- কাউসার মাহমুদ
উঞ্চ রোদ জড়িয়ে বসে আছি। কাজকর্ম নেই হেতু সমস্ত সকালটি উপার্জনহীন গেল। এখন দুপুর। গতকালের মত আজও অপূর্ব ঝলমলে রোদ উঠেছে। এত মোলায়েম তার তাপ, এত কোমল তার আলিঙ্গন—তাতে বসলেই হাত-পা গুটিয়ে আসে। চোখ দুটি আপনিই মুদে যেতে চায়। তখন ভাসা-ভাসা দৃষ্টির মাঝে কত কী যে ভাসে। দৃষ্টিভ্রম হয়। নেত্রলোম কাঁপে। তার ভেতর একেকটা দৃশ্য দ্বিগুণ ও বর্ণিল হয়ে ঝর-পূর্ব কম্পিত বৃক্ষপত্রের মত দোলে। জাগরণের এই ক্ষণটিকেই বোধকরি বলে নিদ্রালুভাব। সে মুহুর্তে সম্মুখে আপনি কিছু দেখছেন ঠিক—কিন্ত জুত করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাইছেন না। কিছু শুনছেন ঠিক—তথাপি শ্রুত কণ্ঠের ধ্বনিটুকু রেখে মর্মটা ছেড়ে দিচ্ছেন। অথবা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
এ মুহুর্তে আমার অবস্থাটিও তা-ই। অর্থাৎ ঈষদুষ্ণ কোমল রোদের আলিঙ্গনে আমার সমস্ত দেহে যখন অলস বিবশতা ছড়িয়ে পড়েছে, ইন্দ্রিয়রা স্বেচ্ছায় যাবতীয় বিষয়কে অগ্রাহ্য করছে—ঠিক তখনই সম্মুখে এসে দাঁড়ালো সে। সে কে? নিশ্চয়ই তাঁর সম্বন্ধে জানতে উৎসুক হয়েছেন আপনি! তাঁর একটা পরিচয় পেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। কিন্তু হায়! বর্তমান রচনাটি লেখা পর্যন্ত তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানতাম না আমি। যদিও আমার আরব-বাসের বয়স যত, তাঁরও ঠিক তত। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখুন! এতদিন ধরে যাকে দেখছি কোনদিন তাঁর নামটিই জিজ্ঞেস করিনি। আসলে বিদেশের এ এক জীবন। বহু মানুষের সাথে নিত্যই দেখা হয়। একআধটা কথাও হয়। তবু বিশেষ ভাবে নামটাই জানা হয় না। কিন্তু আজ যে ব্যতিক্রম ঘটল সে কথা পরে বলছি। আগে তাঁর বর্ণনা দিই। সে—মানে একহারা শরীরের এই লোকটি এ তল্লাটেই থাকে। কখনও জামে মসজিদের সামনে বসে। কখনও মিসরীয় হোটল ‘মাতআম-আল জোদা’র সম্মুখে সার বেঁধে বসে থাকা শ্রমিকদের ভীড়ে থাকে। কখনও আমাদের দোকানের কার্নিশে সেই শীতল ছায়ায় তাঁর দেখে মেলে।
বেশভূষার কথা যদি বলি, তাহলে কোনোদিনই তাকে পরিপাটি দেখিনি। এই ক’টি বছরে কোনোদিন তাঁর শরীরে একজোড়া উৎকৃষ্ট জামা দেখিনি। পাদুকা জোড়া দেখলে বড় মায়া লাগে। বোঝাই যায়, বহুকাল ঘষে ঘষে এর তৈরীকালীন অবয়বটা সম্পূর্ণই অদৃশ্য হয়েছে। ফলে কালো চামড়ার উপরিভাগটুকু ঘোলাটে সাদা। আর গোড়ালির দিকটা ফেটে মৃত মাছের মত হা করা। মোটকথা জীবনের স্বাভাবিক জৌলুশ পরিত্যাগ করে যাপনে এমনই নিরন্ন এক মানুষ সে—যার প্রতি বিশেষ পরিচয়ের কোন আকর্ষণই জাগে না। তদুপরি তাঁর মুখের যে গড়ন—গাল দুটো গর্তের ভেতর চলে যাওয়ায় গ্রীবাটি দীর্ঘ হয়ে সম্পূর্ণ চেহারাটি এমন আকৃতি ধারণ করেছে—যেন সে আদিম ফারাওদের বংশোদ্ভূত কেউ। ফলে এতদিন তাকে আমি মিশরীয় ভেবে যে বিভ্রান্তিতে ছিলাম আজ তার ইতি ঘটলো। সেইসাথে নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবেও আপসোস করলাম। কেননা কেবল মুখটি কেন? কেন তাঁর ভাষা ও আরবি উচ্চারণে মনোযোগ দিইনি? কেন এদ্দিন ভাবিনি যে, তাঁর কথার ধরণ ও আরবির যথোপযুক্ত উচ্চারণ কোনোটিই মিশরীয়দের মত নয়! অতএব এমন অমনোযোগীতায় এ একটা বিষয় পরিস্কার হল, যত মহানুভবতার প্রকাশই করি না কেন—আমরা মূলত আকর্ষণপ্রিয়। যেখানে আকর্ষণ আছে, সেখানে আমাদের দৃষ্টি ও মন উভয়ই সক্রিয় থাকে। অন্যথা আমরা কেবল ভদ্রতাটুকু রক্ষা করি।
জবাবে সে বলে, আরবিটা তাঁর দেশের নয় নম্বর ভাষা। এছাড়া আরও আট আটটি ভাষা চলে সেই দেশে।
যাহোক, তা লোকটি সম্মুখে এসে স্থির বসলে— চোখ তুলে দেখি। প্রথমে কিছুটা অনীহা আসলেও তড়িৎ আড়মোড়া ভেঙে তাঁর প্রতি মনোযোগী হই। আন্দাজ করি আজ তাঁর ভঙ্গিটিই এমন যে, নিস্কর্ম বসে বসে বিরক্ত হয়ে গেছে। আর আমিও যেহেতু অলস বসে মৃদু ঝিমচ্ছি। তাই উপযুক্ত সঙ্গী ভেবেই তাঁর এই কথোপকথনের অনুরাগ। কাজেই আমাদের কথা শুরু হয়। তা চলতে চলতে নানা বিষয়আশয় অতিক্রম করে সংবাদপত্র ও খবরে গিয়ে ঠেকে। বলে, ‘আমি তো বাঙালিদের খোঁজ রাখি। বার্মা থেকে কত কত মুসলমান স্টিমারে করে তোমাদের দেশে গেল। তোমরা খুব উদার। ওদের জায়গা দিলে। তোমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম শায়খাতু হাসীনা। আরেকজন আছে খালেদা। দুটো শহরের নাম জানি দাক্কা (ঢাকা) ও সিলেট।’
বললাম, ‘ভারী আশ্চর্য! এসব জানো কী করে? তুমি কি সংবাদপত্র পড়ো?’
‘না। তবে খবর শুনি।’
‘অদ্ভুত মেধাশক্তি তোমার। আচ্ছা, তুমি তো মিসরীয় না?’
জবাবে হেসে বলে,’ না। এলেতেরিয়া।’
এই নাম তো আজ তক শুনিনি। এখানে ওই দেশের কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও হয়নি। ফলে আচমকাই আমার আগ্রহ উদ্দীপ্ত হয়। বলি, ‘এ নাম তো প্রথম শুনলাম ভাই। কোন মহাদেশে বলো তো?
‘আফ্রিকা।’
তারপর নানাভাবে আমাকে সে এই অপ্রসিদ্ধ দেশের বর্ণনা দিতে শুরু করে। কিন্তু কোনোভাবেই যখন বোঝাতে পারে না তখন শেষতক বলে, ‘ওই যে ইথুপিয়ার কথা শুনেছ না? যুদ্ধ চলছে। সে দেশের পাশেই।’
বললাম, ‘হ্যাঁ এবার বুঝেছি। কিন্তু এই ধরো নোটবুক। ওতে বানানটা একটু লিখে দাও। পরে ইন্টারনেটে খুঁজে নেব।’ কারণ ইতোমধ্যে বেশ ক’বার নানাভাবে দু ভাষাতেই মোবাইল নামক আশ্চর্য বস্তুটি দিয়ে গুগলে খোঁজ করলাম। কিন্ত কোথাও এর অস্তিত্ব পেলাম না। হয়তো আমিও জানি না আর সে-ও ঠিকঠাক বলতে না পারায় বানান ভুল হচ্ছে। ফলে দেশটির কোনও তথ্যই আসছে না। কিন্তু যখন তাকে নোটবুকে লিখে দিতে বলি, তখন হেসে বলে, আমি নিরক্ষর। বললাম, আরবি শব্দগুলো চেনো না বা ইংরেজি আলফাবেটগুলো? বলে, আরবি চিনি কিন্তু লিখতে পারিনা। আর ইংরেজিতে আমি শূন্যকুম্ভ।
অগত্যা তার মৌখিক উচ্চারণটুকু শুনেই এলেতেরিয়ার গল্প টুকে রাখলাম। তারপর আমাদের আরও বহু কথা হল। সে দেশের রীতি, ভাষা ও জীবন সম্বন্ধে নানা তথ্যই জানলাম। একপর্যায়ে বললাম, তোমার আরবি তো খাঁটি নয়। মানে উচ্চারণটি আরবিদের মত অত খাসা নয়। জবাবে সে বলে, আরবিটা তাঁর দেশের নয় নম্বর ভাষা। এছাড়া আরও আট আটটি ভাষা চলে সেই দেশে। বললাম, কী বলো? বলে, হ্যাঁ। তখন বহুকাল পর হয়তো অধমের এই রচনাখানি কোনও বাঙালি পড়বে ভেবে তাঁর জন্য পৃথিবীর অচীন এক দেশের বিবিধ ভাষার কথা জানতে খুব আগ্রহী হলাম। ‘এলেতেরিয়া’র মুসা আব্দুল্লাহর কাছে জানলাম তাঁর দেশের ভাষা ন’টি। সেগুলো— সাহু, আফার, তিগরিনিয়া, তিঘরি, কুনামা, নারা, রশদইদা ও আমারওয়ী। এসবের মাঝে শেষ দুটি ভাষার আবার ইতিহাস আছে। মানে, রুশাইদা নাম্নী এক ব্যক্তি কয়েক শতাব্দী আগে সৌদি থেকে গিয়েছিল সেই দেশে। পরবর্তীতে তাঁর নামেই গোত্র ও ভাষার নামকরণ করা হয়। আর আমারওয়ী ভাষাটির উৎপত্তি ইবনু আমের নাম্নী এক ব্যক্তি থেকে। প্রাচীন কালে (উর্দুন) জর্ডান থেকে ‘এলেতেরিয়া’য় পারি জমিয়েছিল এই লোক। যদিও পরে রাতভর মানচিত্র ঘেঁটে ইংরেজিতে এর যে নামটি আবিস্কার করলাম, তার সঠিক উচ্চারণ হল ‘Eritrea’ ।
গল্পের এই প্রান্তে এসে আমাদের কথা শেষ হয়। মুসা উঠে দাঁড়ায়। হয়তো মসজিদের খোলা চত্বরের দিকে যাবে। নতুবা রাতের আহার জোগাড়ে সবজি বাজারে। সে চলে যায়। আমি আবারও উঞ্চ রোদের ভেতর ডুব দিই। চোখ দুটি পিটপিট করে। একবার পিচঢালা পথে একবার আকাশের দিকে তাকাই। আমার মস্তিষ্কজুড়ে বাজতে থাকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আর তাঁর রৌদ্রের বাগান—
কেন আর কান্নার ছায়ায়/ অস্ফুট ব্যথার কানে কানে/
কথা বলো, বেলা বয়ে যায়/ এসো এই রৌদ্রের বাগানে।
এসো অফুরন্ত হাওয়ায়—/ স্তবকিত সবুজ পাতার/
কিশোর মুঠির ফাঁকে ফাঁকে/ সারাটা সকাল গায়ে গায়ে
যেখানে টগর জুঁই আর/ সূর্যমুখীরা চেয়ে থাকে
এসো, এই মাঠের উপরে/ খানিক সময় বসে থাকি,
এসো এই রৌদ্রের আগুনে /বিবর্ণ হলুদ হাত রাখি।
এই ধুধু আকাশের ঘরে/ এমন নীরব ছলোছলো
করুণাশীতল হাসি শুনে/ ঘরে কে ফিরতে চায় বলো।
এই আলো-হাওয়ার সকাল—/ শোনো ওগো সুখবিলাসিনী,
কতদিন এখানে আসিনি/ কত হাসি কত গান আশা
দূরে ঠেলে দিয়ে কতকাল / হয়নি তোমায় ভালোবাসা।
কেন আর কান্নার ছায়ায়/ অস্ফুট ব্যথার কানে কানে
কথা বলো, বেলা বয়ে যায়/ এসো এই রৌদ্রের বাগানে।
২৮ নভেম্বর মঙ্গলবার, ২০২৩
ক্রমশ..
লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক