আরবের দিনলিপি ।। পর্ব-১২

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব-১২

  • কাউসার মাহমুদ

‘প্রবাসীদের আরবি ভাষা শিক্ষা।’ কয়েকটা দিন অবিশ্রান্ত কাজ করে বইটার একটা বিহিত করলাম। মাস কয়েক আগে যখন নিষ্কর্ম বসেছিলাম, তখন এই কাজে হাত দিই। এরপর ঢিমেতালে যদিও এটির সম্পদনা এগুচ্ছিল, কিন্তু শেষ আর হচ্ছিল না। সম্প্রতি এক প্রিয় বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীর তাড়া খেয়ে এর সমাপ্তি টানলাম।

মূলত মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত প্রবাসী বাঙালিদের প্রবল ভাষাগত জটিলতা নিরসনেই আমার এ প্রয়াস। এ বই লেখার একটি মাত্র কারণ এটিই। যে ব্যথা যে তাড়না নিয়ে এ বইটি লিখেছি, ইতোপূর্বে কোনও গ্রন্থেই তেমনটা অনুভব করেনি। এত আবেগ কোথাও কাজ করেনি। কেননা, যেদিন থেকে সৌদি আরব এসেছি, সেদিন থেকে নিত্যই বাঙালি ভাই-বোনদের কষ্ট দেখছি। সেই কষ্ট কেবল যে কাজের তা নয়। বরং পদে-পদে তাঁরা সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটির সম্মুখীন হন—সেটি এই ভাষার সমস্যাই। ঠিকঠাক দুটি কথা গুছিয়ে বলতে না পারায় কী ভয়াবহ যন্ত্রণার স্বীকার যে হতে হয়, তা বলে বোঝাতে পারব না।

কর্মস্থলসহ সব জায়গায় যে করুণ পরিস্থিতি দেখেছি তাঁদের, তা থেকেই মূলত এ বই লেখার অভিপ্রায় জাগে। ইচ্ছেটি দিনদিন আরও প্রবল হয়, যখন বাঙালি পুরুষদের মত আরবদের বাড়িঘরে বাঙালি নারীদেরও অসহায় অবস্থার কথা জানতে পারি। সামান্য কিছু কথাবার্তার জন্য কী ভয়াবহ পরিস্থিতি যে তৈরি হয়, কী মানষিক যন্ত্রণা, অবসাদ ও ক্লান্তির ভেতর দিয়ে যে যেতে হয়, তা লিখে বোঝাবার শক্তি নেই। নতুন প্রবাসে আসা যে কাউকেই সে কথা জিজ্ঞেস করলে একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।

তদুপরি অনেকে তো কয়েক বছরেও ভাষাটি রপ্ত করতে পারে না। যার ফলে এই সুদীর্ঘ সময় নানারকম পীড়ন, সঙ্কট, ও সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাঁদের। দেখা যায় কাজে তাঁরা দক্ষ ও পরিশ্রমী ঠিক, কিন্তু ভাষাটি না জানার কারণে উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। ফলে তুলনামূলক তাঁদের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করছে ভারতীয়, পাকিস্তানি কিংবা নেপালিরা। এমনকি এ কারণে নিজেদের বিরুদ্ধে হওয়া অন্য দেশীয়দের অবিচার, অন্যায়ের কথাও জানাতে পারে না উচ্চ পর্যায়ের কাউকে।

দিনের পর দিন এসব করুণ চিত্র দেখে বড় বিষন্ন হয়েছি। কী করা যায়, কীভাবে তাঁদের একটু সাহায্য করা যায়—সেই চিন্তাই করেছি বহুদিন। এক জন অসহায় বাঙালিকে দেখলেও তাঁর কাছে দুদণ্ড বসেছি। কাধে হাত রেখে হাল-পুরসি জিজ্ঞেস করেছি। প্রয়োজনীয় দুটি কথা শিখিয়ে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। কীভাবে শুরুর সময়টা উতরে যাওয়া যায়, সে পরামর্শও দিয়েছি। এই ক্ষেত্রে প্রায় সকলরেই প্রধান যে সমস্যাটি লক্ষ করেছি নিশ্চয়ই তা ভাষা। এ কারণেই তাঁরা অসহায়বোধ করে। সঙ্কোচ ও ভীতি তাঁদের গ্রাস করে রাখে। কেননা আরবদের শক্ত মেজাজই এমন, অধীনস্থকে একটি কথা পুনর্বার বলতে হলে বেজায় চটে যায়। এমন বহু ঘটনা তো স্বচক্ষেই দেখেছি৷ কিন্তু স্মৃতিতে যে ঘটনাটি ক্ষতের মত মুদ্রিত হয়ে আছে তা ভীষণ বেদনাপূর্ণ। যেদিন মোবাইলে আমি এক বাঙালি নারীর কাতর কণ্ঠ শুনি। যেদিন তার রোদনের ভারে আমার সমস্ত শরীর অসাড় হয়েছে। তাঁর সেই উচ্চরবে ক্রন্দন কণ্ঠস্বর এখনও আমার স্মৃতিতে দগ্ধের মত পরিস্ফুট। যেন তখন এক চেতনাশূন্য মানবের মত, কোনও এক আরবের ঘরে অসহায় অজ্ঞাত এক বাঙালি নারীর ক্রন্দনের কাছে নিজেকে সমর্পণ ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার।

ঘটনাটি এই—সেদিন দ্বিপ্রহরের সময়। সদাইয়ের খোঁজে আমার আবাসস্থলের সম্মুখে রাস্তার ওপারে মুদিখানায় যাই। কিছুক্ষণ পর সেখানে এক পুলিশকর্তা আসে। পূর্বপরিচিত সে। বিশেষ কিছু কাজের সুবাদে ইতোপূর্বে বেশ ক’বার কথাবার্তা হয়েছে আমার। কিন্তু আজ হঠাৎই আমাকে বাঙালি বাঙালি বলে সম্বোধন করে নিকটে ডেকে নিল। কয়েক মুহূর্ত পর আচমকাই মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলে, কথা বলো। বললাম, হয়েছে কী? বলে, নতুন এক বাঙালি গৃহকর্মী এনেছি। দিনভর কান্নাকাটি করছে। কী বলি বোঝে না, ও কী বলে তাও বুঝি না আমরা। বোঝাও ওকে। বলো দু’বছরের আগে কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। এটুকু বলতেই হুঁশ হয় আমার। বুঝে ফেলি নিশ্চয়ই মেয়েটি সংকটে আছে। বললাম, দিন কথা বলি। আহা! যখনই হ্যালো বলেছি। ওপাশ থেকে অমনি ঝরঝর বিলাপের ধ্বনি ভেসে আসে। বুঝি এতদিন ধরে যে রাশিরাশি কান্না ভেতরে চেপে রেখেছিল, আমার কণ্ঠটি শুনতেই উপকূলে ঝড়ের মত তা আছরে পড়েছে। যেন আপনাকে সামলাবার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়েছে তাঁর। আনজান পথের কোণে হঠাৎই দিশা পেলে স্মৃতিভ্রংশ পথিকের যেই দশা হয়, তাঁরও সেই হাল হল বুঝি। বুঝি বহু দিন পর সে-ও তাঁর আপন ভাষায় একটু বিলাপ করতে পারছে। এতদিন কারও কাছে দুটি কথা বলতে না পেরে যে দুঃখ ক্রমান্বয়ে ঢেউয়ের মত ফেঁপে উঠছিল, আমার পরিচয়, বাঙলায় দুটি শব্দ—বুঝি তাঁর সেই অব্যক্ত রোদনকে কিছুটা প্রশমিত করতে পেরেছে।

ফলে কিছুটা শান্ত হলে সংক্ষেপে জানতে পারি— তাঁর বয়স উনিশ বছর। অল্প ক’দিন হল এই অচীন ভূখণ্ডে এসেছে। কিন্তু এসে যেন অকূলপাথারে পড়েছে। কথা ছিল ঘরদোর গোছগাছ আর দুটো শিশুর দেখভাল করবে। কিন্তু হায়! কোথায় সে ঘরদোর, কোথায় সে শিশু? এখানে তো প্রত্যহ রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। সেই যে প্রত্যুষে উঠে কাজে লাগতে হয়, রাত্তিরেও তার অন্ত নেই। তার উপর মালকিনের উপর্যুপুরি ফরমায়েশ তো আছেই। আছে পাঁচ-ছ’টি শিশুর অন্তহীন উৎপাত আর বয়স্কদের নানান আবদার। অথচ এসব সামলাতে কেবল ইশারা ছাড়া আর কোনও ভাষাই জানে না সে। তাছাড়া এই নতুন মানুষের উৎসুক ও তামাশাপূর্ণ দৃষ্টির মাঝে—নিজেকে এক অদ্ভুত জন্তুও মনে হয় তাঁর। উৎকণ্ঠায় পাজর দুটো ভেঙে আসে। কখনও আশঙ্কা কণ্ঠার কাছে এসে আটকে যায়। চোখদুটি শিকারী হরিণীর মত সন্ত্রস্ত হয়ে টলমল করে। এমতাবস্থায় সারাটা সময় দিকশুন্য পান্থের মত নিজের স্মৃতির ভেতরই ঘুরপাক খেতে থাকে সে। তাই এ অপরিমেয় ক্লান্তি ও অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে দেশে ফেরার মনস্থ করে। কিন্তু কথাটি যে বোঝাবে সে শক্তিও নেই। ফলে দিনমান বিলাপই করে যাচ্ছে। কিন্ত যখনই প্রতিবেশী বাঙালি ড্রাইভারের কল্যাণে বাড়ির কর্ত্রী তাঁর এই ফেরার ইচ্ছের কথা জানতে পারে, তখন বড় অশ্লীল, নীচ এক নাটিকা মঞ্চস্থ হয়। তারই বর্ণনা দেয়ার প্রাক্কালে মেয়েটি কেঁদেকেটে বেহুঁশ হওয়ার পর্যায়ে গিয়ে বলে, ওরা তাঁর নামে বদনাম রটিয়েছে। কীভাবে যে এটি রটল—এর আদ্যোপান্ত কিছুই জানে না সে। বরং গতকাল আচমকাই গৃহকর্ত্রী তাঁকে প্রহার শুরু করে আর বলে, সে নাকি পাশের বাড়ির ভারতীয় ড্রাইভারের সঙ্গে মেলামেশা করেছে। এ কী আশ্চর্য কথা? ভাবা যায়? যে মেয়েটি কথা বলতে না পারার ভয়ে কদমটি ফেলে না, সে কি না বাড়ির বাইরে গেছে! কোনও এক অজ্ঞাত পুরুষের সঙ্গে একান্তে নিবিড় সময় কাটিয়েছে! কথাগুলো বলার সময় মেয়েটির গলায় যে অসহায়তা, যে নির্মম লজ্জা ফুটেছিল—বহুদূর থেকে আমি তা সম্পূর্ণই উপলব্ধি করছিলাম। আর আমার হৃদয়ের ওপর বজ্রের মত আঘাত করছিল নিরঙ্কুশ ক্রোধ। তাই কি-না পুলিশটিকে মুখ অন্ধকার করে জিজ্ঞেস করলাম ‘এ কথা কোথায় পেলে? বলো তো শুনি? সত্যিই কি মেয়েটি এমন করেছে? তুমি দেখেছ? তোমার বউ দেখেছে? শপথ করে বলো।’ যত মন্দই করুক, শপথের কথা বললে যেহেতু ওরা ভয় পায়—তাই কি-না ব্যাটা ইতস্তত কণ্ঠে বলে, ‘আমরা দেখিনি ঠিক। কিন্তু এক বৃদ্ধ দেখেছে!’ বললাম,’ বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করেছ?’ বলে, ‘না, তা করেনি। তবে আমার বউ বলেছে।’ তখন দুটি হাত ধরে অনুনয় করে তাকে বোঝালাম। ‘দ্যাখো! বড় অসহায়ভাবে কাঁদছে তোমার সেবিকাটি। অমন কিছুই ঘটেনি আসলে। মেয়েটি যেন দেশে ফেরারর কথা না বলে, কাঁদাকাটি না করে, তোমার স্ত্রী তাই চাচ্ছে। অমন বিচ্ছিরি অপবাদ দিয়ে সে ফন্দিই এঁটেছে। যেন ভয় পায়। যেন আর সন্ত্রস্ত থাকে।’

এরপর মেয়েটিকেও যথাসাধ্য বোঝালাম। কীভাবে প্রাথমিক ধকলগুলো এড়িয়ে মানসিকভাবে যথাসম্ভব দৃঢ় থাকা যায়—সে কথাই বললাম। কিন্তু হায়! ভরসাহীন প্রাণে কি আর সেসব সান্ত্বনার বাণী কাজে লাগে? একবার যে জীবনের আশা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাকে ভবিষ্যৎ বিশ্বাসের পথে ফেরানো যে বড় মুশকিল। তাই যদিও দ্বিধামিশ্রিত সাময়িক প্রশান্তির একটি দীর্ঘশ্বাস তাঁর গলা থেকে বেরিয়েছে তখন। কিন্তু এর পরে তাঁর কী হয়েছিল সে কথা জানতে পারিনি আর। যেমন জানতে পারিনি ইতিহাসের নির্মম পরিখায় বিস্মৃত হয়ে যাওয়া অসংখ্য ক্রীতদাসির কথা। যেমন বহুকাল ধরে পৃথিবী জানেনি জুফ্রে গ্রামের মানডিনকা গোত্রের কিশোর কুন্টার কথা। যদ্দিন না অ্যালেক্স হেলি ‘রুটস : দ্য সাগা অফ অ্যান অ্যামেরিকান ফ্যামিলি’ লিখলেন। যদ্দিন না আমরা তা পড়ে নিপীড়িতের তরে বেদনায় সর্বশান্ত হলাম।

১২ নভেম্বর রোববার, ২০২৩

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *