আমার বন্ধু জাকিরের স্বপ্ন নিভিয়ে দিলো ট্রাক

আমার বন্ধু জাকিরের স্বপ্ন নিভিয়ে দিলো ট্রাক

হানজালা ফিদা : জাকির বলেছিল, এর পরেরবার বিল কিন্তু আমিই দিমু। আমি ওর পিঠ চাপড়ে বলেছিলাম ঠিক আছে দিয়ও।

জাকিরের সাথে আমার পরিচয় বছর তিনেক আগে, এক প্রিয়োজনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম পানাম তাজ মহলের পাশে। দেখতে ছোটখাটো হালকা পাতলা কিন্তু ওর বুক ভরা স্বপ্ন-আশা। সহজ সরল তাই অল্পতেই ভালো লেগে ছিলো ওকে। গরীব ঘরের ছেলে ছোটবেলা থেকেই কাজ করতো, হেন তেন কাজ নেই যা ওর সাধ্যে কুলিয়েছে আর ও করেনি। কারেন্টের কাজ, ফ্রিজের কাজ, মেইলেও কাজ করতো। কিন্তু বেশিদিন একটা কাজে মন বসতো না।

শেষবার জাকিরের সাথে দেখা হয়েছিল ‘পেরাব’ এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম তখন গত কুরবানীর ঈদের পর। আমি ডাক্তারের কাছে গেলেই আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চলে আসতো শত কাজ ফেলে। হেঁসে কথা বলতো খুব আপন জনের মতো। আমার সাথে যখন ওর শেষ দেখা তখন ও একটা ফ্রিজের দোকানে নতুন কাজে জয়েন্ট করেছে, তখন ওর বাবা অসুস্থ হসপিটালে ভর্তি। একটা হোটেলে বসে খেতে খেতে জানালো, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে পরিক্ষা দিবে। সেদিন অনেকটা সময় নিয়ে গল্প হলো। আমাকে বললো ওর স্বপ্নগুলোর কথা। মনে হলো একটা বাবুই পাখি খড়কুটো দিয়ে বাসা বানাচ্ছে। ঝড়ের দাপটে বাবুয়ের বাসা টিকলো না।

গতকাল ২৯ মে মঙ্গলবার দুপুর ১.৩০ এ ঘাতক ট্রাক ওর স্বপ্নগুলোকে ‘বরপা’ রাস্তার পিচের সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। সামনে ঈদ জাকির হয়তো কত স্বপ্ন জাল বেধেছিলো ঈদে নতুন জামা জুতো কিনবে, মা-বাবাকে সাথে নিয়ে জমিয়ে আনন্দ করবে, দু’চার দিনের মাঝেই মেইলের বেতন ভাতা দিয়ে দিবে। হয়তো বা ভেবেছিলো এবার ঈদে কোন নতুন জামা, জুতো না কিনে ওর স্কুলের বেতন পরীক্ষার ফি দিবে, এবছরের ক্লাসের বইগুলো এখনো কেনা হয়নি সেগুলো কিনবে, একটা স্কুল ড্রেস না কিনলে হচ্ছে না তাও কেনা যেতে পারে।

দুপুরে সাইকেলে চড়ে মেইলে যাচ্ছিলো ডিউটিতে। সাইকেলের চাকার সাথে স্বপ্নগুলো পাল্লা দিয়ে দৌড়োচ্ছিলো কিন্তু হায়েনা ট্রাক এক থাবায় সব কেঁড়ে নিলো। মূহুর্তেই পিচঢালা পথে একটা ব্যর্থ স্বপ্নের লাল মানচিত্র একে দিলো, ডানাকাটা পায়রার মতো ছটফট করলো সেই রক্তের মানচিত্রে। জাকির এখন ঢাকা হসপিটালের মর্গে শুয়ে আছে সাদা কাফনে মোড়ানো। এতো পাতলা কাপড়ে এমন ঠান্ডা শরীরে শীত লাগছেনারে জাকির..? সার্টিফিকেটের জঞ্জাল আর নেই এখন মর্গের গেটপাস হলেই আপাদত বাঁচা।

মাস শেষ প্রায়, মর্গের গেটপাসের টাকা বাবার কাছে আছে তো.? জাকিরের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসকরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর হলো না। গত ছ’মাস আগে জাকির আমায় ফোন করেছিলো সে তখন বেকার, আমাকে জানালো ওর পরীক্ষার কথা বেতন ফি বাকী পরিবার থেকে কেউ ওর পড়ালেখার খরচা দিতে পারবে না। জাকির তবুও পরীক্ষা দিয়েছিল। শিক্ষার আলোর পিছু ছুটা থেকে কেউ বাধা দিয়ে রাখতে পারিনে। আমাকে বলেছিল, যেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করি। সকল ধরণের পরিশ্রম ও করতে পারবে। আমি ওকে বিশ্বাস করতাম তাই ভেবেছিলাম একটা ফেক্সিলোডের দোকান দিয়ে ওকে রেখে দেব। তা আর হয়ে উঠেনি আমার পরীক্ষার জন্য ঢাকায় চলে আসতে হয়েছিল। তবুও কথা হতো মাঝে মাঝে, মেসেঞ্জারে নক করতো।

এখন আর জাকিরের ফোন আমার মোবাইলে বাজবে না, পানাম যাওয়ার আব্দার করবে না, দৃষ্টি জুড়ানো হাসি হাসবে না। ভাবতেই চোখ ভিজে যাচ্ছে। জাকিরের একটি দূর্ঘটনা ওর পরিবারের ঈদ, আনন্দ, স্বপ্ন সব কিছুই মাটির সাথে মিটিয়ে দিলো। প্রতিদিন এমন কতো জাকির ঘাতক ট্রাকের কাছে শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু জাকির তো এমন কেউ নয় যে ওকে নিয়ে মানববন্ধন হবে রোড অবরোধ হবে তার পরিবারের লোকেরা জরিমানা পাবে। কিন্তু জাকির আমার বন্ধু, আমার লুকনো ব্যথা ও কথার সঙ্গী। আমি ওর মাঝে যেমন শিক্ষার তৃষ্ণা দেখেছি তেমনটা এতো গরীব ও নিম্নবিত্ত পরিবারের আর কাউকে দেখিনি। জাকির তুমি চলে গেছো দুনিয়ার সকল জঞ্জাল ছেড়ে এই রহমত, মাগফেরাত, ও নাজাতের মাসে। আমরা দোয়া করি তোমার ঈদ যেন দয়াময় আল্লার সাথে হয়। এই দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট এবং সীমাবদ্ধতা যেনো ঐ জগতে প্রসস্ততায় পরিনত করে দেন রাব্বুর আলামিন। একটু অপেক্ষা করো বন্ধু আমরাও যোগ হব তোমার কাফেলায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *