আরবের দিনলিপি ।। পর্ব-১৪  

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব-১৪  

  • কাউসার মাহমুদ

দারে খানকে মনে পড়ে। অমন আলসে লোক দ্বিতীয়টি দেখিনি। কোথাও পা দুটি ছড়ালে, গা‘টা এলিয়ে দিতে পারলেই হল, আপসেই চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে তাঁর। নাসারন্ধ্রে বিচিত্র গর্জন আরম্ভ হয়। মাত্রই কথা বলছিল দেখছি। কিন্তু চোখের পলকে কখন যে নিদ্রা তাকে যেখানে-সেখানে আক্রান্ত করে ফেলত, তার কোনও হদিস পেতাম না। ধূমপায়ী ছিল। তবে তাতে কোনও আনন্দ দেখিনি। তরিকাটি এমন যে, দু ঠোঁটের ফাঁকে কেবল চুরুটটিই থাকে। মাংসের ভারে ঝুলে পড়া প্রকাণ্ড গালের কারণে ঠোঁটে গুঁজা সেই চুরুটের অস্তিত্ব খুব অল্পই চোখে পড়ে। তাতে ফুঁকার জন্য যখন দীর্ঘশ্বাস নেয়, তখন প্রবল ফোঁসফোঁস শব্দ শ্রবণগোচর হয়। তারপর কোনোরূপ গলাধঃকরণ কিংবা ভেতরে টানার পরিবর্তে সেই ধূম্রকুণ্ডলী মুখগহ্বর থেকে সবেগে নির্গত করে। যেন এর প্রতি কোনও আকর্ষণই তাঁর নেই। কোনোরূপ আনন্দের উৎকর্ষও নেই। বরং বহুকাল ধরে অভ্যেসই তাকে এই পথে পরিচালিত করছে। আর সে-ও তাঁর অতিকায় যানটির মত এর সাথে একই আবর্তে ঘুরছে।

এশীয়,আফ্রিকানদের মাঝে এরাই একটিমাত্র জাত—আরবরা যাদের পারতপক্ষে কিছু বলে না। তাঁদের সঙ্গে অযথা লড়ে না। আমাদের মত খর্বকায় শরীরের অনারবদের সঙ্গে ওদের যে ‘আমিত্ব’ মনোভাব—আফগানদের বিপক্ষে তা বড় বিরল।

দারে খান আফগানিস্তানের মানুষ। সাচ্চা পাঠান। কালেভদ্রে আমার কর্মক্ষেত্রের এখানে আসত। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকত। সিগার ফুঁকত। নচেৎ ঘুমোত। তাঁর সঙ্গে বিশেষ কোনও আলাপ কোনোদিনই হয়নি আমার। কারণ লোকটার মুখশ্রীই এমন যে, মনে হয় সর্বদা তাতে বিরক্তিভাব সেঁটে রেখেছে। এই হেতু আমি তাঁর বিচিত্র যাপনের ভঙ্গিটীই আত্মস্থ করেছি কেবল। সখ্যতা করিনি। কিংবা ওটুকুর সাহসই হয়নি। কেবল দারে খান কেন? প্রতিটি আফগানকেই বেশ মনোযোগে লক্ষ করেছি। তাঁদের চালচলন, জীবনপদ্ধতি, ভোজনপ্রণালী এবং বেশভূষাসহ প্রতিটি জিনিসই আগ্রহোদ্দীপক। এশীয়,আফ্রিকানদের মাঝে এরাই একটিমাত্র জাত—আরবরা যাদের পারতপক্ষে কিছু বলে না। তাঁদের সঙ্গে অযথা লড়ে না। আমাদের মত খর্বকায় শরীরের অনারবদের সঙ্গে ওদের যে ‘আমিত্ব’ মনোভাব—আফগানদের বিপক্ষে তা বড় বিরল। এর কারণ কী? কেন ওদের সমীহ করে চলে? কেন সচারাচর ওদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় না। এসবে খুব মন দিয়ে যে ক’টি বিষয় লক্ষ্য করেছি তা বেশ চমৎকার। প্রথমত পাঠানদের শারীরিক গঠন। তা এমনই মজবুত আর দীর্ঘকায় যে, কারও সঙ্গে দুটি কথা বললেও গলাটা উঁচিয়ে বলতে হয়। লম্বায় যাদের প্রায় অধিকাংশই সৌদিদের ছাড়িয়ে যেতে চায় কিংবা তাদের সমকক্ষ। ফলে অবচেতনেই  ভেতর থেকে শারীরিক দম্ভের বিষয়টি নিবৃত্ত হয়। কেননা, আমি মনে করি, যারা যুদ্ধাংদেহী মনোভাব ধারণ করে বা অন্যকে পরাস্ত করতে চায়—শরীর ও হিংসাশ্রয়ী দুষ্ট হৃদয়ই এক্ষেত্রে তাঁদের সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত করে। ফলে শারীরিকভাবে আফগান পাঠান-আরবদের চেয়ে বলবান হওয়ায় সজ্ঞানেই দ্বন্দ্বটি এড়িয়ে চলে সৌদিরা। দ্বিতীয়ত তাঁদের গোয়ার্তুমি মনোভাব। এই একটি বিষয়ে সবকটি পাঠানের খুব মিল। একবার যদি বিগড়ে গেল, তাকে মানানোর শক্তি ধরিত্রীতে বোধকরি কারওই নেই। এমনিতে সহাস্যবদনে কথা বলবে। তামাশা করে ঠাঠা করে হাসবে। খেতে বসালে নিজের হৃদপিণ্ডটা খুলে দেবে পারলে। কিন্ত যেই না একবার চটবে, বিপরীত পক্ষকে একদম যা-তা করে ছাড়বে। তৃতীয়ত তাঁদের বোধবুদ্ধি। অর্থাৎ, যদি সে কোনোকিছুতে একবার মনস্থ করে ফেলে, তা ভাঙাবার জো নেই কারও। কোনও বিষয়ে বিশ্বাস করে বসলে, কারও সাধ্য নেই তা থেকে এতটুকু টলাবার। বিচ্যুতি করবার।

এমন অদ্ভুৎ স্বভাবের, রুদ্রমূর্তির এক আফগান চরিত্রের দেখা মিলেছিল বছর চার আগে। কোনও এক উমরার সফরে। সে এক আশ্চর্য কাণ্ড বটে। এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। যেকোনো পাঠান দেখলেই ওই কথা মনে পড়ে। হলো কী যে, আমরা সকলেই বড় খোশগল্পের মেজাজে চলছি। সকলেই দু’চারটি কৌতুক বলে দীর্ঘ যাত্রাটিকে সহনীয় করে তুলছে। বাসে একভাবে বসে বসে পা দু’টি যখন খিল ধরে গেছে, তখন কেউ কেউ দাঁড়িয়ে দু’সারির মধ্যিখানে কিঞ্চিৎ হাঁটাহাঁটি করছে। পাঠান কামাল খানও খোশমেজাজেই ছিল। স্বজাতীয় অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বহু কথাই বলছিল। বাসের ভেতর তাঁর কণ্ঠটিই ছিল সবচেয়ে স্পষ্ট। তাঁর হাসির গমকও ছিল বেশি। কখনও এর কাছে যাচ্ছিল। কখনও ওর কাছে। মোটকথা বড় প্রফুল্লচিত্তে সবাইকেই আমোদিত করে রাখছিল। কিন্তু হঠাৎ কী হলো কে জানে? ওরই এক পাঞ্জাবি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে কী নিয়ে যেন বাঁধলো? আহা! তারপর সেই কথা ধরে পাঠানটি লাগাতার চার ঘণ্টা ধরে যা করলো, তাতে সকলের আনন্দই মাটি হল। অতিষ্ঠই হয়ে উঠলাম একপ্রকার। পাঞ্জাবিকে খুন করে সে জেলে যাবে। এই দেশে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হবে জানে, তবু ওকে ছাড়বে না। কী করে ও তাঁর হাতে থেকে বাঁচে—তাই দেখবে? এমন বহু নচ্ছারকে পিটিয়ে নিতম্ব লাল করে দিয়েছে—এ জাতীয় কথাবার্তাই বলছিল পাঠান কামাল। পাঠকের বিশ্বাস হবে কি-না জানি না! কিন্তু আমার চর্মচক্ষে দেখা, এই ধারা প্রাণনাশের হুমকি-ধমকি ও শোরগোল টানা চারটি ঘন্টা ধরে চালিয়েছিল সে। তখন পাশে বসা এক পাকিস্তানি আমায় বলেছিল, এঁকে ঠাণ্ডা করার একমাত্র উপায় বৃষ্টি। হতভম্ব হয়ে বলি, সে কী? বলে  ‘হ্যাঁ! পাঠান কি ইয়ে আদত বহুত হি বদতর হে। একবার আগার ও কিছি চিঁয পর বিগার যায়ে, উস কো স্রেফ বারিশ হি রোক সাকতা হে।’ এই শুনে বাইরে তাকাই। দেখি সূর্যের গনগনে আলোয় মরুভূমি চিকচিক করছে। অগত্যা হৃদয়ে পাথর চেপে চোখ বুজি। বৃষ্টির বদলে কামালের সুমতির প্রার্থনা করি। কিন্তু সেই সুমতি তাঁর হয়েছিল কি-না কে জান? মাস কয়েক পর একদিন দেখি জোব্বা পাগড়ি পড়ে মসজিদে সুললিত কণ্ঠে আযান দিচ্ছে। তারপর এক রাতে অন্ধকারে কুঁজো হয়ে বিঁড়ি ফুঁকছে। আরেকদিন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করছে।

পাঠান কি ইয়ে আদত বহুত হি বদতর হে। একবার আগার ও কিছি চিঁয পর বিগার যায়ে, উস কো স্রেফ বারিশ হি রোক সাকতা হে।’

আসলে আফগানরাই এই দেশে কঠোর কাজগুলো করে। মনে হয় সবচেয়ে শক্তিমান ওরাই। ওরা পাথর ভাঙে। বড় বড় মেশিন দিয়ে রাস্তা কাটে। অতিকায় ট্রাক চালায়। শুকনো ঘাসভর্তি বৃহদাকারের লরি নিয়ে শহর থেকে শহরে যায়। পাথরের প্রাচীর নির্মাণ করে। ভবন ও দেয়ালের পাথরে সুদৃশ্য কারুকাজ করে মোটকথা আমাদের অসাধ্য যা, কর্মে ওরা তাই সাধন করে। বড় আড্ডাবাজ । স্বভাবে স্বাধীন। প্রয়োজনে সৌদি মনিবকে হাজার হাজার রিয়াল দেবে। কিন্তু কোনও কর্তৃত্ব মানবে না। অধিকাংশই ‘নিসওয়ার’ খায়৷ সবুজ এই বস্তুটি ভারতীয় তামাকের মতই নেশাদ্রব্য জাতীয়। তবে তুলনায় অধিকতর নরম। ঠোঁটের নীচে রাখলে মাথা স্বল্প ঝিমঝিম করে। পকেটভর্তি টাকা থাকে। যাপনের আয়েশি ভঙ্গিতে অভ্যস্থ। সর্বদাই ভালোমন্দ আহার করে। কিন্তু তবু সকাল সন্ধ্যা রুটি লাগবেই। যে রুটি সাধারণ রুটি নয়। আরবিতে যেটিকে ‘খুবয’ না বরং  ‘তমীয’ বলে।  নাস্তায় এর একটিই যা দুজন বাঙালির পেটপুর্তির জন্য যথেষ্ট। অধিকন্তু প্রায়শই উদ্বৃত্ত থাকে। আফগানরা সেই রুটি দুটি খায় এক জনে। আকার ও ওজনে যেগুলো স্বাভাবিক রুটির চারটির সমান। এ নিয়ে কথা উঠলে রস করে একদিন প্রবীণ মান্নান ভাই বলেছিলেন, বালিশের তলেও তমীয নিয়ে ঘুমায় এরা। মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙে গেলে ও-ই খায় বসে বসে।

মূলত বিচিত্র সুন্দর স্বভাব আর আচমকা গোস্বা হয়ে যাওয়া এই লোকদের প্রতি সকলেরই বিশেষ আকর্ষণ হতে পারে। যদি কেউ আনন্দ নিয়ে ওদের সঙ্গে মেশে, তাহলে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। আমারও হয়েছে তাই। এর কারণ অবশ্য শ্রীযুক্ত মুজতবা আলি। কৈশোরে যখন তাঁর শবনম পড়ি, তবে থেকেই তাঁর ভৃত্য আব্দুর রহমানের একটা চিত্র মনে আঁকি। এরপর এঁদের সম্বন্ধে কত গল্পই না পড়লাম। কাবুলের সেই বরফাবৃত অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা জানলাম। তালেবান শাসন সম্পর্কে ডোবারাহ এলিসের কিশোর ট্রিলজি পড়লাম। ইংরেজি চর্চার প্রাক্কালে যেটির প্রথম খণ্ড  (The bread winner) অনুবাদও করলাম। খালেদ হুসেইনির A thousands splendid suns দাগিয়ে দাগিয়ে পাঠ করলাম। এসব পুস্তকগুলো গল্পের ভাষায় মোহনীয়। হয়ত তাঁদের শাসন সম্বন্ধে কঠোর, কাল্পনিক কিংবা সত্যাসত্য একটা ধারণাও দিতে পেরেছে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এ জাতী শৌর্যশালী। বিশ্বাসে অটুট। ওসব পড়ে কোথাও বিরূপ ধারণা হলেও সবচেয়ে আনন্দ দিয়েছে শ্রীমান আলি-ই। এতকাল যা যা পড়েছি, সুবচেয়ে সুখদ ও হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা তাঁরই। তাতে কৈশোরে যে আনন্দ লাভ করেছি, হৃদয়ের সে চোখেই এ দেশে পরিচিত আফগানদের দেখি আমি।

 

২২ নভেম্বর বুধবার, ২০২৩

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *