আমাদের মারুফ সাহেব হুযূর

আমাদের মারুফ সাহেব হুযূর

আমাদের মারুফ সাহেব হুযূর

আশরাফ উদ্দীন রায়হান :: এগারো ভাই আর তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। আমাদের গ্রামের মুরুব্বীজনেরা তাঁকে মারুফ নামেই ডাকেন। আমরা ডাকি মারুফ সাব হুযূর। মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের অনুজ হিসেবে সমধিক পরিচিতি থাকলেও তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন আপন মেধা-মনন, প্রতিভা আর কর্মগুণে।

কাকরাইল সার্কিট হাউজ জামে মসজিদের খতীব মাওলানা আরীফ উদ্দীন মারুফ সাহেবের সাথে গ্রামের ছেলে হিসেবে আমার সম্পর্কটা বেশ দারুণ বলা চলে। সেই কৈশোরের ঊষালগ্নে তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ-পরিচয়। তিনি বছরে দু-তিনবার গ্রামের বাড়িতে (অর্থাৎ আমাদের বেলংকায়) আসেন। ২০১৪ সালে পাথেয়তে প্রকাশিত আমার প্রথম লেখা ‘অভীষ্ট প্রাপ্তি’ তাঁকে দেখিয়েছিলাম তখনই। ‘হ্যাঁ, পড়েছি তোমার লেখাটি’ বলে আমাকে তিনি অবাক করে দিয়েছিলেন।কারণ আমি মনে করেছিলাম, চৌদ্দ বছর বয়সী ছোকরার লেখা (?) তাঁর কাছে কী আর মনে হবে!

এরপর থেকে তাঁর সাথে আমার লেখালেখিকেন্দ্রিক কথাবার্তাই বেশি হতো। একদিন জোহরের নামাজান্তে যখন আমাদের মহল্লার মুন্সীবাড়ি মসজিদ থেকে বের হন, তখন জিগ্যেস করেছিলাম : দৃষ্টিপাতের লেখক যাযাবরের (ছদ্মনাম) আসল নাম কী? তিনি সোৎসাহে জবাব দিয়েছিলেন : বিনয় মুখোপাধ্যায়। তাঁর লেখা ‘বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় উলামায়ে দেওবন্দ’ বইটি পড়েছিলাম খুব আগ্রহভরে। বইটিতে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ আর পূর্বোক্ত যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’ নিয়ে খুব মজা করে আলোচনা করেছেন।
মাসিক পাথেয়-এ প্রকাশিত আলোর মিনার সিরিজের এ লেখক আমার প্রতি বরাবরই সস্নেহ নজর রাখেন। গত ফেব্রুয়ারিতে পাথেয় অনলাইন পোর্টালে আমার লেখা ‘জন্মগাঁয়ের ধন্যভূমি’ প্রকাশিত হয়। তখন তিনি ছিলেন মিসরে-বইমেলায়। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি আমাকে ফোন দিয়ে লেখাটির প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা জানান। বাহ্যত রাশভারী মনে হলেও তিনি আপাদমস্তক সজ্জন ও নিপাট একজন মানুষ। সাদা জোব্বা আর সাদা পাগড়ির আটপৌরে লেবাসেই তিনি আমাদের চিরচেনা মারুফ সাব হুযূর হয়ে গেছেন। নান্দনিক ফ্রেমের চশমায় তাঁর গাম্ভীর্য কিছুটা উৎকীর্ণ থাকলেও সেটা কাউকে অস্বস্তিতে ফেলে না বৈকি।

মনে পড়ে, পাঁচ বছর আগে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থেকে মারুফ সাহেব হুযূরের সাথে ঢাকায় এসেছিলাম। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথিতযশা উস্তায মুফতী আবদুল্লাহ মারুফী দা. বা., মারুফ সাহেব হুযূর, ঢাবি অধ্যাপক মাওলানা হুসাইনুল বান্না (মারুফ সাহেব হুযুরের ভাগ্নে), জামিআ ইকরার মুহাদ্দিস, কবি, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান কাসেমী ও মারুফ সাহেব হুযূরের খাদেম মাওলানা ইসহাক শেখ একই গাড়িতে ঢাকায় পৌঁছেছিলাম। এরপর কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয় সবকিছু। উলামা-তলাবার পরিবেশে দীন-আমলের তরক্কি হয়েছিল বেশ।

মাঝেমাঝে মারুফ সাব হুযূর আমাকে তাঁর কামরায় ডেকে পাঠাতেন। উপস্থিত মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান কাসেমী সাহেবকে বলতেন, ‘ফয়জুল্লাহ, তুমি রায়হানের লেখাজোখাগুলো একটু দেখে দিও।’

উল্লেখ্য, ফয়জুল্লাহ আমান সাহেব হুযুরের সাথেও আমার পরিচয়-পর্ব ছিল অনেকটাই নাটকীয়। স্বভাবকবি ফয়জুল্লাহ আমান সাহেবের কাছে পরে যাওয়া-আসায় ছন্দপতন ঘটেছিল আমার উদাসীনতার কারণেই। আর লেখাই বাহুল্য যে, এর পরিণাম আমাকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে এবং আফসোস করা ছাড়া উপায়ান্তর দেখছি না।

ফিরে আসি মূল বিষয়ে, প্রয়োজন হলেই মারুফ সাব হুযূরের সাথে ফোনালাপ করার চেষ্টা করি। আগামী আগস্ট মাসে আমাদের তাড়াইল উপজেলা থেকে প্রকাশিতব্য বার্ষিক সাময়িকী ‘তাড়াইল পরিক্রমা’র জন্যে হুযূরের কাছে একটি লেখা চেয়েছিলাম। (স্মর্তব্য, উক্ত সাময়িকীতে তাড়াইল উপজেলার মানুষদের লেখাকেই নির্বাচনের জন্য প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে) তাই বিষয়টি যে সত্যিই আবেদনময়, তা তিনি এড়িয়ে যাননি। বরং উচ্ছ্বাসমাখা কণ্ঠে আমাদের উদ্যোগটাকে সাধুবাদ জানালেন। সংশাবাক্যে নিজের অনুভূতিটা ব্যক্ত করলেন। তিনি লেখা দেবেন বলে আশ্বস্ত করলেন।

এরপর এলাকার বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন তিনি। আমি বলছিলাম, হুযূর আপনাদের বাড়ির সামনে তো এখন নৌকা চলছে। জুমার নামাজে অনেকই নৌকায় চড়ে মসজিদে এসেছেন। আর মাদরাসার মাঠে যেখানে ইসলাহী ইজতেমা হয়, এখন মাছ ধরছে লোকজন। তিনি আমার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে আরও কিছু বিষয় জেনে নিলেন। তিনি রসিকতা করে বলছিলেন, ‘তাহলে তো খুবই মজার ব্যাপার! আমি চাইছিলাম আরও বাড়িতে আসতে।’ আমি বললাম, ‘হুযূর, এখন বাড়িতে আসাটা হবে চরম দুর্ভোগের। আর আপনি যেখানে ‘মজা’ বলছেন, সেখানে আমাদের দুর্ভোগের শেষ নেই যেন।’ তিনি তড়িদ্বেগে অবস্থান পাল্টে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘না! না! আমি আমার শব্দটিকে উইথড্র করে নিলাম।’

তাঁর সম্পর্কে আরেকটি রসিকতার কথা বলে লেখার ইতি টানবো। তিনি আমাকে হয়তো মজা করেই জিগ্যেস করলেন : ‘রায়হান, তুমি কি জানো আমি কাবা শরীফের ভিতরে ঢুকছিলাম?’ আমি ফোনের ওপ্রান্ত থেকে ‘জী হুযুর’ বললাম। তারপর বললেন, ‘আমার তো মনে হয় না, তাড়াইলের আর কেউ কাবা শরীফে ঢুকতে পেরেছে।’ আমি জী বলে আরেকটু সংযোজন করে বললাম : আপনারা দুই ভাইই তো কাবা শরীফের ভিতরে ঢুকেছেন, এ রকম নজির তাড়াইল কেন, পুরা কিশোরগঞ্জেও তো পাওয়া যাবে না।’

লেখক : সম্পাদক, তাড়াইল পরিক্রমা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী

auraihan3824@gmail.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *