আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ১৬

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ১৬

  • কাউসার মাহমুদ

গতকাল অপরাহ্নের কিছু আগে। যখন আলোটি  ম্লান নিরুত্তাপ হয়ে কোনোরূপ আকাশে ছড়িয়ে ছিল—ঠিক তখনই ঘুঘুর ছানাটিকে দেখতে পাই। প্রশস্ত সড়কের এক পাশে জবুথবু হয়ে ভীত চোখে পড়ে আছে। চারপাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে গাড়ি চলছে। এমন ব্যস্ত পথের কোণে, কোথা থেকে যে ছানাটি এল—বুঝতে পারলাম না। তদুপরি তখন এসব না ভোবে দৌড়ে গিয়ে ওটাকে কোলে তুলে নিই। অমন ভয়ার্ত চোখ আর ঈষৎ কম্পিত এতটুকু শরীরটাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বুঝতে পারি পাখা দুটি নির্বল। ভয়ে উড়বার শক্তি হারিয়েছে। তাই অতি আলগোছে দু’হাতের তালুতে রেখে আমার আবাসে নিয়ে আসি। বাটিতে সামান্য জল দিলে দেখি গতিশীল হতে চায়। উড়তে না পেরে তড়িৎ লাফিয়ে কয়েক পা সামনে এগুয়। যেন এক্ষুণি ডানা দুটি সঞ্চালন করতে হবে। এমুহূর্তেই উড়তে হবে। কিন্তু হায়! এত দুর্বল আর ভীত যে, কোনোক্রমেই শূন্যে বিচরণের শক্তিটুকু অধিকার করতে পারে না। তখন পরম মমতায় ওর পালক স্পর্শ করি। আঙুলে বসিয়ে বহুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কী আশ্চর্য চাহনি পাখিটার। মনে হয় ক্ষুদ্র চোখ দুটি নির্মল জলের মত স্বচ্ছ। তাতে ভয়, প্রেম, আদর—সমস্ত কিছু একীভূত হয়েছে। কখনও বিশ্বাস কখনও খুন হওয়ার আতঙ্কে সেই দৃষ্টি আমার মুখের ওপর নিবদ্ধ হয়েছে। তাতে আমার অবস্থাটিও হয়েছে বড় অদ্ভুৎ। মানুষ,পশুপক্ষী, জীবজগৎ, উদ্ভিদ নিয়ে এতসব বিচিত্র প্রশ্ন আসতে থাকে মনে—যেসবের কোনও প্রভেদই করতে পারি না। ফলে আমিও তার শস্যের মত ক্ষুদ্র চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকি। ওকে আশ্বস্ত করতে নিজের হৃদয়টা খুলে এনে চোখের পুতুলিতে বসাই। যেন এ মুহুর্তে সেখানে উদ্ভূত কোমলতা ও প্রবল মমতাটুকু দেখতে পারে। কোনোক্রমে বুঝতে পারে, এ আঙুল তাকে বন্দী করবে না। একটুও আহত করবে না। চাইলে কিছুকাল এখানে সে আমার সঙ্গে থাকতে পারে। আমার এই ছোট্ট ঘরটির এখানে-সেখানে অবাধ বিচরণ করতে পারে। মনে হলে আমার বিছানায় বসতে পারে। পড়ার টেবিলে বইয়ের ওপর ঘুমুতে পারে। বাইরে থেকে শুষ্ক তৃণলতা এনে এককোণে বাসাও বাঁধতে পারে। আমি তাকে বাঁধা দেব না। তার কোনও কাণ্ডে এতটুকু রুষ্ট হব না। দু’জনে মিলে বরং আনন্দে থাকবে। সুখদুঃখের গল্প যদি কোথাও বলতে হয়, তাহলে তার কাছেই বলব। বহুদিন ভেবে দেখেছি, কেবল মানুষ ছাড়া জগতের সকল প্রাণীই এক্ষেত্রে ভরসার। প্রাণীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের যে আশ্চর্য সুন্দরতা—তা বোধহয় অন্য কোথাও সম্ভবপর নয়। জগতে মানবকূলের কাছে চিরস্থায়ী বিশ্বাস ও আশ্বাস—দুটোই শঙ্কাযুক্ত। অতএব দুর্বল ভীত এ ছানাটির প্রতি ক্ষণ ক্ষণে যে বিমল আনন্দ আমার জাগছে—তার ঝঙ্কার কানে না শুনলেও হৃদয়ে এর হর্ষ ঠিকই অনুভব করছি। তাতে সবচেয়ে সুখকর যে স্মৃতিটি প্রাণবন্ত হয়ে জাগছে, তা রাসকিন বণ্ডের ‘দ্য বুক অব ন্যাচার।’ আহা! কী অপূর্ব এক বই। পড়তে গেলে প্রকৃতির স্বয়ম্ভু রূপটি এমন দীপ্তির সাথে চোখমুখ মনমগজ আচ্ছন্ন

প্রাণীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের যে আশ্চর্য সুন্দরতা—তা বোধহয় অন্য কোথাও সম্ভবপর নয়।

করে রাখে, যেন সে সময়টুকু তাতে বিলীন হয়ে যেতে হয়। আজ এ ছানাটির সঙ্গে বসে বসে সে কথাই মনে হল হঠাৎ। আচমকাই পাখি, বন, ফুল, মুকুল, রোমাঞ্চকর শৈশব— ইত্যকার বিষয়াদির কথা মনে পড়ল। মনে হল শিকারের কথা৷ বনবাদাড় ঘুরে খালাতো ভাইদের দস্যিপনার কথা।  ভেবে দেখি, এসবে কোনোকালেই প্রবল আগ্রহ ছিল না আমার। বন্যপ্রাণীদের কোনোদিনই খাঁচায় বন্দীর ইচ্ছে জাগেনি। করিওনি। তবে দলছুট না হতে বহুদিনই এই কর্মে শামিল হয়েছি। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে কোথায় কোথায় যে গিয়েছি ওদের সঙ্গে, সেই কথা ভাবলে এখনও শরীরটা হিম হয়ে আসে। যেন এখানের মরুভূমির দিকে তাকিয়ে হাহাকার করে বলি, কোন সবুজ ফেলে এখানে এলাম। কোন অনন্ত ছায়াবীথি অতীত করে এই রুক্ষতাকে আবাস বানালাম!

আহাহা! শৈশবে বিক্রমপুরের সেসব দিনগুলো ছিল সবচেয়ে সবুজ। ঋতুভেদে এমন বর্ণিল সময় আমার জীবনে আর কখনও আসেনি। নানাবাড়ি থাকতাম। খালাদের অপরিমেয় ভালোবাসার মাঝে আমি যে কী এক আদরের বিন্দু ছিলাম—সে কথা লিখে বোঝাবার শক্তি নেই। বোধকরি আমার খালাদেরও নেই যে, তাঁরা কি আপন সন্তানদের বেশি ভালোবাসত না আমাকে? তাঁদের ছেলেমেয়েরাও কোনদিন সহোদর ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি আমায়। ফলে যেকোনো উৎসব পার্বণ আর আনন্দযজ্ঞই হোক—নিজ পিতামাতার চেয়ে নানাবাড়িতেই থাকতে পছন্দ করতাম আমি। সেসব ভাইবোনদের মাঝেই মিশে যেতে ভালোবাসতাম। আমার বড় খালার নাম আলেয়া। তারই মেজো ছেলে আলমগীর। ওর সঙ্গে আমার সখ্যতাটি ছিল সবচেয়ে নিগূঢ়। ওর মত সহজ শিশু সেই তেইশ বৎসর আগে যেমন দেখিনি, আজ এই দীর্ঘ সময় পরে তেমন নরম আপন প্রেমময় আর নিঃসার্থ যুবাও আমাদের ভ্রাতৃকুলের মাঝে কেউ নেই। ফলে ওর সঙ্গে আমার জীবনটা সর্বসময়েই জড়িয়ে আছে। কী দেশে কী বিদেশে—আমাদের যোগাযোগে কোনোদিনই ছেদ পড়েনি। মনে পড়ে শৈশবে বর্ষায় নৌকা চালানো ও-ই শিখিয়েছিল আমায়। ও-ই শিখিয়েছিল বিক্রমপুরের সেসব আদিগন্ত বিস্তৃত বিলে আলুর মওসুমে কীভাবে আলু তুলতে হয় সে বিদ্যা। সবশেষে খোলা মাঠে দাউদাউ করে প্রলয়ের মত জ্বলতে থাকা আগুনের স্রোতের মাঝে কীভাবে আলু পুড়ে খেতে হয় সে কৌশলও। শিখিয়েছিল বর্ষা গেলে কীভাবে বিভিন্ন জলাশয় থেকে মাছ ধরতে হয় সে প্রক্রিয়া । ঝড়ের দিনে দুঃসাহসী নাবিকের মত কীভাবে বাগানে ছুটে গিয়ে ঝরে পড়া আম কুড়াতে হয়—পথিকৃৎ হয়েছিল সে পথেরও। মোটকথা এমন অপূর্ব শৈশব যারা পায়, তাদের সকলেরই একজন বেনামি শিক্ষক থাকে। কখনও বন্ধু কখনও ভাই কখনও অভিযানের সহযোদ্ধা হিসেবে যাঁর ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি। যে ভূমিকার কথা শৈশবে কোনোরূপ উপলব্ধ না হলেও একটা সময় পর স্মৃতির ভেতর নতুন চরের মত জেগে উঠে। আমার জীবনে আলমগীরের ভূমিকাও তা-ই। এমনকি এই যে আজ পাখির ছানাটির কথা বলছি। শেষমেশ তা নিয়েও ওর-ই দারস্থ হয়েছি।

জগতে মানবকূলের কাছে চিরস্থায়ী বিশ্বাস ও আশ্বাস—দুটোই শঙ্কাযুক্ত

মূলত আমার এ ভাইটি কাছেই এক আফগানি হোটেলে কাজ করে। সপ্তাহান্তে ওর ওখানে যাই। তাতে প্রায়শই ওর বদলে আমাকে স্বাগত জানায় একদল ফুটফুটে বিড়াল। শুনেছি ছাদের কোণে একটি খোপও বানিয়েছে ও। ওখানে কয়েক জোড়া কবুতরও রেখেছে। নিশ্চয়ই বেশ স্বচ্ছন্দ দিনাতিপাত করছে তারা। মোটকথা সেই শৈশব থেকে কুকুর, বেড়াল, পশুপাখির প্রতি ওর যে মমতা ছিল—তা আজও বিদ্যমান। তাই মনে হল, আমার চেয়ে ওর কাছেই ঘুঘুটি বেশি নিরাপদ। লালন-পালনে আমার চেয়ে ওর জ্ঞান ঢের বেশি। আমার যে আবেগ ক্রমাগত এই ছানাটির প্রতি বিস্তৃত হচ্ছে, নিশ্চয় তা অল্প ক’দিনের। কেননা যে তু্মুল ব্যস্ততায় সমস্ত দিন বাহিরে কাটাতে হয় আমার, তাতে এর পূর্ণ দেখভাল নিতান্তই অসম্ভব। তাই কেবলই আবেগ নয়— বরং আমার এই প্রিয় শিশু পাখিটি যেন একদিন সবল হয়ে আকাশে উড়ে যেতে পারে, সে আশাতেই আলমগীরের কাছে ওকে রেখে আসব ভেবেছি। হয়ত আজ বিকেলেই কিংবা কাল সন্ধ্যায়। যেন শবনম শাকিল ঠিকই বলেছেন:

ہر خوشی میں کوئی غم یاد دلا دیتا ہے

دل کا یہ رخ میری آنکھوں سے نہاں تہا پہلے

 

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *