বায়তুল মুকাররমের উপর ‘আল্লাহু’ লেখা দেখে পিচ্চি দুটো খুব খুশি। বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে একজন বলল,ইনি কে?
: ইনি হচ্ছেন আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। তিনিই আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছেন। আমাদের দেশে স্বাধীনতার সূর্য উদিত করতে পুরো জীবনকে ব্যায় করেছেন।ইনিই আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
: এখন কারা দেশ চালায়?
: বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পার্টি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ
: ওরা নাকি ইসলামের শত্রু?
(এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভাল যে, কাশ্মীরের প্রায় অধিকাংশ মানুষই মওদূদী চেতনায় বিশ্বাসী। দেওবন্দে আমরা যে মাদ্রাসায় ইফতা পড়েছি সেখানে কাশ্মীরের তিনজন সহপাঠী ছিল তাদের কাছ থেকে আমি এ বিষয়টি সম্পর্কে ভালভাবে নিশ্চিত হয়েছি। ভদ্রলোকের প্রশ্নের কারণ হলো সেসময়ে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের শীর্ষ লিডারদের একের পর এক ফাঁসীতে চড়ানো।)
: তারা ইসলামের শত্রু নয় বরং বন্ধু।
: তাহলে বড় বড় আলেমদের যে ফাঁসীতে ঝুলালো?
: ওরা আলেম না বরং লেবাসধারী। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এরা দেশের সাথে গাদ্দারি করে শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে নিজ দেশের বিরুদ্ধে লড়েছে।
: সর্বনাশ!!!
: হ্যাঁ! ওরা আমাদের সর্বনাশই করেছে। নইলে নয় মাসের যুদ্ধ তিনমাসেই শেষ হয়ে যেত।
: তাহলে তো ফাঁসী-ই ওদের প্রাপ্য!
: তাই বর্তমান সরকার ইনসাফের সাথে তাদেরকে তাদের প্রাপ্যটাই দিয়েছে।
ভীনদেশি মুসলিম ভাইদের খোশগল্পে কখন যে সময় গড়িয়ে ট্রেনের সময় হয়ে এলো টেরই পেলাম না। কথার মাঝখানে খেয়াল করলাম ওরা আমাদের বাঙালি পিঠা খেতে পারছে না। আমাদের প্রিয় পিঠা ওদের কাছে অপ্রিয় ঠেকল।তবে প্রশংসা করতে একদম ভোলেনি। ‘বহুত বড়িয়া! বহুত বড়িয়া চিজ!!’ ফারাক্কা এক্সপ্রেস প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। এখন আমাদের ট্রেনে উঠার পালা। পিচ্চি একটা বলল টাকাটা আমার চাই।হাসিমুখে দিয়ে দিলাম। পুরুষ চারজনের মাথায় টুপি একজনের মাথা খালি আমি চটজলদি ব্যাগ থেকে একটা টুপি বের করে তার হাতে দিয়ে বললাম হাদিয়া।
সে অপ্রস্তুত হয়ে বলল আমার টুপি আমার পকেটে। আমি বললাম, ঠিক আছে আপনার টুপিটাই আমাকে দিন স্মৃতি সরূপ। হাসির রোল পড়ে গেল। উঠার আগেই এক ভাই তার ঠিকানা আমাদের দিলেন মোবাইল নম্বর সহ।
পরিশেষে সবাই আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘আমাদের কাশ্মীরে তোমাদের নিমন্ত্রণ।’
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক