আরবের দিনলিপি ।। পর্ব-১৩

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব-১৩

  • কাউসার মাহমুদ

একটি দৈনিকের সাহিত্য পাতার জন্য ফিলিস্তিনি কবির সাক্ষাৎকার অনুবাদ করলাম। কবিটি সবে ত্রিশোর্ধ। নাম তাঁর মুসআব আবু তোহা। অত বিখ্যাত নয়। ক’দিন আগ পর্যন্তও তাঁর লেখাপত্রের খোঁজ জানতাম না। তাঁর নামও শুনিনি। কিন্তু ছোট্ট এই কথোপকথনখানা পড়ে মনে হল, সময়ই তাকে বয়স্ক করে তুলেছে। গাজায় তাঁর বেঁচে থাকা ভাবনায় তাকে পৃথিবীর বহু প্রবীণ কবিদের কাতারেই এনে দাঁড় করিয়েছে। তাঁর চিন্তা কথায় স্পষ্ট। তাঁর বিশ্বাস কবিতায় সুব্যক্ত। তাতে কোথাও খাঁদ নেই। এটুকু আবেগের সংশ্লেষ নেই। এমন বিশদ দৃঢ়তর উচ্চারণ—যেন ইতিহাসের আকরে নির্যাতিত জীবনের নথি রাখছেন। ভবিষ্যত তাকে কীভাবে স্মরণ রাখবে জানি না। প্রবীণত্ব তাঁর কবিতাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে সে সম্বন্ধেও অবগত নই। তবে তাঁর লেখা নিয়ে এতটুকু সংশয় জাগে না। যখন দেখি বহুকাল ধরে অবরুদ্ধ গাজার এমন নির্মম চিত্র কাগজে ফোটাতে পারেন। একটি রক্তাক্ত ভূখণ্ডের ছবি এত করুণভাবে পঙক্তি পঙক্তিতে লিখে ফেলতে পারেন। এমনকি এ-ও বলেন, কবিতায় আমি সেই কথা বলি বিস্তারিতের আড়ালে যা লুকিয়ে থাকে। ক্যামেরা যেসব দৃশ্য অধিকৃত করতে পারে না, তাই উন্মোচন করি আমি। ফলে সেই শহরের একটি বিধুর প্রতিচ্ছবি কল্পনা করি, যখন তিনি বলেন, “In Gaza, breathing is a task, smiling is performing plastic surgery on one’s own face, and rising in the morning, trying to survive another day, is coming back from the dead.”

প্রায়শই এই জনপদটির কথা ভাবি। তখন হৃদয়ে অব্যক্ত বিষন্নতার অনুরণন টের পাই। কোনোদিন এই দেশে যাইনি। এর ভূ-প্রকৃতির ব্যাপারেও জানি না। তবু যেন চোখের পাতায় দুপুরের ছায়ার মত ভাসে তা। আল-কুদসের কথা ভাবি। জলপাই বন আর কমলা গাছের সারি সারি দৃশ্যের কল্পনা করি। তাতে প্রেমিকের মত বুকের ভেতর হাহাকার জাগে। أرض البرتقال الحزين (The land of sad orange) শিরোনামে কানাফানির বিখ্যাত সেই গল্পের কথা মনে পড়ে নিঃসীম এক যন্ত্রণা উজিয়ে ওঠে শরীরে। মনে মনে বলি, প্রভু শক্তি দাও। এমন ক্ষমতা দাও, যেন নিষ্ঠুর শত্রুকে পরাভূত করে তোমার পবিত্র ভূমিটি আযাদ করতে পারি। কিন্তু এ তো এক অলীক কল্পনা শুধু। যেসব ভেবে মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশান্ত করি। যদিও তা ক্ষণিকের। কয়েকটি মুহুর্তের।

কারণ কখনও কল্পনারাও সন্ধ্যার সূর্যের মত স্তিমিত হয়। এর গতিরা থেমে যায়। সমস্ত বিচ্ছুরণ ক্রমশ আঁধারে পরিণত হয়। এই স্তরে নিজের অক্ষমতারা প্রবল হয়। চেতনায়, বিশ্বাসে প্রজন্মের নির্লিপ্ততার কথা মগজ ও হৃদয়ে একসাথে ঝর তোলে। অন্যায়, অন্যায্য, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে যদি দুটি কথা বলার সাহস না থাকে মনে, সে প্রাণ নির্জীব। বলশালী কেবল শরীরে নয়, বিবেকেও হতে হয়। একটি বিপ্লবী আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। এই চিন্তা যখন করি, তখন বাঙলাদেশের মত আরবীয়দের কথাও ভাবি। এ বিষয়ে একটি ভাবনা সর্বদাই আমাকে দ্বন্দ্বে রেখেছে। সেটি এ দেশের রাজনীতি। জনগণের আসক্তিহীন মনোভাব। কেননা এই ক’টি বছরে কোনোদিন এখানের কারও মুখে রাজনীতি নিয়ে একটি শব্দ শুনিনি। এ আমার দুর্ভাগ্য নাকি আধুনিক আরব রাজতন্ত্রের বিশিষ্ট রূপ—তা জানি না। তবে একটি জাতি যখন কোনোভাবে কোনও কিছুতেই আপন রাষ্ট্রকে প্রশ্নের সাহস না রাখে, তা গণতন্ত্র হোক আর রাজতন্ত্র—সময়ে ক্রমে যে তা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে না, তা বলতে পারি না।

তাই ফিলিস্তিনের জন্যও বিগত কয়েক জুমায় খতিব দোয়া করছে। তখন লোকেরাও আমীন আমীন বলছে। কিন্তু এর বাইরে তেমন উচ্চবাচ্য দেখিনি।

বিষয়টি একটু পরিস্কার করি। যেহেতু এখানে এ নিয়ে কথাবার্তা শুনি না, তাই একদিন পরিচিত এক আরবীকে ইঙ্গিতে কিছু বলেছিলাম। সেদিন শীতল কণ্ঠে সে একটি কথাই বলেছিল, ‘যদ্দিন এখানে আছ ভালোমন্দ যাইহোক, রাষ্ট্র ও রাজার বিষয়ে কোনও কথা মুখে এনো না। অতল গহ্বরে লুকালেও খুঁজে বের করে আনা হবে তোমায়’। মিথ্যা বলব না। সেই থেকে প্রাণের ভয়েই আর কোনোদিন এ নিয়ে কোথাও কারও সঙ্গে আলাপে রত হইনি৷ তবে দ্বন্দ্বটি সবসময়ই ছিল যে, কেন কোনও একজনও একটি কথাও বলে না। এ নিয়ে দুটি ভাবনা মনে এসেছে। এক, হয় তাঁরা সুখী জনগণ। আর তা সত্যিই। একটি ধনী রাষ্ট্র তার নাগরিকদের যেসব সুবিধা দিতে পারে, তার সবই সৌদি আরব দিয়েছে। তেমনি শাসন ও আইনের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে প্রথমদিকে আশ্চর্যই হতাম কিছু কাণ্ডে। বিশেষত যখন নির্দিষ্ট একটা নাম্বারে ফোন করতেই দৈত্যের মত পুলিশের উপস্থিতি দেখতাম। ঝড়বৃষ্টি, রাতদুপুর নেই। যখনই কোনও আরবি ফোন করে চোখের পলকে পুলিশের গাড়িটি এসে হাজির হয়। আরবে বসবাসরত যেকোনো প্রবাসীও এই সুখ ভোগ করতে পারে। তবে আজকাল অনারবদের জন্য যে এ ন্যায্যতা কিছু শিথিল হচ্ছে, সে সত্য বলতেও দ্বিধা করব না। যাহোক তা আইনের প্রয়োগ এদেশে পরিপূর্ণই। ফলে যেকোনো আরব নাগরিকই সম্পূর্ণ নিরাপদ। সে যেমনই হোক। ধ্বনি বা গরীব। রাষ্ট্র তাঁর অধিকারটুকু সম্পূর্ণই দিচ্ছে। কোনোকিছু থেকেই বঞ্চিত সে নয়। সুতরাং এসব বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়াতেই বোধহয় রাজনীতি নিয়ে তাঁদের অত মাথাব্যথা নেই। দ্বিতীয়ত, অনারব কারও সঙ্গে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নীরবতা। মানে আড্ডা, আহার কিংবা বিশেষ উপলক্ষে যদিও তাঁরা এ নিয়ে গোপন আলোচনা করে, কিন্তু অনারবী কারও সম্মুখে ভ্রমেও সে সম্বন্ধে কিছু বলবে না। বিষয়টিকে ভয় কিংবা গৌরব দুভাবেই ব্যখ্যা করতে পারি। কেননা, এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। যখন কোনও উন্মাদও যদি এই রাষ্ট্র ও শাসক সম্বন্ধে কোনোরূপ উষ্মাও প্রকাশ করেছে, বহুকাল তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ সেই খোঁজ কারও কারও ক্ষেত্রে চিরকাল নিখোঁজে রূপান্তরিত হয়েছে।

মূলত এসব কারণেই বোধকরি এই দেশে সচরাচর কোনও গণমিছিল নেই। দুনিয়াভর যা-কিছুই হোক, এখানে কোথাও একত্রে দাঁড়ানো যাবে না। প্রতিবাদ আপনার পক্ষ থেকে প্রয়োজনে রাষ্ট্র করবে—কিন্ত কোনও সংঘ নয়। তাই ফিলিস্তিনের জন্যও বিগত কয়েক জুমায় খতিব দোয়া করছে। তখন লোকেরাও আমীন আমীন বলছে। কিন্তু এর বাইরে তেমন উচ্চবাচ্য দেখিনি। হয়তো হৃদয়ে অনল সকলেরই জ্বলে, কিন্তু প্রকাশের শক্তি নেই।

যে অপ্রকাশ্যতা ধূসর বিকেলের মত আমার স্মৃতিতে আছরে পড়ে। তাতে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সমস্ত সন্ধ্যাটি আঁকড়ে ধরে বসে থাকি। কোথাও একটি টিমটিমে প্রদীপের শিখা জ্বলে উঠে। তার দোদুল্যমান রশ্মি থেকে একটি ছায়া নির্গত হয়। সে ছায়ায় হেঁটে হেঁটে, মনে মনে ফিলিস্তিন সীমান্তে এসে দাঁড়াই। দেখি অগুনতি পুরুষের লাশ। ভূপাতিত ভবন। মায়ের মৃত হাত ধরে বসে থাকা নির্বাক শিশুদের দল। তাদের অগ্নিদগ্ধ দেহ। খাঁখাঁ করে জ্বলতে থাকা ফসলের মাঠ। একটি জলপাই গাছ জড়িয়ে ধরে কোনও বৃদ্ধ মায়ের রোদন। যেন তাঁর গর্ভজাত সন্তান সে। অথবা বেঁচে থাকার সর্বশেষ সম্বল। এভাবে যেদিকেই হাঁটি, যে দৃশ্যেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তা থেকেই মৃত্যুর গন্ধ ভেসে আসে। নতুবা এমন কিছু দীর্ঘশ্বাস—উপলব্ধির যাবতীয় শক্তি হারিয়েছে যা। যা খুইয়েছ বেঁচে থাকার সবটুকু ক্ষমত। যা থেকে—যে সব করুণ দৃশ্য থেকে কেবলই ঝরে পড়ে একেকটি সজল ভোর।

১৯ নভেম্বর শনিবার, ২০২৪

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *